এ বারে সেই গোলমেলে প্রশ্নটার উত্তর।
– আপনি ঈশ্বর মানেন?
(আমার ধারণা এই প্রশ্নটির উত্তরের পর অনেকেই বিমুখ হবেন। এক জীবনে কম তো দেখলাম না। বাম সরকারের চূড়ান্ত শিখর-সময়ে বাবা তারক নাথ আর সন্তোষী মা হিট করেছিল। ★তার পরের দশক থেকে অদ্যাবধিও বাবা লোকনাথ হিট।)
প্রশ্নের উত্তরে, এক কথায় বলে দেওয়া যেত, – না, মানি না।
কিন্তু পূর্বাপরটুকু না বললে খামতি থেকে যাবে। একেবারে বাল্যকাল থেকে ধরতে হবে কাহিনিটি।
আমার পিতামহ, দাদু বলতাম তাঁকে, সম্ভবত সে ভাবে আস্তিক বা নাস্তিক কিছুই ছিলেন না। পোস্টকার্ডের চিঠির ওপরে যদিও শ্রীদুর্গা সহায় লিখতেন কিন্তু জীবনের কোনও পর্যায়েই শ্রীদুর্গার সহায়তার তোয়াক্কা করেননি। পানওনি।
ওকালতি পাশ করেছিলেন। আদালতে একটি দিনও যাননি। সেই আমলের ইংরেজিতে এমএ। দুএকটা নীচু ক্লাসের পাঠ্যবই লিখেছিলেন। আর ছিল শিক্ষকতার চাকরি। ঠাকুরমা একগাদা ছেলেপুলে রেখে,(আমার সন্দেহ এই অনেক সন্তানের জন্ম দেওয়ার কারণেই), অকালে চলে গেছিলেন। সংসার দেখার কেউ নেই।
চূড়ান্ত দারিদ্র ছিল। কিন্তু আমার জ্ঞান হয়ে অবধি,
– ঠাকুর রক্ষা করো, এই জাতীয় আর্তনাদ কোনও দিন শুনিনি, তাঁর মুখে।
আর্তনাদ ছিল না। দারিদ্র কাটানোর উদ্যোগও ছিল না।
কাম হোয়াট মে… এই ছিল এই বাড়ির জীবন ধারনের অভিমুখ। বাড়িতে ঠাকুরপুজো বা নিতান্ত বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীঠাকরুন কে বাতাসা নিবেদনও আমাদের বাড়িতে ছিল না।
বরং পরবর্তী কালে আমার মাকে দেখেছি ফেরচণ্ডী (উচ্চারণে ফ্যারচণ্ডী…বোধহয় বিপত্তারিণীর পূর্ববঙ্গীয় গ্রাম্য রূপ) ব্রত, কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো এই সব করতে। তাও পুরুত ডেকে টেকে নয়। নিজেই পেতলের ঘটে সিঁদুর দিয়ে পুতুল(স্বস্তিকা চিহ্নের পরিবর্তিত চেহারা) এঁকে, ব্রতকথা বলে, ভক্তিভরে প্রণাম সেরে, বাতাসা কাটাফল ইত্যাদি প্রসাদ বিতরণ করতেন মা।
তাঁর বাপের বাড়িতে, অবশ্য পুজোর ঘটা ছিল খুব। ঠাকুরের আসনে একগাদা ঠাকুর। কে নেই সেখানে? লৌকিক অলৌকিক সবাই। পুরাণের দেবদেবীদের ছবি, প্রণবানন্দ, রামকৃষ্ণ-সারদা-বিবেকানন্দ, মায় দিদিমার দাদাশ্বশুর, সবাই হাজির। মামাবাড়িতে ছিল প্রতিষ্ঠিত পাথরের কালীঠাকুর। সেই কালীপুজোয় খিচুড়ি ভোগ।
তা ছাড়াও মাঝে মধ্যেই সত্যনারায়ণ নাকি শনি এই সব পুজো হত। আটা-কলা-দুধের সিন্নি (খেলেই অম্বল গ্যারান্টেড) আর অন্যান্য প্রসাদ। কী একটা প্রসাদ(বোধহয় শনিপুজোর) খেয়ে মুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকতে হত। বাড়ির ছাদের নীচে সেই প্রসাদ খাওয়া নিষেধ।
মা বোধহয় সেখান থেকেই পুজোর সংস্কার নিয়ে আমাদের হাফ-নাস্তিক বাড়িতে এসেছিলেন। আমার ছোটোবেলায় মা রোজ সন্ধ্যায় ধূপ জ্বেলে আমাকে নিয়ে আধ মিনিটের একটা স্তব গাইতেন।
ওঁ, স্থাপকায় চ ধর্মস্য সর্বধর্মং স্বরূপিনে
অবতার বরিষ্ঠায় রামকৃষ্ণায় তে নমঃ…
সেই স্তব ছাড়াও মা আর একটা অভ্যেস করিয়েছিলেন। রাত্রে শোবার আগে ঘরের আনাচকানাচ, বিশেষ করে খাটের তলা ইত্যাদি নিরীক্ষণ করে, বালিশে তিনবার টোকা দিয়ে ঠাকুর ঠাকুর বলে শুতে হবে।
এই মত কাটালাম সন১৯৬৯ অবধি। আমার ঈশ্বর আর ক্রমবর্ধমান সর্বগ্রাসী পাপচিন্তার সহাবস্থান চলল। আমি বাবা আর মার কক্ষচ্যুত হয়ে বেলুড় বিদ্যামন্দির হোস্টেলে এলাম।
সেখানে আবার ঈশ্বর ভাবনা নিয়ে বড় চাপাচাপি। ভোর সাড়ে চারটেতে করিডরে করিডরে ঘণ্টা বাজিয়ে হেঁটে যেত শেষরাত্রের মায়াময় স্বপ্নের হত্যাকারী। স্বপ্নে কী দেখছিলাম আর কে এসেছিল, তার রূপ আর পোষাক, সব দিনই একরকম নয় যদিও, থাক সেই অ্যাডোলেসেন্ট পাপ-পুন্য অবগাহনের বিস্তার নাই বা করলাম। মোটমাট সেই ঘুম চোখে মুখ ধুয়ে, দাঁত মেজে তড়িঘড়ি প্রেয়ার হলে সেই বিশেষ কোণে গিয়ে বসা। যেখানে বসে ছোট করে হলেও ধ্যানের অজুহাতে যৎসামান্য ঝিমিয়ে নেওয়া যায়।
এই পৃথিবীতে ধ্যানের অবকাশ কী মেলে? সেই বিশ্বামিত্র মুণি থেকে আমি অবধি সবার ইতিহাসই আদতে ধ্যানভঙ্গ হবার ইতিহাস।
লিড হারমোনিয়ামের প্যাঁ পোর সঙ্গে প্রবল কলরোলে তখন শুরু হয়েছে, – ভব সাগর তারণ কারণ হে…
যাই হোক, তখনও ঈশ্বর ছিলেন। সেই ষোলো বছর বয়সের কাফ-লাভের সময়ে সমবয়সী প্রথম প্রেমিকাটি তখন উচ্চতায় আমার চেয়ে ইঞ্চিখানেক বড়। সে আমলে আমার কেমন ধারণা ছিল ছেলেটিকে মেয়েটির থেকে লম্বা হতে হবে। পরে অবশ্য বড় হয়ে বুঝেছি এটা তেমন অবশ্য পালনীয় নিয়ম নয়। অন্য রকম হলেও কর্তব্য কর্মে ইতরবিশেষ কিছু ঘটে না।
কিন্তু পাঁচ ফুট সাড়ে চার ইঞ্চির সেই বয়ঃসন্ধির কিশোরটি প্রেয়ার হলে তার ঈশ্বরকে প্রতি সন্ধ্যার প্রণিপাতে মনপ্রাণ ঢেলে একটিই নিবেদন করত। – ঠাকুর, আমাকে বেশি না, আর ছ ইঞ্চিখানেক লম্বা করে দাও।
না ঠাকুর মুখ তুলে চাননি।
আমার পরিবারের সবাই দীর্ঘকায়। অধিক কী বলব, আমার খুড়তুতো বোনটি অবধি আমার চেয়ে ছ ইঞ্চি লম্বা। আমার দুই পুত্রও বেশ লম্বা। এইখানে আমার মাকে একটু দোষারোপ করে নিই। আমার মা স্বাস্থ্যবিভাগে কাজ করতেন। সেই সুবাদে অল্পস্বল্প ওষুধবিষুধও জানতেন। আমি ছোটো থেকেই ক্ষীণকায় হবার জন্য মায়ের মনে আক্ষেপ ছিল। তাই আমাকে স্বাস্থ্যবান করার জন্য, সম্ভবত কোনও ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই আমাকে ক্লাস টেন না ইলেভেনে সেই সময়ে বাজারে চালু ডায়নাবল ট্যাবলেট খাইয়েছিলেন তিনি। পরে ডাক্তারি পড়তে গিয়ে বুঝেছি ওটি অ্যানাবলিক স্টেরয়েড।https://m.indiamart.com/proddetail/dianabol-tablet-22611060897.html এবং উঠতি বয়সে খেলে হিতে বিপরীত হয়ে লম্বায় বেড়ে ওঠাটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এবং তাইই হয়েছিল! তখনের সেই বালক আজও পাঁচফুট সাড়ে চার।
কাজেই দু বছর বেলুড় বাসের পর এই সামান্য(নাকি অসামান্য) ইস্যুতেই আমার ঈশ্বরভক্তি আর প্রথম প্রেম দুটিরই জলাঞ্জলি ঘটে। এত সামান্য কারণে যে ভক্ত সটকে পড়তে পারে তা ঈশ্বর বোধ হয় কল্পনাও করতে পারেননি।
এর পরে নায়কের প্রবেশ মেডিক্যাল কলেজে। হোস্টেল পাবার সংগ্রামে বামপন্থী ছাত্র রাজনীতি করা ছেলেদের ঘরে গেস্ট হিসেবে ঢুকলাম। এবং সেই রাজনীতির অনুরক্ত হলাম।
অনুঘটক ছিল সহপাঠী অমিতাভ ভট্টাচার্যের সঙ্গ। এবং অবশ্যই বেশ কিছু অন্য মানুষও। শ্রদ্ধেয় (এবং ইদানিং মোহমুক্ত) অমিত পান আর গৌরাঙ্গ গোস্বামী এবং আরও অনেকে অরুণাচল শোধনের এই প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন
বামপন্থী রাজনীতি আর যুক্তিবাদ (?) আমার কাছ থেকে আমার চেনা ঈশ্বরকে কেড়ে নিল। এক ঝটকায় আমি কোনও কল্পিত ঈশ্বরকে প্রণাম, মন্দিরে বা প্রতিমার সামনে, বিপদে পড়লে (কিম্বা না পড়লেও) ‘হে ঠাকুর, হে ঠাকুর’ করে সবাক বা নির্বাক ডাকাডাকি এই সব অভ্যেস থেকে বেরিয়ে এলাম। বামপন্থী রাজনীতি আর কিছু দিক না দিক, ভূত-ভগবান-অতিপ্রাকৃত বিশ্বাস থেকে মুক্তি দিয়েছে আমাকে।
তবে, কলেজ , চাকরি, প্রেম ও সংসারযাপনের এক জীবনে প্রবল ব্যস্ততায় ও কৌতুকে মিঠে কড়া ঈশ্বর ভক্তদের সঙ্গে কাটালাম। সেই জীবনের মণিকণা কিছু কম নয়।
যেমন দেবাশিসদা। তার পাতলা ব্রিফকেসের ওপরের ঢাকনার ভেতর দিকে আরাধ্যের ছবি লাগানো। সেটি ইঞ্চিখানেক ফাঁক করে ধূপ জ্বালিয়ে সকাল সন্ধ্যে আরাধনা করত। আমরা পেছনে লাগতাম বলে এত সাবধানতা। একদিন রেগে মেগে আমাদের চ্যালেঞ্জের মুখে ব্রিফকেস খুলে দাদা হতবাক। গত তিনমাস ধরে সে রোজ হেমা মালিনীর ছবিকে ধূপের ধোঁয়া দিয়ে আরতি করেছে।
এই ঘটনাটার একটা প্রতীকী দিক আছে। ঈশ্বর আরাধনা বলে যা মানুষ করে আদতে তার সেই ঈশ্বরের চেহারা কখন যে বদলে গেছে সে নিজেও জানতে পারে না।
এরই মাঝখানে কিছু খুচরো পারিবারিক ব্যাপার উল্লেখ না করলে ঈশ্বরের সঙ্গে বেইমানি করা হবে। আমার পিতৃদেব কিন্তু জীবনের শেষ দিন অবধি তীব্র ভাবে ঈশ্বর ও বামপন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন। বস্তুত তাঁর চিঠিতে এই রকমের বিবৃতিও থাকত, – পরম করুণাময়ের আশীর্বাদে ও পরমহংসদেবের কৃপায় বামফ্রন্ট এইবারেও সুইপিং মেজরিটি অর্জন করিবে।… ইত্যাদি। কিন্তু পূজাপাঠ বা অন্যরকমের মাতামাতি তাঁর ছিল না।
তাঁর যমজ ভাই, তিনিও রাজনৈতিক বিশ্বাসে একই ছিলেন। তিনি সত্তর দশকের শেষে ঝাঁকড়াচুল সাঁইবাবার ভক্ত হয়ে পড়েন।
যাঁরা জানেন না, তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাই, সাঁইবাবা দুজন আছেন মানে ছিলেন। একটি অরিজিনাল, রোগা মত। অন্যটি তাঁর জন্মান্তর। ঝাঁকড়াচুল, স্বাস্থোজ্জ্বল।
কার্যকারণ জানি না। কিন্তু আমার বড়কাকুর নানান কর্মকাণ্ড যথেষ্ট আগ্রহ উদ্দীপক ছিল।
তাঁর আরাধ্য সাঁইবাবার ছবি থেকে যে বিভূতি ঝরে পড়ে, এই ব্যাপারে তিনি ও আমার কাকীমা স্থির নিশ্চিত ছিলেন। আমি এবং আমার স্ত্রী (যাকে ওঁরা দুজনেই খুব স্নেহ করতেন) যদি এই আধ্যাত্মিক ভস্মরাশিতে সন্দেহ প্রকাশ করতাম, সেই দম্পতি খুবই ব্যথা পেতেন।
আমি সচরাচর সেই কাজ করতামও না। সাধ করে অযথা মনোহর পুকুর রোডের সেই স্নেহধারা (এবং সেই সঙ্গে খাদ্যধারা) সেই ক্ষুধাতুর জীবনে ব্যাহত করার কোনও মানেই হয় না।
সেই কাকার দুই ছেলেমেয়ে, তাদের কিন্তু সাঁইবাবা প্রভাবিত করতে পারে নি।
একটা কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা বলে শেষ করি। কাকীমা না কাকুর সঙ্গে, মনে নেই তাঁদের এক সমবেত অনুষ্ঠানে গেছি। ভজন কীর্তন ইত্যাদি চলছে। মূল আকর্ষণ অর্থাৎ প্রসাদ বিতরণ শেষে হবে। ততক্ষণ অবধি থাকতেই হবে। মানে, যে জন্য যাওয়া!
কীর্তনের একটা অংশ শুনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। গায়ক গাইছে, – গোবিন্দ, গোঁফঅলা…
সবাই একসঙ্গে ধুয়ো দিচ্ছেন সমস্বরে,( আমার কাকু কাকীমাও) – ওই গোবিন্দ গোঁফ অলা…
শ্রীকৃষ্ণ বা গোবিন্দের যত ছবি (যৌবন বা বয়ঃসন্ধির) দেখেছি, ক্যালেন্ডারে ধর্মগ্রন্থে বা মূর্তিতেও, কোথাও তাঁর গোঁফ দাড়ি দেখিনি। ত্রিভঙ্গ মুরারী, পাশে রাধা। কুরুক্ষেত্রে রথের সারথি। না কখনও না।
হয় তিনি মাকুন্দ ছিলেন, নইলে মথুরা বৃন্দাবনের সেলুনে তাঁর নিত্য যাতায়াত ছিল। সেই তাঁকে গোঁফ অর্জনে সাহায্য করেছে সাঁইবাবা? কাকা কাকীমাকে জিজ্ঞেস করবার সাহস নেই।
পরে খোঁজ নিলাম আমার সমবয়সী অন্য এক ভক্তর কাছে। তিনি উচ্চাঙ্গের হাসিতে আপ্যায়িত করে বললেন,
– আপুনি এহি সাঁই সোসাইটিতে লতুন আছেন, না?যেটা গান গাওয়া হল, উ গোঁফ অলা টলা না। হামরা গাইলম,
গোবিন্দ-গোপালা…
বোঝো ঠেলা!
ঈশ্বর আর অপ্রাকৃতর ব্যাপারে বাবাদের চতুর্থ ভাই, আমার ধনকাকু শ্রী অমিয়রঞ্জন (মেজর এআরডি চৌধুরী) ছিলেন সব থেকে উৎসাহী মানুষ। জ্যোতিষ, কুষ্ঠি এবং গ্রহনক্ষত্রের ব্যাপারে প্রচুর পড়াশুনো করতেন।
হিন্দুস্থান পার্কে তাঁর ফ্ল্যাটের পাশের গাছে এক কাকের বাসা। কাক মা ডিমে তা দেয়। একদিন সন্ধ্যেয় ডিম থেকে ছানা বেরোলো। সেই ছানার কুষ্ঠিবিচার করা হল জন্মসময় মিলিয়ে। তারপর কাকা রাত দশটায় উচ্চস্বরে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বললেন, – কাকদিদি, শোনো, তোমার এই সন্তানকে কখনও খাদ্যাভাবে দূরদেশে যেতে হবে না। কিন্তু এ অকালে মাতৃহীন হবে।
কাক ম্যাডাম কী বুঝল কে জানে। রাত্রি বেলায় এই খামোখা অত্যাচারে কা কা বলে উড়ে গিয়ে পাশের গাছে বসল। মাতৃহীন হবার ভবিষ্যদ্বাণী প্রায় তখনই সফল হয় আর কী!
ধনকাকু চাকরি জীবনে ঘুরেছেন প্রচুর। এই জাতীয় ধার্মিক সঙ্গও করেছেন অনেক। সেই আমলের পুলিশের(পুরো নাম উপানন্দ কী যেন) এক বড়কর্তার দাদা ছিলেন তান্ত্রিক সাধক। তাঁর সঙ্গে খুব দহরম মহরম ছিল ধনকাকুর। তিনি অনেক সাধনালব্ধ পাথর ইত্যাদি দিয়েছিলেন ধনকাকুকে। সেই একখানি পাথর, সেটি নাকি হিরে নাকি হিরের অ্যানালগ কিছু, বাবাকে সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে পরতে আদেশ করলেন ধনকাকু। ভাইদের মধ্যে তিনি খুব আদেশপ্রবণ ডমিনেটিং ছিলেন। বাবা অমান্য করার সাহস পেলেন না।
যাই হোক আঙটি পরার পরে বাবা আর মার প্রবল দাম্পত্যকলহ হল একটানা একমাস। বাবা রেগেমেগে আঙটি খুলে ফেলে মায়ের সামনে মিনমিন করে ঘোষণা করলেন, – অমুর এই পাথরটা আমার সুট করছে না।
আর কী আশ্চর্য, একমাসের পুরোনো ঝগড়া মিটেও গেল!
জনান্তিকে বলি, নাস্তিক্য নামক মৌলবাদে আক্রান্ত হয়েও আমি সৎসঙ্গের আলোচনা সভায় গেছি, গেছি ইস্তিমা-জলসাতেও। চার্চে গেছি বড়দিনের ঝুলন দেখতেও।
আমার ঈশ্বর এই সব মূর্তি, ছবি, জমায়েত, ইসতিমা, জলসা, আচার আচরণ, ভজন-কীর্তন-জিগির, জ্যোতিষ, গ্রহ-আঙটি-তাবিজ, ইত্যাদিতে ঢেকে গিয়ে কখন যেন উধাও।
যেন…
– দেখ্ রে চেয়ে আপন-পানে, পদ্মটি নাই, পদ্মটি নাই।
সে না থাক। আমার সারা জীবন আলো করে ঈশ্বর আছেন।
সেই জেদি একরোখা মানুষের জন্য ডুকরে ওঠা আমার ঈশ্বরচন্দ্রকে বলি,
…
– আমার ঈশ্বর নেই, অথবা তুমিই,
প্রকৃত প্রস্তাবে সেই ম্লান মুখ ঈশ্বর আমার…
আমার প্রাণের ঠাকুরকে বলি,
…
সময় খুব হিসেব কষে ছুটেছে দিনভর,
বুক ফাটানো পিপাসা নিয়ে, কেই বা মাথা ঘামায়!
চাওয়াটুকুই বাঁচা, পাওয়ার হিসেব অবান্তর,
গানের ঠাকুর প্রাণে প্রাণে বলে গেলেন আমায়।
মাউসক্লিকের দূরত্বে সেই আকাঙ্খা রাত জাগে…
নিথর বুকে প্রাণের ঠাকুর চরণ রেখেছেন।
ভারচুয়াল রিয়ালিটিতে রবি ঠাকুর যেন,
চাওয়া এবং পাওয়ার মধ্যে বিষণ্ণ হাইফেন!
এবং আগেই এই কলামের অন্য কোথাও বলেছি, ঈশ্বরও এখন হাইটেক হয়ে গেছেন। তিনি নানান নাম্বার থেকে ফোন করেন, কখনও বা হোয়াটসঅ্যাপে, মেসেঞ্জারে ফোনে বার্তা পাঠান। আমাকে বলেন, – অরুণাচল দা’, উঠে দাঁড়ান। আত্মজৈবনিক উপন্যাসটা লিখে ফেলুন। শেষ না করা বাক্যগুলোয় কবিতার গুঁড়ো ছড়িয়ে দিন। আমার মত বাঁচুন। আমাদের মত। আমি যেমন অঞ্জনাকে নিয়ে…
ঈশ্বর রাণাঘাট থেকে, শিলিগুড়ি থেকে, কালিম্পং থেকে, তাইওয়ান-উত্তর কোরিয়া- সুইডেন থেকে খোঁজ নেন আমার। ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করেন কেমন আছে হতমান, বিধ্বস্ত পরিজন সমেত আমার একচিলতে ঘর।
★
আমি ফিসফিস করে… নিজের মত করে নিজেকে বলি,
★
ঈশ্বর নিজে নয়, তার এক অতিক্ষুদ্র কণা
আমাদের কুঁড়েঘরে উঁকি দিযে গেছে,
ও পৃথিবী… তাকে তুমি চিনেও চেন না
আমার বিস্মরণে রোজ ওই কণা নয়
না আসা কন্যাটিকে ডাকি
আর রোজই ভুলে যাই কোথাও যাবার কথা ছিল
কী কথা দিয়েছি তাকে … ঠিক কী কী কথা
আমার মুহূর্তরা পরবর্তী ধ্রুব মুহূর্তকে
নিছক প্রকৃতিবশে চিনে নেয়… (হয় তো অযথা…)
প্রাকৃতিক নিয়মকানুন… এড়ানো কঠিন বড়
এটাই দৈব, তবু কোনও কোনও অনিশ্চয়তায়
আমার একাকী বিশ্ব… অসীম বিশ্বে ভেঙে যায়
অকিঞ্চিত ভর দিয়ে ডেকে নিই অযুত কণাকে
সমস্ত ভালোবাসা ঢেকে দেয় …(যদি থেকে থাকে)
লক্ষ কোটি সময়ের ঢেউ …
তন্মুহূর্তে কেউ
যদি বলে …বাপী সাথে যাবো …
অপলক এই কুঁড়ে ঘর
চিনে নেয় …
কণা নয় … এসেছে ঈশ্বর!
★
একটা ভুল স্বীকার করি, Parag ধরিয়ে দিলেন। জয় সন্তোষী মা ১৯৭৪ আর বাবা তারকনাথ ১৯৭৭, দুটোই বাম-শিখরের আগে। স্মৃতিবিভ্রম হয়েছে আমার।