প্রশ্নঃ- ঈশ্বর না হয় মানেন না। কিন্তু ধর্ম? সেটা তো মানেন? নইলে ফর্ম ফিলাপ করেন কী ভাবে?
উত্তরঃ- ধর্ম মানে? ওঃ, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম? মানে আমার বেলা হিন্দু ধর্ম!
আমার বাবা যে ধর্মের ছিলেন, আমাকেও তো সেই ধর্মের হতেই হবে তাই না? নইলে বড় হয়ে ধর্মান্তরিত হয়ে অন্য ধর্মের। মোটমাট ‘ধর্ম’ একটা থাকতেই হবে। ধর্মহীন হবার কোনও অধিকার নেই আমার কিম্বা তোমার। ভাবখানা এই রকমের।
নাস্তিক হলে তোমার কল্লা কেটে নিতে পারবে যে কোনও গণতান্ত্রিক কসাই। চপার দিয়ে, তলোয়ার দিয়ে। সেটা ধার্মিকদের অধিকার।
আজ সকালেই বাড়িতে রান্না করার কেউ নেই, (স্ত্রী শয্যাশায়ী) অথচ পাটশাক আছে, এমন পরিস্থিতিতে ইউটিউবে এক রান্নার ভিডিও পেলাম। তাতে হিন্দু পদ্ধতিতে পাট শাক ভাজার কথা বলা হয়েছে।
এটাই দুর্ভাগ্য। রান্নার পদ্ধতিকে অবধি দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে ধর্মের নামে। খ্রিস্টান পদ্ধতিতে বা বৌদ্ধ পদ্ধতিতে রান্নার প্রকরণও হয় বুঝি?
আমাদের এই উপমহাদেশে প্রধান ধর্ম দুটির মাঝে এই যে খিঁচ, এক ধরণের মানসিক রোগের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। না হলে এই কাণ্ড ঘটতেই পারে না। ঘটে গেছে এমনকি দেশ বিভাগের মত ঘোর অন্যায়ও।
ব্যক্তিগত ভাবে ‘হিন্দু’ শব্দটাতেই আমার এক ধরণের আপত্তি আছে। আমার যা জ্ঞান, এ দেশি পুরাণ, মহাকাব্য বা অন্য কোনও ধর্মপুস্তকেই এই ‘হিন্দু’ শব্দটি নেই। বহিরাগতদের উচ্চারিত শব্দ এটি। বোধহয় সিন্ধুর অপভ্রংশ। তাদের কথামতো এদেশের অধিবাসী কেউ হিন্দু হতে যাব কেন?
কিন্তু তা হবার নয়। ফতোয়া… জিগির… গর্ব্ সে কহো হম্ হিন্দু হ্যায়।
আর তা না হলে তুমি মুসলমান, আদর করে ডাকলে যে সংখ্যালঘু। আদরের অন্য সংখ্যালঘুরাও আছে। কারও ডাকনাম খ্রিস্টান, কেউ শিখ বা বৌদ্ধ। ভোটের বক্তৃতার শেষে সেই তাদের জন্য মন্ত্রপাঠ, সালাম, দোয়া আরও কত কিছু। তা’ হলে ব্যাপার কী দাঁড়ালো? বহিরাগতদের দেওয়া পরিচয়ে পরিচিত হয়ে হিন্দু হতে হবে আমাকে, । আর নইলে নিদেন পক্ষে অন্য যে কোনও ধর্ম বেছে নিতে হবে। সরকারি বেসরকারি ফর্মে রিলিজিয়নের ঘর ফাঁকা রাখলে ফর্ম বাতিল।
প্রথমে সাহস পেতাম না। পরে ধর্মের ঘরে ‘ডাজ্ নট অ্যাপ্লাই’ লিখেছি ভয়ে ভয়ে।
খালি হিন্দু হলেই হবে না। খোঁজ রাখতে হবে তাদের অন্যান্য নিয়ম। এর হাতের ছোঁয়া জল সে খাবে না।
হিন্দু তো বটেই। অন্য ধর্মেও এই সবের ছায়া। এর বাড়ির মেয়ে তার বাড়ির ছেলের প্রেমে পড়লে ‘অনার কিলিং’। ওঃ, কী যে সম্মান আর কীসের সম্মান বোঝা দায়। এর মন্দিরে তার প্রবেশাধিকার নেই। ওর মসজিদে সে ঢুকতে পারবে না। এই ধর্মস্থানগুলিই হয়ে দাঁড়ায় বিষোদ্গার আর পাপের আখড়া। অধিক কী বলব, পুরীর মন্দিরের গর্ভগৃহেই নাকি সেই কবে কাকে…।
জয়ী পক্ষের হলে, বিজিত দের ধর্মস্থান ভেঙে সেখানে নিজেদের ধর্মস্থান বানানো, গনিমতের ভাগ বাঁটোয়ারায় দাস ও মেয়েদের বন্টন এই সব… সবই করা যায় ধর্মের অজুহাতে। অবশ্য ইদানিংকার পার্টি অফিস দখলও প্রায় একই। পার্টি যেখানে ধর্মবিশ্বাসের সমতুল। একেবারে এক। দখল করো। বিপদ বুঝলে, স্বার্থ বুঝলে ধর্মান্তরিত হও।
অথচ ধার্মিকদের চেপে ধরলেই, ভালো ভালো কথা। আমার ঈশ্বর এই বলেছে, তাই বলেছে। সবাইকে ভালোবাসতে বলেছে। অতিরিক্ত ধন গরীবদেরকে দিতে বলেছে। আরে, অন্যকে বঞ্চিত করেই তো অতিরিক্ত সম্পত্তি অর্জন। সেইটি না করলেই তো বখেরা মিটে যেত!
ধর্ম বলতে তো সেই আব্রাহাম আর পেগান! আব্রাহামদের কী যে আলাদা, ইহুদি, খ্রিস্টান আর মুসলমান ধর্মের তা তাদের ঈশ্বরই জানেন। ধর্মের বই-পুরাণ আর আদম হবা থেকে শুরু করে সবই তো এক। তবু তাদের লড়াই থামে না। ক্রুসেডই বলো আর হালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কিম্বা ইজরায়েল প্যালেস্টাইন বলো। সবই আসলে সম্পত্তি, মেয়েমানুষ দখল আর নরমেধের অছিলা।
এ দিকে পেগানদের হালও তাই। শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব কত না ভাগ আর মারপিট। তার ওপর ইতিহাস ঘাটলেই আবার বৌদ্ধদের সঙ্গেও ব্রাহ্মণ্যধর্মেরও।
ভারতীয় ধর্মমতে আবার সেই একেশ্বরবাদীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয় অবিভাজ্য এই রকমের ধারণাও আছে। তাহলে ঈশ্বরে ঈশ্বরে এত তফাত কেন?
না, নেহাতই মেধাহীন বলে আমি এক কথায় নাকচ করে দিয়েছি এই সমস্ত কচকচানি।
আমার ধর্ম নেই। মানে ধর্ম বলতে ঈশ্বর ভাবনা সম্পৃক্ত যে ভাবনা আর আচার আচরণ সেইগুলো। তার মধ্যে শরীর চর্চার অংশটুকু অবশ্য পালন করা উচিত স্বাস্থ্য রক্ষার খাতিরে। নামাজ(যেটি ভেবে দেখলে হয় তো সমবেত সামরিক কুচকাওয়াজের ধর্মীয় রূপ) কিম্বা বিভিন্ন আসন ইত্যাদি এগুলো পছন্দ আর সাধ্যমতন করলে মনে হয় শরীরের পক্ষে উপকারী। সেই সঙ্গে নিয়মিত স্নান, ওজু ইত্যাদি পরিচ্ছন্নতার প্রকরণ।
আমি জানি, আসলেই আমি পল্লবগ্রাহী। ধর্ম সম্বন্ধে জানতে হলে পড়তে হয় নাকি অনেক। সাংখ্য বেদ বেদান্ত উপনিষদ কোরান হাদিস ত্রিপিটক, টেস্টামেন্ট ও আরও কত না রকমারি কেতাবসমূহ। সবিনয়ে বলি পড়াশুনোয় কাঁচা বলে সেই সমস্ত থিয়োরি পরীক্ষায় ডাহা ফেল আমি।
কিন্তু প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় যে ধর্মের মাস্টারমশাই নিজেই ফেল, ইতিহাস সাক্ষী।
তাই সেই অবিনাশ ঈশ্বর আমার নেই। যে কিনা এক ও অদ্বিতীয়। সর্বশক্তিমান। আমার এক বন্ধু এই নিয়ে কিঞ্চিৎ তরল ফ্যালাসি বলেছিল।
বলেছিল, এই শর্তগুলি পরস্পর বিরোধী। ঈশ্বর সর্বশক্তিমান হতেই পারে না। কেননা আর একটি সমান মাপের ঈশ্বর তৈরি করা তার অসাধ্য, এক এবং অদ্বিতীয়ের শর্ত অনুযায়ী।
আর একটা বলেছিল। সেটি আরও তরল। ঈশ্বর এমন ভারি একটি জিনিস বানাতে পারবে না, যেটি উত্তোলন করা তার সাধ্যাতীত। অর্থাৎ যে কোনও ভাবেই সে সর্বশক্তিমান নয়।
এগুলি কুযুক্তি। আমি জানি। তবু ঈশ্বর থাকা না থাকায় আমার কিছু আসছে যাচ্ছে না যখন, আমি কেনই বা মানতে যাব তাকে?
আমার নেই সেই নিছক মূর্তিগুলিও যেগুলি বিসর্জনের পর খড় বেরিয়ে পরে। অথবা অষ্টধাতু ও পাথরের তৈরি মূঢ়তা যাদের গলিয়ে ফেলা যায়, অ্যান্টিক বলে বিক্রি করা যায়। নিজেকে রক্ষা করার কোনও ক্ষমতা নেই যার।
আমার আছো তোমরা। শুধুই তোমরা। যে তুমি আমাকে ছোটোবেলা থেকে এই বয়সে পৌঁছে দিয়েছ। ভালোবাসায় শোকে করুণায় ও আঘাতে। দহন দিয়েছ, প্রলেপও দিয়েছ। অশান্ত সৃষ্টি আর ধ্বংসের মধ্যে দিয়েছ শান্তির স্থিতি।
ভেবে দেখলে তুমিই আমার ধর্ম। বেঁচে থাকার অমোঘ এক ধর্ম। যে ধর্ম আজও আমার বয়সকে কুড়ি বছরের গণ্ডি পেরোতে দেয়নি। মূঢ় দিকভ্রান্ত সেই সদ্য তরুণ আজও প্রচুর বাঁচবার চেষ্টা করে, প্রচুরতর ভুল করে বাঁচতে গিয়ে। যে তরুণ নতুন করে রোজ প্রেমে পড়ে এক স্বপ্নলব্ধ তরুণীর। ভুল করে যাকে তুমি ব্যাভিচারী ভাবো।
সেই বেঁচে থাকাটাই ধর্ম আমার।
★
আমি তোমাকে আঘাত করি না ধর্ম। নিশিদিন ভয়ে ভয়ে থাকি।
আমাকে দয়া করো, বাঁচিয়ে রাখো।
তুমি কি জানো না,
এই বেঁচে থাকাটাই, বাঁচতে চাওয়াটাই ধর্ম আমার?
তোমার আদেশে
ক্রুসেডে গেছি, কাফেরকে মেরেছি
ধর্মযুদ্ধে খুন করেছি অজস্র জ্ঞাতিভাইকে
একলা নির্জন ঈশ্বর
বহুমূর্তিধারী দেবতা মায়
পাথর প্রতিম প্রতীক
সবার কাছে গেছি হামাগুড়ি দিয়ে
পুব পশ্চিম উত্তরে দক্ষিণে মুখ করে দাঁড়িয়েছি
ফুল ছুঁড়েছি, পাথরও
যখন যেমন হুকুম করেছ
বাঁচতে চেয়েও আমরা মরে গেছি
শরীরে সংস্কৃতিতে মেধায়
সবাই বারবার
শুধু তুমি একা
ডায়নোসরের প্রতিভায় বেঁচে আছ
একে অন্যকে তাড়া করে, ঘাড়ে দাঁত বসিয়ে
আমাকেও বাঁচতে দাও ধর্ম
আমি অনন্তযৌবনা হুরি কিম্বা অপ্সরা চাইনি
ইহলোকেই ঝলসে যেতে চাই
আমার সন্তানের জননীর আঁচে
কোনওক্রমে প্রাণ খুঁজে পাওয়া
এই দুঃখী নোনাজলের গ্রহে
আসলে এই বাঁচতে চাওয়াটাই
একমাত্র ধর্ম যে আমার…