প্রশ্নঃ- আপনি নেশা করেননি?
উত্তরঃ-
(তৃতীয় ভাগ)
তামাক আর গাঁজার পর সুনিশ্চিত ভাবে এই বার স্বীকার করতে হবে এই তুচ্ছ জীবনের সোমরস প্রসঙ্গ। দারু নিয়ে চারুকথা। অপিচ আমার দারুকথা।
শিরোনাম নেশা। অথচ কী কাণ্ড, সোমরস শব্দটি নিয়ে এখনও কিছু বলা হল না। আরে বলব কী। সেই যে বেদ পুরাণে এর মাহাত্ম্যকথা বর্ণনা আছে, তার পর থেকে বিলকুল নাপাত্তা হয়ে গেছে বস্তুটি। অথচ পুরোনো অন্য সব কিছু আছে। মদ্য আসব মাধ্বী আরও কত কিছু… দেশি বিলাতি। কিন্তু সোমরস উধাও।
সোমলতা কোথায় পাওয়া যায় তার কোনও হদিশ নেই। সবাই ভেবে ভেবে অস্থির। কেউ বলে সে’ লতা অবলুপ্ত। কেউ বলে স্বর্গের জিনিস, দেবতারা ফেরৎ যাওয়ার সময় ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন।
উষ্ণায়ন বা পরিবেশদূষণ…কেউ এখনও বলেনি তবে বললেও আটকানোর কেউ নেই।
কেউ কেউ বলেন, নাম বদলে গেছে। সে’টাই সম্ভব।
যেমন কারওর মতে আখের নাম এককালে ছিল সোমলতা। আখ গাছের সঙ্গে নাকি মিলেও যায় সোমলতার বর্ণনা।এইটি হলে আর কোনও গোল থাকে না। আখ পিষে যে শর্করামিশ্রিত রস সে’টি বা তা’ থেকে উদ্ভূত গুড় গ্যাঁজালেই মদ, এ’ কথা সবাই জানে। কিন্তু বিদ্বানেরা কবেই বা সহমত হয়েছেন!
অন্য আরও কেউ বললেন, সোমলতা হচ্ছে আদতে পপি গাছের নাম। আর তার কন্দ থেকে(ইয়ে, ফল থেকে) পাওয়া মাদকটিই সোমরস। কিন্তু সে’তো আফিম। তা’কে সোমরস মানতে মন চায় না।
কেউ কেউ ওই গুড় বা অন্য কিছুকে চাঁদের আলোয় রেখে গ্যাঁজানো ব্যাপারটাকে চাঁদের ভালো নাম ‘সোম’এর সাথে মেলাতে চেয়েছেন। অথবা জ্যোৎস্নার মত মায়াবী মোহময় যে রস, সোম থেকে নেমে আসা পানীয়, তা’ই হল সোমরস এমন ব্যাখাও দেন কেউ।
★
এই ব্যাপারে আমার পাঠকেরা যদি কিছুমাত্র তথ্য জানেন এ’খানে কমেন্টে জানালে আমি তো বটেই সবাই উপকৃত হব।
★
আমি লিখে কাউকে ইম্প্রেস করতে পারিনি। সেই অযোগ্যতার লজ্জায় তাই বলে লেখা ছেড়ে দিয়েছি এমন নয়। মহাপুরুষ বলেছেন দাগ রেখে যেতে। লিখে কোথাও দাগ দিতে পারেনি মধুকর-রিজেক্টেড আমার লেখা সকল।
মধু বলতে মনে পড়ল, এককালে নাকি মানুষেরা মধু খেয়ে নেশা করত। অবশ্য চাকভাঙা মধু খেয়ে নেশা ভালুকেরা এখনও করে। আর করে ডিএল রায়ের অলিরা। তারা ফুলের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে।
এই সে’দিন এক বন্ধু মাতালদের নিয়ে চমৎকার স্মৃতিচারণা শুরু করতেই আমারও স্মৃতিপট রিওয়াইন্ড করে কত না কথা ভেসে উঠল। ফ্ল্যাশব্যাক যথাযথ হবে না। তবু বলি।
একেবারে ছেলেবেলায় মুর্শিদাবাদ-বীরভূম সীমান্তে হিলোরা বলে এক গ্রামে ছিলাম। সে’খানে যা’ চলত তা’ হল তাড়ি। মানে গেঁজে যাওয়া তালের রস।
তালের রসের এ’ এক বিচিত্র ব্যাপার। হাঁড়ির ভেতরে চুন জাতীয় গ্যাঁজানো নিরোধক লাগানো না থাকলে, তালের রস গেঁজে ঝাঁঝালো তাড়িতে পর্যবসিত হয়। মানে হবেই। খেজুর রসের জীবন-ইতিহাসে এই রকমের বেয়াদবি নেই।
সেই অঞ্চলের ইতর ভদ্রজন অনেকেই তাড়ি নামক এই পানীয়ে অভ্যস্ত ছিলেন, যতদূর মনে করতে পারি। কিন্তু টুপভুজঙ্গ হয়ে বিপজ্জনক হতে খুব বেশিজনকে দেখিনি। এক আমিই যা ক্লাস সেভেনে একদা হয়েছিলাম। হেনস্থা হবার সে গল্প শোনাই তবে।
ক্লাস সেভেনে পড়া কালীন হিলোরা বলে সেই গ্রামে এক মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। মাস্টারমশাই পরিমিত পরিমাণ তাড়ি যা কিনা আদতে গেঁজানো তালের রস, সেবন করতেন প্রাইমারি ইশকুল থেকে ফিরে।
তাঁর মেয়েরা আমার সমবয়সী। তাদের কাছে জেনেছিলাম, তাদের বাবা, ইয়ে, ও কিছু না, তালের রস খায় একটু।
সদ্য শিক্ষিত আমার তালের রস সম্বন্ধে জানা ছিল না। কিন্তু খেজুর রস বিষয়ে জ্ঞান ছিল সম্যক। সেই লোভে পড়ে এক বিকেলে মাস্টার মশাইয়ের সেই তালরসামৃত চুরি করে আকণ্ঠ পান করেছিলাম।
সেই তীব্র ঝাঁঝালো, কিঞ্চিৎ বিকর্ষণকারী গন্ধযুক্ত তরল আদৌ খেতে ভালো ছিল না। খেজুর রসের মত মনোহারিণী নয় বলাই বাহুল্য। কিন্তু পান করার পর তার দ্রব্যগুণ যাবে কোথায়? ফলত সেই লোভী চোর বালক সন্ধ্যের মুখে টুপভুজঙ্গ। এবং বমনরত বলে তীব্র দুর্গন্ধে তার চৌর্যবৃত্তির কারণ আবিষ্কৃত হয়েছিল।
যারপরনাই অপমানিতা ক্রুদ্ধ এক মহিলা, যাকে আমি মা বলে জানতাম, তার হাতে গোবেড়েন। ওঃ, এখনও শিউরে উঠি। পাড়া পড়শী চমকিত। শুধু মাস্টারমশাই নাকি বলেছিলেন মাকে,
– আর মেরেন না গো দিদিমণি। পুরুষ বাচ্চা উ সব একটু আধটু না খেলে চলে?
সেই গ্রামে এমনিতে অন্য পানীয়, দিশি বা বিদেশি আমার জ্ঞাতসারে দেখিনি। তবে শুনতাম স্থানীয় কিছু তান্ত্রিকেরা নাকি করোটিতে ওই সব দেশি-বিদেশি কারণবারি ঢেলে পান করতে করতে সাধনা করতেন। সাথে থাকতেন বৈধ অবৈধ ভৈরবীরা। আবার থাকতেনও না। সবই শোনা কথা। খোদ তান্ত্রিক বাড়ির থেকে আসা বা তার আশেপাশে থাকা অভিজ্ঞ সহপাঠীদের রহস্যময় জ্ঞান ভাণ্ডার থেকে টিপিনের আধঘণ্টায় উপচে পড়ত সেই সব আলোআঁধারি গল্পকথা।
আমার পিতাঠাকুর চাকরি করতেন বিডিও আপিসে। তাঁর সহকর্মীরা নিম্নবিত্ত কেরানি। সেই কাকুরা মেসে থাকতেন। কখনও কখনও তাঁরা কেউ কেউ ভেটেরিনারি সার্জনের করুণায় বা তাঁর কম্পাউন্ডারের যোগসাজসে সন্ধ্যে রাত্রের দিকে নিষিদ্ধ উত্তেজনার সঙ্গে ‘স্টিমুল্যান্ট’ পান করতেন। খুবই সামান্য এই আনন্দ বৈচিত্রহীন জীবনে তাঁরা খুঁজে নিতেন সম্ভবত ডিসপেনসারির রেক্টিফায়েড স্পিরিট বা অ্যালকোহল সমৃদ্ধ কিছুর সঙ্গে আর কোনও অনুপান মিশিয়ে। তাঁরা কেউই যাকে বলে রেজিস্টার্ড মাতাল, তা’ ছিলেন না। সে ছিল নির্দোষ এক ধরণের আঁচ পোয়ানোর তাগিদ। হয়তো বা আড্ডার শেষে ঘুমটাও কিঞ্চিৎ তরিবত হত, এই মাত্র।
আমাদের ছেলেবেলায় বাঙালি মধ্যবিত্ত বাড়িতে মদ্যপানের চল ছিল না। বস্তুত সোশ্যাল ড্রিঙ্কিং যা গেরস্থ বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে আজকাল হরবখত চলে বলে শুনি তা’ ছিল না। অন্তত আমাদের মত সেমি-উদ্বাস্তু বাড়িতে কখনওই দেখিনি।
নইলে আমার বাবা কাকা মামা মেসোদের কোনও জমায়েতে সে’ জিনিস চললে আমার এঁচোড়ে পাকা অ্যান্টেনায় নিশ্চয়ই ধরা পড়তো কোনও না কোনও দিন।
ইতিমধ্যে সেই অমল ছেলেবেলা পেরিয়ে গেল।
এর পর হল কী, কাকা মামা মিলিয়ে বেশ ক’জন ডিফেন্সে চাকরি পেলেন। তাঁরা দ্রুত কারণ পানে অভ্যস্ত হয়ে পড়লেন চাকরির প্রসাদগুণে। সে’টা যখন বুঝতে পারলাম তখন আমি হায়ার সেকেন্ডারি।
প্রসঙ্গত বলি, এই ব্যাপারটা আমার বোধগম্য হয় না। এই যে ডিফেন্সের লোকজনকে ফ্রিতে বা অত্যন্ত কম নামমাত্র দামে মদ আর সিগারেট সরবরাহ করা হয়, এতে কি দেশের নিরাপত্তা বাড়ে কোনও ভাবে? এই দু’টো পদার্থই কিন্তু ঘোরতর ‘ইনজুরিয়াস টু হেলথ’ শুধু সিনেমায় নয় বাস্তবেও।
তবে, স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য ব্র্যান্ডি এক চামচ দু’চামচ উষ্ণ দুধের সঙ্গে পান করার বিধান আমার ছেলেবেলায় ছিল। ডাক্তাররাই প্রেসক্রিপশন করতেন।
ইতিমধ্যে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছি। হোস্টেলে থাকি। সময়ের আর নিজেরও মনের শরীর থেকে পুরোনো বোধ খসে পড়ছে। অনেক সিনিয়রের দেখা পেলাম যাঁরা জলপথে যাতায়াতে বেশ পোক্ত, কিন্তু পেঁচো মাতাল নন। তবে বলতেই হবে হোস্টেলে এঁদের সংখ্যা পাঁচ ছয় শতাংশের বেশি কিছুতেই ছিল না। এঁদেরই একজনের রুমে আশ্রিত তথা প্রায় পালিত হতে হতে বুঝলাম টিঁকতে গেলে মদ না খেলেও আসরে যোগদান করতেই হবে, নইলে আশ্রয়দাতা অপমানিত বোধ করবেন। ভালো কথা, এবং অতীব সুখের কথা এই রকম আসরে মদ না খেলে কন্ট্রিবিউট করতে হত না।
সেই থেকে মদের নেশা না হোক, ফ্রিতে চাট খাবার অভ্যেস হয়ে গেল। কত রকম বিচিত্র যে সেই চাট। ঝাল দেওয়া ভেজানো ছোলা শশা বাদাম থেকে শুরু করে, মেটের তরকারি, নাড়িভুঁড়ির ঝোল, খিরা(গরুর কুঁজ, মতান্তরে বাঁট), ফিস ফ্রাই আরও কত রকম প্রাণীর অস্থান কুস্থানের টিস্যুর রান্না। তবে সবটাই হত মশলাদার আর বেশ ঝাল ঝাল।
আমি যে মদ্যপায়ী নই তার অনেক ক’টা যুক্তির মধ্যে একটা হচ্ছে এই চাট। মদ যদি খেতে অত লোভনীয়ই হবে তবে তা’ চাট দিয়ে খেতে হয় কেন? রাবড়ি কিম্বা আলুপোস্তর মত ভালো খাবার কি চাট দিয়ে কেউ খায় কখনও?
মদ বেসিক্যালি সুস্বাদু নয় বলেই ওই সব চাট দিয়ে খায় লোকে। আমি যে রসিক না হয়েও মদ্যপায়ীদের খুবই পছন্দ করি, তারও কারণ ওই চাট। অমদ্যপায়ী চাটপ্রেমীরা মনে মনে বলি ভাগ্যিস ওরা খায়। তা’ না হলে ওই অমৃতোপম চাট পেতাম কোথায়?
দিন যায়। আমাদের সেই সময় মানে আজকালকার সাড়ে চার বছরের পাতি এমবিবিএস নয়। পরীক্ষা পেছুতে পেছুতে সাত বছরের পোক্ত এমবিবিএস। পরিত্যক্ত পুরো সময়টাই যে পড়াশুনো করে পার করিনি বলাই বাহুল্য। কাজেই নেশার উপাচারে বিশেষত সোমরসে অভ্যস্ত হলাম আমাদের অনেকেই।
আমাদের ২১৭ নম্বর বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের মেইন হোস্টেল। মূল বিপিন বিহারি গাঙ্গুলির হাত ছেড়ে হোস্টেলে আসার রাস্তাটা আমাদের সময়ে ছিল শীর্ণ এক গলি। পরপর তিনটি দোকান ছিল সেখানে সেই চল্লিশ বছর আগে। তিনটিই লাইসেন্স প্রাপ্ত আইনি। যদ্দুর মনে পড়ে প্রথমে গাঁজা, পরে আফিম আর তারপরে দেশি মদ। গাঁজা আফিম চলত সন্তর্পণে। অন্ত্যজ নেশা বলেই বোধ হয়। আর হ্যাঁ, ওই দুটোতেই রেশন কার্ড গোছের কিছু একটা লাগত। বাংলা মদের দোকানে নো রেস্ট্রিকশন। খালি দেখে নিত গোঁফ বেরিয়েছে কিনা। তা, সে তখন আমাদের বেরিয়েছে বই কী।
কাজেই এক পুণ্য কালীপূজার দিন আমি আর রণ দুই রুমমেট কাস্টমার হয়ে ঢুকলাম সেই দোকানে। আজ আমাদের হাতে খড়ি তো নয় মুখে মদ হবে। ফিরলাম, বগলে বোতল, দোতলার কোণের ঘরে। হাতে সে কালের তারকা কোল্ড ড্রিংক গোল্ড স্পট। রণ খবর এনেছে, মা কালীর সঙ্গে গোল্ড স্পট পাঞ্চ করলে পুরো বিলিতি।
দুজনে মিলে গোমাংস সহযোগে পুরো বোতল সাফ করলাম। ক্লাসে স্যার বলেছেন, মাংস সহযোগে মদ্যপান না করলে সিরোসিস হয়। যত ভুলভাল নাকি ঠিকঠাক কথা, কে জানে।
ঠিক তিরিশ মিনিটের মাথায় বমি শুরু হল। রণ একটু কম খেয়েছিল বলে ওর কম। আর আমি হাপুশ নয়নে, থুড়ি হাপুশ গলায় বমি করলাম প্রচুর। রণই দেখাশুনো করল আমায়। পরের দিন বলল, শালা খেলি এক বোতল আর বমি করলি দু বালতি। কেসটা কী বলতো?
এখন যেমন ডাক্তার ছেলেমেয়েরা, হ্যাঁ, মেয়েরাও ইন্টার্নশিপ হাউসস্টাফশিপের সময় থেকেই রীতিমতো মদের ব্যাপারে পড়াশুনো করে, নিজেদের আর ইয়ে ওষুধ কোম্পানির পয়সাতেও মদ খায়, হুক্কাবারে গিয়ে গর্বিত ধোঁয়া ছাড়ার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে, আমাদের সেই চল্লিশ বছর আগের জীবনে ব্যাপার বোধহয় এত অ্যাকাডেমিক ছিল না। বোধহয় বললাম, কিঁউ কী,হয় তো ছিল, আমি জানতাম না।
এরপর চাকরি জীবন শুরু হল।
দু একটা ছোট ঘটনা মনে পড়ে। কৃষ্ণগঞ্জ পিএইচসি তে থাকাকালীন, ডিউটি না থাকলে, রাতের দিকে দু আড়াই কিলোমিটার দূরের মাঝদিয়ায় যেতাম। তপনদা মানে এলাকার ডাকসাইটে ডাক্তার তপন সরকারের ওখানে, চেম্বার শেষে তাসের আড্ডায়। অমোঘ আকর্ষণে।
একদিন, ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় নটা। ঝড় বৃষ্টির রাত। বাড়িতে গৃহিণীর ঝাড় খাবার ভয়ে সাইকেলে শোঁ শোঁ করে ফিরছি। ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। হাসপাতালের গেট বড় রাস্তা থেকে কিছুটা ঢালু। স্পিডে ঢোকার মুখে সাইকেল বাম্পারে পড়লে যেমন হয় লাফিয়ে উঠল। কোনও মতে তাল সামলিয়ে হাঁচড়েপাঁচড়ে কোয়ার্টারে পৌঁছোলাম। মাথায় ভাবনা, গেটের ঢালু রাস্তায় তো বাম্পার ছিল না। পরদিন ভোর বেলায় কলবুক খেয়ে হাসপাতালে গিয়ে দেখি কলাবতী তার স্বামী হাসপাতালের স্টাফ ক্যালকেটিয়া ডোমকে ট্রলিতে শুইয়ে রেখেছে। স্বামীরত্নটি দাবী করছে গতকাল রাত্রে সে নেশা করে হাসপাতালের গেটে রাস্তায় এট্টু শুয়েছিল। তখন নাকি বুকের ওপর দিয়ে লরি চলে গেছে। জামায় স্পষ্ট দেখলাম গতকালের আমার দেওয়া সাইকেল-টায়ার চিহ্ন।
এই ক্যালকেটিয়া মদ খেতো বটে কিন্তু ভারি সরল ছিল। তখনকার দিনে গ্রুপ ডি আর সুইপারদের জন্য সরকার থেকে বিনি পয়সায় জামা প্যান্ট শীতের সোয়েটার দেওয়া হত। এখন সম্ভবত মূল্য ধরে দেওয়া হয়। এটাই বলার যে সেগুলোর কোয়ালিটিও একেবারে ফেলনা হত না। ইউনিফর্ম বানানোর জন্যই দেওয়া হত। কিন্তু ইউনিফর্মের রেওয়াজের তোয়াক্কা না করে তাঁরা অপেক্ষাকৃত উঁচু মাইনের চাকুরেদের সেই পোষাকের কাপড় বিক্রি করে দিতেন। ব্যাপারটি দুপক্ষেই লাভজনক হত। সেবার শার্টের পিস এসেছে ভারি মনোরম নীল টেরিকট। এখন যেমন সুতির কাপড় অভিজাত বিবেচিত হয়, তখন পলিয়েস্টার মেশানো টেরিকটের সেই মর্যাদা। ক্যালকেটিয়া তার কাপড়টি নিয়ে আমাকে অ্যাপ্রোচ করল, যদি কিনি। প্রশ্নই ওঠে না। এই আকাশি রঙ আমারও খুব প্রিয়। সেই রঙের শার্ট ছিলও কয়েকটা। কদিন পর সেই শার্টগুলোর একটা পরে আউটডোর করছি, ক্যালকেটিয়া গভীর দুঃখের চোখে পর্যবেক্ষণ করে ব্যাজার গলায় বলল, – সেই নিলেন, কিন্তু আমার থেকে নিলেন না!
মদ নিয়ে প্রতিটি কর্মস্থলেই কিছু গল্প জমেছে।
বলরাম হাসপাতালের সুপার তখন আমি। কোয়ার্টারে থাকি। জয়রাম বাল্মিকী সুইপার। রোজ রাত্রে মদ খেয়ে বউকে পেটায়। অর্ধ উলঙ্গিনী অসহায় মেয়েটা বেদম চেঁচায়। ঘর ছেড়ে রাস্তায় দৌড়োদৌড়ি করে। তাদের দাম্পত্যলীলা চলে রাতভর। পাড়ার মধ্যে হাসপাতাল। সমস্ত এ দেশি সম্ভ্রান্ত মধ্যবিত্ত মানুষের বাস। তাঁরা রাত-বিরেতে এই অনাচারে যৎপরোনাস্তি ক্ষুব্ধ। রাত্রেই কোয়ার্টারে এসে বিহিত করার দাবী জানাতেন তাঁরা। ব্যাপার আমার সাধ্যের বাইরে বললেও মানতেন না। সেই রাত্তিরে, অফিস পিওন রামধনিকে ডেকে অফিস খুলিয়ে দেখাতে হত, গত সপ্তাহেই যে জয়রামের এই সব কাণ্ড জানিয়ে সিএমওএইচকে চিঠি দিয়েছি তার অফিস কপি। এমডিতে চান্স পেয়ে রিলিজড হয়েছি সেই দিনই। সেই প্রতিবেশীরা আবার হানা দিলেন। অভিযোগ একই। ওঃ, সেদিন যা বিজাতীয় আনন্দ যে হয়েছিল। হাত জোর করে যখন বললাম, আজ থেকে রাতে এরম হলে আমি আর না। নতুন সুপার থাকেন বরানগরে। সটান সেখানে যেতে হবে। জয়রামের মদের দায়িত্ব তাঁর।
ওই বলরামে থাকতেই ক্লাসমেট বন্ধু আশু কোয়ার্টারে আমার পাশের ফ্ল্যাটে থাকত। সে পাহাড়ের পোস্টিং ফেরত। এক বর্ষামেদুর বিরহকাতর দিনে তার কোয়ার্টারে গিয়ে দেখি হালকা হলুদ রঙের কী একটা পানীয় গেলাসে ঢেলে চুকচুক করে পান করছে। সঙ্গে অনুপান কল তোলা ছোলা। আমি খুব আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করলাম, – কোত্থেকে জোগাড় করলি? কী ব্র্যান্ড?
আমি এই সব ব্র্যান্ডের তথা মদের শ্রেণী বিভাগের ব্যাপারে নিছকই অজ্ঞ। সত্যি বলতে কি মাঝে মধ্যেই, হ্যাঁ, এখনও ভেবে পাই না রেকটিফায়েড স্পিরিটের সঙ্গে চিনিজল মিশিয়ে ডাইলিউট করলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয় রে বাবা! সেই তো ইথাইল অ্যালকোহল।
তা শুনে জীবিতেন্দ্র দা’, আমার প্রথম এমওআইসি (এখনকার বিএমওএইচ) এক সান্ধ্য আসরে বলেছিলেন, তবে তো চাল ঘি আর মাংস মশলা গোলাপজল মিশিয়ে সেদ্ধ করে খেলেই হয়, বিরিয়ানির আর দরকার কি? আমি প্রতিবাদ করিনি। কেননা সেই মহিলাবর্জিত মদ্যপানের সান্ধ্য নাটকে কুশীলবদের মধ্যে একমাত্র আমি গেলাসবিহীন চাটবিলাসী পার্শ্বনায়ক। প্রয়োজনে হাসপাতালের অন কল এমারজেন্সি সামলাচ্ছি। আসর চলাকালীন মাঝে মাঝে ক্ষৌণীশদা’ ( এমএলএ হয়েছিলেন, পরে খুন হয়ে যান) হুঙ্কার দিচ্ছেন,
– অ্যাই শালা, অরুণাচলটা যে পুরো মাংসটা মেরে দিচ্চে রে! এখনও যে দুটো পাঁইট পুরো বাকি।
এর কিছুদিন বাদেই মঞ্চে মহিলাচরিত্র মানে আমার গিন্নি এসে যাবেন। এই আসর তারপরে আর বসেনি।
ওঃ, কথার ঝোঁকে অন্য খানে এসে পড়েছি। কথা হচ্ছিল তো বলরাম হাসপাতালের মেঘমেদুর দিনের। আমার বন্ধু বিষণ্ণ ভাবে জানাল,
– দুর দূর তোর এই —-( ছাপার অযোগ্য) খড়দা একটা স্ট্যান্ডার্ড জায়গা হল? শালা, কিছু না পেয়ে সাধনা ঔষধালয়ের মহাদ্রাক্ষারিষ্ট গিলছি। তুই তো জানিস, আমি কত অর্থোডক্স। সেই আমি বাধ্য হয়ে, উঃ, ফালতু আদার গন্ধ টলারেট করছি। কর্পোরেট বসন্তসেনার বদলে পাঁচটাকার ক্ষেন্তিরাণী… নাঃ, ভাষা ক্রমশ অ্যাডাল্ট হয়ে যাচ্ছে। রাশ টানি।
দু তিন খানা জাম্পকাট দিয়ে শেষ করি। আসলে তো এই সোমরসের গল্প বিগ ব্যাংএর মতনই অনন্ত প্রবাহী।
জাম্পকাট ওয়ান,
পানিহাটি হাসপাতালের এমারজেন্সিতে নাইট দিচ্ছি। আমি, শিবদা আর দেবু। মাঝরাতে ফেলু এল। হাতে তিনটে বিরিয়ানির প্যাকেট। ফেলু কে? আগে বলে নিই। সে ছিল এক পিডি কোম্পানির প্রতিনিধি। ওঃ, এই পিডি কোম্পানিটা আবার কী? পিডি মানে হচ্ছে প্রোমোশন কাম ডিস্ট্রিবিউশন। গোলমেলে ব্যাপার ছেড়ে সিধে করে বোঝাই।
ফেলুর সাথে ওর কোম্পানির শর্ত ছিল এ’রকম… একলাখ টাকা প্রিন্ট প্রাইসের ওষুধ ও পেত ধরুন ষাট কি পঁয়ষট্টি হাজার টাকায়।এই বার এই চল্লিশ বা পঁয়ত্রিশ হাজার টাকার ওষুধের মধ্যে ও কতটা স্যাম্পলিং করবে বা কতটা বিক্রি করে নিজের সংসার চালাবে নাকি ডাক্তারকে দেবার গিফট কিনবে কিম্বা ডাক্তারকে নগদেই দেবে এ একান্তই তার সিদ্ধান্ত। রাত বারোটা নাগাদ ফেলু হাজির। দু’প্যাকেট বিরিয়ানি প্রায় ছুঁড়ে দিল টেবিলে। -নিন স্যার, খেয়ে নিন। এই ঠাণ্ডা ন্যাতানো চর্বিজমা বিরিয়ানি আমার বাড়ির কুত্তাও ছোঁবে না।
সপ্রশ্ন চোখে তাকাতে বিশদ হল ক্লান্ত ফালু, – অমুক মেডিক্যাল কলেজের ক’টা হাউসস্টাফকে খাওয়াতে হল আজ। শালারা সবাই এমন হুইস্কি টানল, তুমুল বমি। মালগুলো বিরিয়ানি খেতেই পারল না। বেলচা দিয়ে সবগুলোকে ট্যাক্সিতে চাপিয়ে এই ফিরছি স্যার।
এই পেশায় আসার আগে ফালু স্থানীয় সিনেমায় গেট ম্যান ছিল।
জাম্প কাট টু
বড় কোম্পানির স্পনসরশিপে কনফারেন্স চলছে পাঁচতারায়। আমার বন্ধু কর্ণ এসে হাজির শেষ লগ্নে। ককটেল ডিনারের ঠিক আগে আগে। বিশাল প্র্যাকটিশনার। এসেই আমার সঙ্গে সুনন্দাকে দেখে ব্যাঘ্রগর্জন, – কীরে! আজও তুই সাথে পাহারাওয়ালা নিয়ে এসেছিস! আজকেও টানবি না? অসংখ্যবার বলেও ওকে বোঝাতেই পারিনি, আমার অমৃতে অরুচির কারণ, গৃহিণীর পাহারা নয়। বিশুদ্ধ বমি।
জাম্পকাট থ্রি।
পানিহাটি হাসপাতালের সুইপার ভীম। মাইনে যা পায় পুরোটা স্থানীয় শৌণ্ডিকালয়ে জমা করে আসে। ওর বউ এসে কেঁদে পড়ল। আমরা, গার্জিয়ানরা সর্ব সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিলাম মাসান্তে ওর মাইনে ওর হাতে দেওয়া হবে না। দেওয়া হবে ওর বউয়ের হাতে। মাতালটার হাসপাতালের কাজও তো ওই বউটাই করে দেয়। তাই ব্যবস্থাটায় অন্যায়ও কিছু নেই। তার পরেও দেখা গেল ভীম মদ খাচ্ছে যথারীতি। কী ব্যাপার? পয়সা পাচ্ছে কোথায়? রহস্য উন্মোচিত হল মাসের শেষে। বাজারের দু তিন জন মাছওয়ালা মাইনের দিন ওর বউ সাবিত্রীর কাছ থেকে মাইনের প্রায় পুরো টাকাটাই কেড়ে নিয়ে গেছে। ভীম এই মাছওয়ালাদের কাছ থেকে দামী মাছ ধারে কিনে, পাড়ায় নগদ দামে বিক্রি করেছে বাজারের থেকে সস্তায়। আর এই ভাবে চতুর ব্যবসা করে জোগাড় করেছে সন্ধ্যেবেলার শুঁড়ির দোকানের খরচ।
আজকের মত শেষ জাম্পকাট।
সরকারি কাজেই, কর্মস্থল থেকে আশি কিলোমিটার দূরে প্রশাসক আর অন্য কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে গেছি। সেখানেও কিছু তৎপর স্থানীয় সহকর্মী। সবাই মিলে আমাকে কোনও কাজই করতে দিল না। নিজেরাই সামলাল। সবার থেকে আমি কিছু না হক কুড়ি তিরিশ বছরের বড়।
দিনভর কাজের পর ক্লান্তি অপনোদনের জন্য সেই বালক বালিকারা কিছু ব্যবস্থা করেছে। একজন চুপিচুপি এসে বলল, স্যার, অন্যরা তো থেকে যাবে বলছে। আপনাকে নিয়ে গাড়িটা ফেরত যাক?
আমাকে কাটিয়ে দেবার এই জঘন্য উদ্যোগ আমি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলাম। ভাগ্যিস করেছিলাম। না, আমি সেদিনের চাট যদিও অতি উৎকৃষ্ট ছিল সেই কথা বলছি না।
আমি বলছি, সামান্য নেশাতুর হালকা জ্যোৎস্নায় একদল যুবক যুবতীর চেলখোলা নদীতে পা ডুবিয়ে আকাশের তারা গোণার সেই অপূর্ব মুহূর্তগুলির সাক্ষী হতে পেরেছিলাম, সেই সৌভাগ্যের কথা। আর ফিরে এসে তাদেরই একজনের গলায় গান শোনার অপূর্ব অভিজ্ঞতা।
শরদিন্দুর লেখায় জগন্নাথদেবের উল্লেখ আছে দারুব্রহ্ম বলে। সিঞ্চিত সেই অলৌকিক রাতে দারুকে (মদ বললাম না, শুনতে অশ্লীল লাগে) আমার যদি অন্য অর্থে মনে হয় দারুব্রহ্ম, হে পাঠক, বাধা দেবেন না। আমি নিজে হয়তো সেই ব্রহ্মের স্বাদ নিতে অক্ষম। কিন্তু পাহাড়ি হাওয়ায় কুয়াশার মধ্যে ভেসে যাচ্ছিল আমার চেনা ব্রহ্মজ্ঞানীরা।