বেশ কিছুদিন আগে একটি গল্প পড়েছিলাম। জগতের স্বাভাবিক নিয়মে একটি তরুণী একটি তরুণের প্রেমে পড়েছে। কিন্তু মেয়েটির আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কেউই ছেলেটিকে চেনে না। ছেলেটি মানুষ হিসেবে খুব ভালো। প্রেমিকাকে ভালোবাসে, সন্মান করে। কিন্তু সে সোস্যাল মিডিয়া বিমুখ। টুইটার, ইনষ্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ,স্ন্যাপচ্যাট কোথাও সে নেই। এমনকি ফেসবুকেও নয়। স্মার্টফোন সে ব্যবহারই করে না। কিন্তু ফোন করলে তাকে পাওয়া যায়। বান্ধবীর সঙ্গে সে দেখা করে। ডেটিং করে। সেদিক থেকে সে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। কিন্তু মেয়েটির বান্ধবীরা মেয়েটির প্রেমিকের অস্তিত্ব সম্বন্ধেই সন্দিহান। কারণ সোস্যাল মিডিয়াতে তার অস্তিত্ব নেই। কেমন অদ্ভুত না?
সোস্যাল মিডিয়া ও ভার্চুয়াল অস্তিত্ব আজকের যুগে আমাদের জাগতিক অস্তিত্বের প্রায় সমার্থক হয়ে গেছে। অনেকে ভাবেন সোস্যাল মিডিয়া এসে অনেক মানুষের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ স্থাপন করতে আমাদের সাহায্য করেছে। অনেক মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে যোগাযোগ রাখা যাচ্ছে। কথাগুলো ভুল নয়। আর কে না জানে বর্তমান শতক হল তথ্য ও যোগাযোগের শতক। এখন চলুন দেখে নেওয়া যাক, সোস্যাল মিডিয়া আমাদের জ্ঞান, মতামত ও অস্তিত্বকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।
যে কোনো বিষয়ে সোস্যাল মিডিয়াতে আমরা যখন আমাদের মতামত বা অনুভূতি ব্যক্ত করি অথবা সৃষ্টিশীলতা প্রকাশ করি, সোস্যাল মিডিয়া যান্ত্রিকভাবে সেটা খেয়াল রাখে। তারপর অঙ্কের কলনবিধি (Algorithm বা digital algorithm) অনুসারে ওই একই ধরণের মতামত, একই মতাবলম্বী মানুষ বা একই ধরণের সৃষ্টিকে আমাদের কাছে এনে দিতে থাকে। আজকাল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial intelligence) আরো সুচারুভাবে এই কর্মটি করে থাকে। আমরা ক্রমশঃ সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে ওই একই ধরণের মতামত বা সৃষ্টির গোষ্ঠীতে আবদ্ধ হয়ে পড়ি। মুক্ত চিন্তা হারিয়ে যায়।
এই যে চিন্তন গোষ্ঠী বা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী তৈরি হয় তা হয় প্রধানতঃ দুই ধরনের। ১.প্রতিধ্বনিমূলক জ্ঞানকক্ষ (Echo chamber) এবং ২.জ্ঞানের বুদ্বুদ (Epistemetic bubble)
১. প্রতিধ্বনিমূলক জ্ঞানকক্ষ (Echo-chamber): মূলত রাজনৈতিক মতবাদের ক্ষেত্রে এই ধরণের গোষ্ঠিবদ্ধতা বেশী ঘটে থাকে। এ যেন শব্দনিরোধী একটি ঘর যেখানে ঘরের ভেতরের শব্দই ঘরের মধ্যে বার বার প্রতিদ্ধনিত হতে থাকে। বাইরের শব্দ ঘরে ঢুকতে বাধা পায়। সোস্যাল মিডিয়ার চালক ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পর্দার পিছনে বসে আপনাকে কেবল সম-মতের উৎসগুলোই সরবরাহ করতে থাকে। আপনি নিষ্ক্রিয়ভাবে সম-মতের, সম-ধ্যানধারণার জালে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। ফলতঃ আপনি শুধুমাত্র নিজের সম-মতাবলম্বীদের বক্তব্য পড়তে বা শুনতে থাকেন। কীর্তনে ধুয়োধারী বা রাজা-জমিদারদের মোসাহেবদের মত তারা শুধুমাত্র আপনার বক্তব্যই প্রতিধ্বনিত করে। আপনার নিজের বক্তব্য ঠিক না ভুল, সেটা যাচাই করার আর কোনো উপায় থাকে না। এই পরা-সত্যের (post truth) যুগে Echo- chamber এর ভিতরের মানুষেরা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষালব্ধ বা বাস্তবের জমিতে প্রতিফলিত সত্যের বদলে কেবলমাত্র আবেগ ও মস্তিস্কপ্রসূত কল্পনা ও ধ্যানধারণার বশবর্তী হয়ে পড়ে। এভাবেই চাষ হয় গুজব ও মিথ্যা সংবাদের। এছাড়া, এই ধরণের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গ্রুপে প্রশাসক (admin) থাকে। তারা সক্রিয়ভাবে গঠনমূলক বা ধংসাত্মক নির্বিশেষে সমস্ত বিরোধী মতামতকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। সুতরাং মুক্তচিন্তার আর কোনো সুযোগ থাকে না। বহুত্ববাদের ঝর্ণাধারা কালক্রমে শুকিয়ে যায়।
২. জ্ঞানের বুদ্বুদ (epistemetic bubble):
এটি একটি নিস্ক্রিয় গোষ্ঠী। সোস্যাল সিমিয়ার সাংস্কৃতিক জগৎগুলোতে এটি তৈরী হয়। ধরুন আপনি বেড়াতে এবং ছবি তুলতে আগ্রহী। ওই ধরনের গোষ্ঠীতেও আছেন। অথবা আপনি গাড়ি বিষয়ে আগ্রহী। এখন সোস্যাল মিডিয়া কেবল আপনাকে আপনার মনোমত ওই বিষয়ের বন্ধুর সন্ধান আপনাকে খুঁজে দেবে। আপনিও ধীরে ধীরে ওই একই জাতের মানুষের চক্রবূহ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়বেন। একটা সুড়ঙ্গ-দৃষ্টি (tunnel vision) তৈরী হবে আপনার। পৃথিবীতে যে অন্যধরনের মানুষও আছে, তারাও যে বন্ধু, সাথী হতে পারে- সোস্যাল মিডিয়া আপনাকে তা ভুলিয়ে দেবে। অথচ আপনি হয়ত সকালে বাজার করতে গিয়ে মাছওলা, তরকারিওলা, বাসের কন্ডাক্টর, গাড়ির ড্রাইভার, দুপুরে অফিসের সহকর্মী, বিজনেস পার্টনার, সন্তানের শিক্ষক-শিক্ষিকা- ইত্যাদি নানা ধরণের, নানা মতবাদের, নানা অর্থনৈতিক ও সামাজিক শ্রেণীর মানুষের সংস্পর্শে আসেন। সোস্যাল মিডিয়ায় কিন্তু সেরকম হবে না। আপনার গোষ্ঠীর (কোনো নির্দিষ্ট গ্রুপে না থাকলেও) চারদিকে এক অদৃশ্য পর্দা তৈরী হবে। তবে এটা বদ্ধ echo-chamber নয়। তাই বাইরে তাকাতে বাধা নেই। কিন্তু পর্দা তুলে তার বাইরে দেখতে হলে যে উদ্যোগ থাকা দরকার, আজকের ব্যস্ত যুগে বেশীরভাগ মানুষেরই তা থাকে না।
সোস্যাল মিডিয়া যেন ছোটবেলার সেই বায়োস্কোপ। বায়োস্কোপ-ওয়ালা যা দেখায়, বায়োস্কোপের গর্তে চোখ রেখে আমরা শুধু তা-ই দেখতে থাকি। বাইরের পৃথিবীর নয়নাভিরাম দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ে না।
ভালো লেখা।