সম্প্রতি আরজিকর মেডিকেল কলেজের ফরেন্সিক মেডিসিন বিভাগ থেকে কিছু ‘বেওয়ারিশ লাশ’ পাঠানো হয়েছিল সেই হাসপাতালেরই নাক-কান-গলা বিভাগে, যে শবদেহ এসেছিল ফরেন্সিক মেডিসিন বিভাগে পোস্ট-মর্টেম পরীক্ষার জন্য। ওয়ার্কশপে প্রয়োজন পড়েছিল শব-ব্যবচ্ছেদের, সেজন্যই নাকি পোস্ট-মর্টেম পরীক্ষা হওয়ারও আগে লাশ অন্য বিভাগে পাঠানোর তড়িঘড়ি বন্দোবস্ত। যেহেতু ‘বেওয়ারিশ’, সেহেতু শবদেহ অন্য কাজে ব্যবহারের আগে পরিজনের অনুমতি চাওয়ার সুযোগ হয়নি। লাশ সত্যিই বেওয়ারিশ কিনা, সে নিয়ে বিতর্ক চলছে। কিন্তু সে বিতর্ক যদি উড়িয়েও দিই, তাহলেও, এমনকি বেওয়ারিশ লাশের ক্ষেত্রেও এমন করা যায় কিনা, সেও যথেষ্ট প্রশ্নযোগ্য। প্রশ্নটা মেডিকেল এথিক্সের। আর পোস্ট-মর্টেম হতে আসা শবদেহে পোস্ট-মর্টেম করার আগেই অন্য কাটাছেঁড়া করা যায় কিনা, সে প্রশ্ন তো আইনের।
আপাতত এথিক্সের দিক থেকে বিষয়টা দেখা যাক। ডাক্তারি শিক্ষার বিভিন্ন ধাপে শব-ব্যবচ্ছেদের জন্য ‘বেওয়ারিশ লাশ’ ব্যবহৃত হবে কি হবে না, হলে কীভাবে ব্যবহৃত হবে, এ নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক আছে। বলাই বাহুল্য, ব্যবচ্ছেদের জন্য মরণোত্তর দেহদান হিসেবে পাওয়া শবদেহ-ই সবচাইতে বিতর্কহীন। তবে উন্নত দেশেও ডাক্তারি ছাত্রছাত্রীদের পঠনপাঠনের জন্য ব্যবহৃত শবদেহের কমবেশি চল্লিশ শতাংশ আসে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে (unclaimed body), আর আমাদের এখানে, যেখানে দেহদান আন্দোলন একেবারেই টিমটিম করে চলছে, সেখানে তো কথা-ই নেই। কিন্তু বেওয়ারিশ শবদেহ ব্যবচ্ছেদের কাজে ব্যবহারের বিরুদ্ধে মেডিকেল এথিক্সের দিক থেকে বিভিন্ন যুক্তি আছে, যাদের মধ্যে দুখানি প্রশ্ন প্রধান।
প্রথম প্রশ্ন, ‘বেওয়ারিশ’ শব্দটির যাথার্থ্য ও তৎসংলগ্ন ন্যায্যতা নিয়ে। বেওয়ারিশ – কিন্তু ওয়ারিশ খোঁজার কতখানি চেষ্টার পর বেওয়ারিশ ঘোষিত হলো? বিদেশের তথ্য অনুসারে, তথাকথিত বেওয়ারিশ লাশের অধিকাংশই জীবিতাবস্থায় সমাজের প্রান্তিক শ্রেণীর – আর্থসামাজিক কাঠামোর একেবারে নীচের সারিতে বাস যাঁদের, বা সংখ্যালঘু শ্রেণীভুক্ত – এদেশেও পরিস্থিতি একই। সেক্ষেত্রে, ব্যবচ্ছেদের জন্য শবদেহের চাহিদা থাকলে প্রান্তিক মানুষের মৃতদেহ চটজলদি বেওয়ারিশ বলে দাগিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বাড়বে – এবং এমন অনেক ঘটনা ঘটবে, যেখানে পরিজন দেরিতে খবর পেয়ে মৃতদেহের দায়িত্ব নিতে এসে দেখবেন প্রিয়জনের শবদেহ ‘ব্যবহৃত’ হয়ে গিয়েছে। এ কোনও কষ্টকল্পনা নয়, বিদেশে এমন বহু ঘটনা ডকুমেন্টেড আছে – তৃতীয় বিশ্বে ডকুমেন্টেশন নড়বড়ে, ফারাক এটুকুই।
দ্বিতীয় প্রশ্নটি মৃতদেহের সম্মান নিয়ে। মরে যাওয়া মাত্র দেহটি নির্জীব পদার্থে পরিণত হয় এবং শবদেহের প্রতি আচরণ পূর্ব-জীবিত মানুষটির সম্মান-অসম্মানের সঙ্গে সম্পর্কহীন, এমন ভাবনা অবান্তর। সেক্ষেত্রে শবদেহ ঘিরে খ্যাতিমান ব্যক্তিকে ‘শেষ শ্রদ্ধা’ জানানো বা গান স্যাল্যুট ইত্যাদি প্রশ্নও উড়িয়ে দিতে হয়। এটুকু মেনে নিতেই হবে যে, মৃতদেহ নির্জীব হলেও, তার সম্মান আছে এবং মৃতদেহের যেহেতু ইচ্ছে-অনিচ্ছে নেই, জীবদ্দশায় মানুষটির ইচ্ছে-অনিচ্ছে অনুসারে সেই মৃতদেহের প্রতি আচরণ নির্দিষ্ট হওয়া উচিত। কোনও ব্যক্তির সেই ইচ্ছে-অনিচ্ছে যদি জানার উপায় না থাকে – তাহলে সেই মৃতদেহ চিকিৎসাশিক্ষার কল্যাণে ব্যবহৃত হোক, এমন ইচ্ছাই থাকা উচিত ছিল, একথা ধরে নেওয়ার যুক্তিগ্রাহ্য কারণ কিছু নেই। গর্ভাবস্থায় ভ্রূণ সম্পূর্ণ ‘মানুষ’ নয় – অর্থাৎ তার ‘পার্সনহুড’ নেই – গর্ভপাত যে মানুষ খুন নয়, তার পক্ষে এটি মস্তবড় যুক্তি। ভ্রূণের ইচ্ছে-অনিচ্ছের প্রশ্ন নেই, তবু গর্ভপাতের পর ভ্রূণটিকে নিয়ে যা-খুশী করার অধিকার কারও নেই। এমনকি গবেষণার কাজেও ভ্রূণ ব্যবহার করতে হলে রীতিমতো জটিল নিয়মের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। বেওয়ারিশ লাশের ক্ষেত্রেও তো ব্যাপারটা একই হওয়া উচিত। আর পাঁচটা শবদেহের সঙ্গে তার তফাত বলতে, জীবদ্দশায় মানুষটার ইচ্ছে-অনিচ্ছে জানা হয়ে ওঠেনি বা তাঁর ইচ্ছে-অনিচ্ছে যিনি গুছিয়ে জানেন, এমন অছি পাওয়া যায়নি। শবদেহের ইচ্ছে-অনিচ্ছে নেই এবং জীবিত-অবস্থায় তাঁর ইচ্ছে-অনিচ্ছে জানা যায়নি – স্রেফ সেকারণেই সেই শবদেহ অনায়াসে শব-ব্যবচ্ছেদের জন্য ব্যবহৃত হতে পারবে, এ যুক্তি অনুচিত!
এই দুই তর্কের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিতর্ক অবশ্যই রয়েছে। বাস্তব পরিস্থিতির বিচারেও, যেদেশে মরণোত্তর দেহদান সংখ্যায় এমন কম, সে দেশে বেওয়ারিশ লাশ ব্যবচ্ছেদের কাজে ব্যবহার করা না গেলে ডাক্তারি পঠনপাঠনে বড়সড় সমস্যার সম্ভাবনা। অতএব, এই দুই প্রশ্নের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত হওয়া মুশকিল। কিন্তু প্রশ্নগুলো একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো, এমন কথাও বলতে পারি না। কেননা, আগেই বলেছি, প্রশ্নগুলো মেডিকেল এথিক্সের গভীরতর বিতর্কের অন্তর্গত, এককথায় হ্যাঁ-বা-না দিয়ে যে তর্কের উত্তর হয় না।
আরজিকর মেডিকেল কলেজের ঘটনার ক্ষেত্রে এই সংশয়ের জায়গাগুলো যথেষ্ট তলিয়ে ভাবা হয়েছে কিনা, বাইরে থেকে বলা মুশকিল। তবে যেকোনও মেডিকেল কলেজের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সেখানকার এথিক্স কমিটি, যাঁদের দায়িত্ব ডাক্তারি পঠনপাঠন বা গবেষণার ক্ষেত্রে এথিক্সের দিকটি লঙ্ঘিত যাতে না হয়, সেদিকে নজর রাখা। যে কমিটিতে কলেজের প্রশাসক ও বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসক-অধ্যাপক বাদ দিয়েও সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষের উপস্থিতি জরুরি। আর রাজ্যের মেডিকেল কাউন্সিল তো আছেই, যে কাউন্সিলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ, ডাক্তারির বিভিন্ন ধাপে চিকিৎসাবিজ্ঞানের নৈতিকতা ও নিয়মনিষ্ঠা যে রক্ষিত হচ্ছে, তা নিশ্চিত করা। এই শহরের একটি ঐতিহ্যশালী মেডিকেল কলেজে এমন ঘটনা এত অনায়াসে ঘটতে পারা নিয়ে কর্তৃপক্ষের তরফে দুরকম প্রতিক্রিয়াই পাওয়া গিয়েছে। একদিকে, দোষারোপ, চাপানউতোর – আরেকদিকে মুখে কুলুপ আঁটা এবং কারও কারও তরফে বিষয়টিকে গুরুত্বহীন বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা।
কিন্তু বিষয়টি নিয়ে যাঁদের সত্যিই ভাবতে বসা জরুরি। ভাবার দায়িত্ব যাঁদের আরও বেশি করে, অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট মেডিকেল কলেজের এথিক্স কমিটি ও রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিল – তাঁরা কী ভাবছেন, এখনও স্পষ্ট নয়। এ বিষয়ে তাঁদের মতামত ও ভূমিকা কী দাঁড়ায়, তা দেখতেই সাগ্রহে অপেক্ষা করছি।
পুনঃ- সংশ্লিষ্ট মেডিকেল কলেজের ফরেন্সিক মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান, যিনি এই অনিয়ম প্রকাশ্যে এনেছিলেন, তিনি আচমকা বদলি হয়ে গেলেন। রুটিন বদলি, সম্ভবত।