একরকম নিয়ম হয়েই গিয়েছিল। প্রতি শুক্রবার শেয়ালদা থেকে ভোরের কাঞ্চনজঙ্ঘা ধরে বর্ধমান, আবার শনি বা রবিবারের ফিরতি শান্তিনিকিতেন ধরে হাওড়া!
সেদিন একটু আলাদা! ৪ আগস্ট, শুক্রবার। ২০০৬।
বর্ধমানে গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গেছি সকাল সকাল। সেদিনই আমাকে কলকাতায় ফিরতে হবে!
পরদিন ভোরবেলা আবার হায়দ্রাবাদ যাওয়া যে!
টেলিফোন কোম্পানি বাড়িতে ইন্টারনেটের কানেকশন দিয়েছে। সেই তার দিয়ে ডায়াল আপ কানেকশন! মোডেমে লেখা আছে বটে ছাপ্পান্ন kbps কিন্তু তিরিশ-চল্লিশ kbps হলেই বর্তে যাই!
আমি নিচের ঘরে বিছানায় ল্যাপটপের ওপর উপুড় হয়ে নেটের স্পিড পরখ করছি। আর শেষ মুহূর্তের কাজ গুলো ঝালিয়ে নিচ্ছি! আমি আমাদের ত্বক বিশেষজ্ঞ সমিতির জাতীয় সাধারণ সম্পাদক।
হায়দ্রাবাদে সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির মহাবৈঠক যেখানে জাতীয় কর্মসমিতি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা ছাড়াও প্রবীণ প্রাক্তন জাতীয় সভাপতি, প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক, প্রাক্তন কোষাধ্যক্ষরাও আসবেন। আর থাকবেন প্রতিটি রাজ্য শাখার সভাপতি-সম্পাদকরাও।
জাতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রধান উদ্যোক্তা আমিই, আমারই আমন্ত্রণে আসছেন অভ্যাগতরা!
উদ্বোধন হবে সমিতির ওয়েবসাইট, উন্মোচিত হবে সমিতির সংবিধান, সংবাদ পত্রিকা বা নিউজ লেটার, পেশ করা হবে কার্যবিবৃতি। এই সব কিছু আমার ল্যাপটপেই!
বাবা এলেন একতলায় আমার কাছে। হাতে এই ট্রেনের টিকিটটা, পরের সপ্তাহের ফেরার টিকিট। এটাই প্রতি সপ্তাহের নিয়ম।
প্রতি সপ্তাহের ফেরার টিকিটটা বাবা কাটিয়ে রাখতেন আর আমি বর্ধমানে গেলে পরদিনের ফেরার টিকিটটা আমাকে দিয়ে দিতেন। একটা ডায়েরিতে নিজে হাতে আবার লিখে রাখতেন হিসেবটা।
তখন বর্ধমান-হাওড়া শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসের এসি চেয়ারকার টিকিটের দাম ছিল ১৯৭ টাকা
আমি দু তিন সপ্তাহ পর পর ধার শোধ করে দিতাম। সে সপ্তাহেও তাই করলাম।
বাবা-মা সেদিন শান্তিনিকেতন যাচ্ছিলেন। টিকিটটা নেবার সময় লক্ষ্য করলাম বাবার গায়ের রংটা একটু বেশীই যেন উজ্জ্বল দেখাচ্ছে! এমনিতেই গৌরবর্ণ, একটু হলদেটে। কিন্তু সেদিন যেন আরো ফর্সা লাগছিলো।প্রায় জ্যোতি বেরোচ্ছে!
-হিমোগ্লোবিন ঠিক আছে তো ?
-করলাম তো গত সপ্তাহে, ঠিকই আছে। ইঞ্জেকশনটাও চলছে।
বাবা মা শান্তিনিকেতন চলে গেলেন, বিকেলে আমিও ফিরে গেলাম কলকাতায়। সঙ্গে বাবার দেওয়া সেই ফেরার টিকিট।
ভোর রাতে শান্তিনিকেতন থেকে মায়ের ফোন, হাঁপানির কষ্ট হচ্ছে বাবার। একটু অ্যাস্থম্যাটিক অবশ্যই! কিছু কিছু খাবারে সমস্যা হয়! সেরকম কিছু হবে হয়ত!
জিজ্ঞেস করে বুঝলাম, বুকে পিঠে কোনো যন্ত্রণা নেই। শুধু নিঃশ্বাসের কষ্ট। গতকাল রাতে শুনেছিলাম চেম্বার থেকেই ডান হাতের কবজিতে একটা ব্যথা হচ্ছে। কিন্তু পেশাদারী দায়বদ্ধতা থেকে কাউকে ফিরিয়ে দেন নি। সবাইকে দেখেই বাড়ি ফিরেছেন।
কফি খেতে বললাম। আর একটা ডেরিফাইলিন। বোন ভগ্নীপতি (মুমু-দেবাশিস)-কে ভোরবেলায় ফোন করে পরিস্থিতি আলোচনা করে রওনা হলাম হায়দ্রাবাদ। সর্বভারতীয় সম্মেলন, সব দায়িত্ব আমার!
এয়ারপোর্ট থেকে স্থানীয় চিকিৎসকের সঙ্গে কথা হল। প্রেশার নর্মাল, তবে শ্বাসকষ্টটা আছে।
মাকে ঘিরে চুয়াদি-কেতন আর আমাদের পড়শিরা। মুমু-দেবাশিস ততক্ষণে শান্তিনিকেতনের পথে।
হায়দ্রাবাদ পৌঁছে, শুনলাম বাবাকে সিয়ান হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আর দেবাশিস-মুমু অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে কলকাতা নিয়ে যাচ্ছে।
হায়দ্রাবাদ এয়ারপোর্টে পৌঁছেই ফেরার টিকিটের ব্যবস্থা করে নিলাম ।
আমার অ্যাপোলোতে বলাই ছিল, মুমুও বলে রেখেছে ওর কর্মস্থল সিএমআরআই-তে।
হোটেলের ঘরে বসে জাতীয় কোষাধ্যক্ষ, আমার শিক্ষক এবং বাবার একসময়ের সহকর্মী ডাঃ অরিজিৎ কুন্ডুকে সব ফাইল ট্রান্সফার করে পরের দিনের সম্মেলনের সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলাম। জাতীয় সভাপতি ডাঃ সুরেশ যোশীপুরাকে জানালাম এই আপদকালীন পরিস্থিতি কথা!
অভাবনীয় আর অভূতপূর্ব অবস্থা! সমিতির কেন্দ্রীয় সম্মেলনের প্রধান আয়োজক ও আহ্বায়ককে হঠাৎ ফিরে যেতে হচ্ছে! কেউই বুঝতে পারছেন না কি করে সম্পন্ন হবে সেই মহাযজ্ঞ!
ডাঃ কুন্ডু শান্তভাবে সাহস দিলেন।
আমি হোটেল থেকে ফের এয়ারপোর্ট যাবার গাড়িতে উঠতে যাব, দেবাশিসের ফোনটা এলো।
মোবাইলে ওর নামটা ভেসে উঠতেই আমি বুঝতে পারছিলাম, ঠিক কী খবর শুনবো! ঘড়িতে তখন ঠিক তিনটে বেজে কুড়ি মিনিট। ৫ আগস্ট। ২০০৬।
কিছু কিছু অনুপস্থিতির একটা স্থিতিও থাকে।
বাবার দেওয়া সেই ফেরার টিকিটটা আজও আমার কাছেই থাকে, যেখানেই যাই।
পিছুটানগুলো যতই নিরাশ্রয় হয়ে আসুক, ফিরতে হবে যে!
তোমার লেখার কোনও তুলনা হয় না I