উঁচু নিচু লালমাটির ঢেউ ঢেউ জমি পেরিয়ে বসন্তের শিমুলবন। পলাশ, শাল। সবাই পাতা ঝরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শিমুল, পলাশ সবাই মিলে দিগন্ত আর সূর্যাস্তের আকাশটাকে আরও লালচে কমলা করে রেখেছে। শিপ্রা ধীর পায়ে জঙ্গলের দিকে চলে। শীতের বাতাসে গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নেয়। কপালের সিঁদুর, আকাশের রং আর পলাশ সব মিলে যায়। ভারী ভালো লাগে। শরীরের ভেতরে অন্য শরীরের স্পন্দন বোঝা যায়।
গঙ্গাজলহাটির প্রাথমিক স্কুলের তখন সদ্য-নিযুক্ত শিক্ষক। ঘুরে নতুন পাওয়া কোয়ার্টারের দিকে তাকিয়ে দেখে উঁচু তালগাছটার পাশে এক তারা উঁকি দিচ্ছে। ট্টি দিয়ে যা। মনে মনে বলে আর গালে পড়া ঝুরো চুলের মধ্যে একটু হাসি ফুটে ওঠে। ইস্কুলের শান্তি ফিরছিলো। “দিদি যাও, দি’নি এ্যাকন ঘরে যাও, সাঁঝের বেলা এই সময়টাতে ঘুরতে নেই”।
শিপ্রা আজ আবার চলেছে সেই শিমুল গাছটার কাছে। ঝরা পাতায় শব্দ করে – রাঙামাটি ঢেউ পেরিয়ে পেরিয়ে – শুকনো বুনো ঝোরার পাশ দিয়ে। শীতবাতাস ঝরা পাতাদের নিয়ে খেলা করে। খড়খড় শব্দ ওঠে। ধুপ ধাপ শব্দে বড়ো বড়ো শিমুল ফুল ঝরে পড়ে। এখন আকাশ জোড়া ফুলের ফাঁক দিয়ে দিয়ে নীলচে কমলা আকাশের উঁকি। সেই শিমুল গাছটার গোড়া পাতায় ফুলে ভরে আছে। শিপ্রা হাঁটু মুড়ে বসে ফুল পাতার আসন সরিয়ে কাঁকুড়ে লাল মাটি বার করে আলতো মাটির বুকে করে হাত বুলিয়ে দেয়।
এই দূরতম গ্রামে একটা মাত্র স্বাস্থ্য কেন্দ্র । ওর সন্তান সুন্দরের সেই শীত থেকে জ্বর–কাশি– এক বছরের তখন– গোলাপ কুঁড়ির মতো ফুলো ফুলো ঠোঁট দুটো নীলচে হয়ে এসেছে। আগামী কাল ভোরে বাঁকুড়া শহরে বড়ো হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
সকালে সবাই মিলে শিপ্রার সুন্দরকে এই শিমুল গাছের গোড়ায় রেখে চলে যায়। শিপ্রা শিমুলকে বলে, ‘হে গাছ, দেখে রেখো আমার সুন্দরকে।’ তারপর থেকে শিপ্রা আর কোনোদিন – কোনদিন দোল খেলে নি । ওর সব রং শিমুলের জিম্মায় রেখে নিশ্চিন্তে ছাত্রদের পড়িয়ে গেছে । যখন সন্ধ্যা এসে দিগন্ত গাছ সব কালো করে দিচ্ছে । তখন শিপ্রা গাছটাকে একটু আদর করে ফিরে চললো । শিমুল বনের পরে কড়াইশুঁটি আর শর্ষে ফুলের ক্ষেত । কোয়ার্টারের দিকে তাকাতেই দেখে এক আকাশ ভর্তি তারার মেলা । শিপ্রা অস্ফুটে বলে এর মধ্যে একটি তারা কেবলমাত্র আমার । আমার । ভোলা ফিরছিলো কোথা থেকে কে জানে । বললো “ অ দি’মণি ঘরে যাও কেনে – সাঁঝ লেগ্যে গেছে গ্য হিম পড়ছে “ শিপ্রার বড়ো ভালো লাগে । ঘরে এসে ঠান্ডা জলে শ্যাম্পু করে – ঘসে ঘসে সিঁদুর তোলে । শাঁখা পলা ভাঙে । নোয়া খোলে । আর তো দরকার নেই । এতদিন সুন্দরের সম্মানের জন্য পরে ছিলো । নাকি নিজের নারীত্বের সম্মান রাখতে ? তারপর এসে বারান্দায় বসে । ওদের স্কুলের জুনিয়র টিচার সোমা আসে । এসে শিপ্রার নতুন রূপে স্তব্ধ হয়ে যায় । “ দিদি ? ” শিপ্রা ওর নিজস্ব সুন্দর তারাটির দিকে তাকিয়ে থাকে । ওর কুমারী রূপে সোমা আশ্চর্য হয়েছে । “ বড়দি – সারাটা জীবন তো এখানেই কাটালে – এখন আমাদের ছেড়ে কোথায় যাবে একা একা ?” শিপ্রা হাসে । উত্তর দেয় না । ঐ তারাটি তো ওর সঙ্গেই থাকবে । সোমা ভেতরে যায় । চা করে একটা লন্ঠন জ্বেলে বারান্দায় আসে । লন্ঠনের আলোয় শিপ্রার চুল ফাঁকা হয়ে আসা জায়গাগুলো চকচক করে ওঠে । চা’টা রেখে বলে “ বড়দি আমাদের একটা জমি আছে – আপনি কোথায় যাবেন আমাদের ছেড়ে ? একটা ছোট্ট বাড়ি.. আমরা সবাই মিলে.. বেশ হবে দিদি … “ শিপ্রা চায়ে চুমুক দেন । চানের পর চা’টা দরকার ছিলো । “ আমি আমার বাপের বাড়ি থেকে যেমনটি এসেছিলাম – ওখানেই … যাবো “ । তাই তো সিঁদুর মোছার খেলা । “ কাল ভোরবেলা চলে যাবো ” যে সময়টায় আমার সুন্দরকে দিয়ে এসেছিলাম বুড়ো শিমুলের জিম্মায় । “ না হলে সবাইকার সামনে দিয়ে আমি যেতে পারবো না ” শিপ্রার হনু ওঠা কোঁচকানো মুখে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে “ এখানেই তো আমার সব ভালবাসা রেখে গেলাম রে ”