আমরা সবাই হ্যাংলা
আমাদেরি ফেবুর রাজত্বে।
নইলে মোরা জুকের বাগে
লাইকাবো কী শর্তে।
ফেসবুক বুঝিয়ে দিচ্ছে আদতে আমরা কতখানি হ্যাংলা। আমাদের এক একজনের অনেক অনেক পার্থিব অপার্থিব সবরকম সম্পদ থাকলেও, আমরা ভেতরে ভেতরে কিন্তু আস্ত ভিখারী এক একজন। ‘পছন্দ’র ভিখারী।
ব্যাপারটা বেশ মজার। আমি সাধারণত একটা পোস্ট দিয়ে মনে মনে ভাবছি এটা হয়তো ১০০টা লাইক আর গোটা পঞ্চাশ কমেন্ট পেয়ে যাবে। সেই পঞ্চাশটা কমেন্টের মধ্যে হয়তো আমার নিজেরই পঁচিশটা! তাও সই। ঠিক হ্যায়। চলেগা।
কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে পোস্টানোর পরে ‘বয়কট লাল সিং চাড্ডা’ ট্রেণ্ডিং দেখলে, ব্যাস, মুখ কেরোসিন। কিন্তু ২০০ লাইক পেরোলে নিজের লেখা নিজেই আবার পড়ি। আর পিঠ চাপড়াই। পিঠে হাতটা ঠিকঠাক পৌঁছায়না, কারণ হাতগুলো ভেঙেছিল এককালে, সেই ফার্স্ট ইয়ারে তখন, সেগুলো বেঁকেই জুড়েছে। তখন এখানে অর্থোপেডিকে স্ক্রু পেরেক ঠোকাঠুকি শুরু হয়নি। ধনুকের মতো কিছুটা বাঁকা বলে মানুষের পেটে হাত ঢোকানো আমার নাকি সহজ কাজ। লোকে বলে। আমি না।
যাক, যেটা বলছিলাম, লাইক কমেন্ট নিয়ে গর্ব, অহংকার আর কাদা ছোঁড়াছুঁড়িও চলে এখানে। সেদিনই চোখে পড়েছে। লোকজন যা তা রকমের ছড়িয়েছে সেখানে। এই ছড়িয়েছে কথাটার একটা ভালো প্রয়োগ পরে বলবো।
ব্যক্তিজীবনে প্রচণ্ড সফল মানুষও ফেসবুকে সামান্য লাইক পাওয়ার আশায় এমন সব লোককে ফ্রেণ্ডলিস্টে রেখেছে, দেখে খানিক অবাক হই। বাস্তব জীবনে লিস্টে থাকা সেই মানুষগুলি হয়তো সেই সফল মানুষটির কর্মক্ষেত্রের ঘরটিতে জীবনেও ঢুকবার অনুমতি আদায় করতে পারবেনা। অথচ এখানে কে যে কার কাছে ভিখারী, সেটা বুঝিয়ে দেয় এই ফেসবুক।
দোষ দেওয়া যায়না। আদতে মানুষের প্রকৃত বন্ধু কিন্তু হাতে গোনা হয়। যারা তাদের পিতৃদেবের বন্ধুসংসর্গ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল, তারা দেখেছে, বাপের গুটিকয় বন্ধু রয়েছে, যারা সবকিছুতেই আছে। আমার বাবারও এইরকম জনাকয়েক ছিল, তারা বাড়ির তৈরির সময় ইঁটভাটায় দৌড়ানো থেকে নতুন গাঁথুনিতে জল ঢালা, দাদার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা সবেতেই ছিল। আমার বাড়ি তৈরির সময়েও এরকম দুজন ছিল এবং আছে, লোকজন বলতো মেড়ো মোল্লা আর বাঙালের কম্বো, দেখে হাসতো। কিন্তু সম্পর্কটা আছে। আমার সেই জৈন দাদা কাম বন্ধু কীরকম বন্ধু সেটা বলবার লোভ সামলাতে পারছিনা।
বলে ফেলি।
তখনো সিনেমা দেখার বাতিক অবশিষ্ট ছিল কিছুটা। তিন চার ঘন্টা সময় নষ্ট করবার মতো দম ছিল। তা একদিন তাকে বললাম, চলো রাধামণি যাবো। শ্যামাশ্রীতে ঋতুপর্ণ’র ঊনিশে এপ্রিল দেখবো।
তার বুলেট বাইকের পেছনে চেপে চলে গেলাম। পুরো সিনেমাটা সে পাশে কেতরে বসে নাক ডেকে কাটালো, আমার উনিশে এপ্রিলকে সাড়ে বত্রিশে ডিসেম্বর বানিয়ে ছাড়লো।। হল থেকে বেরিয়ে বললাম, তুমি যদি নাকটাই ডেকে যাবে সারাক্ষণ, তো এলে কেন? সে বললো, বাংলা সিনেমা আমি দেখিনি, তবু তুমি আসতে বললে, আমি কি না বলতে পারি?
কিন্তু ফেসবুকে আমরা বন্ধুকাঙাল। আরো চাই, আরো চাই।
আবার, যাদের লেখায় প্রচুর প্রচুর লাইক, প্রচুর প্রচুর কমেন্ট শেয়ার, তারা আবার কৃপণ প্রকৃতির। তারা অন্যের লেখালিখি খুব একটা পড়ে কি? পড়লেও হাতের আঙ্গুলটা, মানে finger tip, ইউজ করতে কার্পণ্য করে। শুনেছি মৃত্যুর পরে ধনী কৃপণের শাস্তি হবে সবচেয়ে কড়া। তবে যেহেতু বিভিন্ন ধর্মে শাস্তির ধারাও বিভিন্ন, সেখানে অভিন্ন বিধি লাগু হবে কি হবেনা, জাস্ট জানিনা। তাই ভেবে রেখেছি, বেশি ধনী হয়ে কাজ নেই। বিগত বারো বছর ধরে তাই আমি সাড়ে তিন হাজারের কাছাকাছি গণ্ডীতেই আবদ্ধ আছি। তার মধ্যে পাঁচ সাতশো হাজারের ছোঁয়া পাই, বাকিরা কোথায় থাকে, জানিনা। এই সাড়েতিন হাজারের সবার পাঁচিলেতো আমি নিজেও চড়িনা কাজ কম্মো শিকেয় তুলে, তাহলে? কথায় আছে, অন্যের দিকে একটা আঙুল তুলে দেখালে বাকি চারটে আঙুল কিন্তু নিজের দিকে পয়েন্ট আউট করে। তাই, থাকুক, যে যার মতো ভালো থাকুক। যারা নিজের পাঁচিল না ভরিয়ে অন্যের দেওয়ালে আঁক কাটে, এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়, তারা সত্যিই সজ্জন। নমস্য। আমাদের বেশিরভাগ স্ট্যাটাসহোল্ডারদের মতো কাঙাল নয়। তারা এপাড়া ওপাড়াবেড়ুনি। বাস্তব জগতে এপাড়া ওপাড়া বেড়ু করে সময় কাটানো পাবলিক নিন্দ্যনীয় হলেও ফেসবুকে বন্ধুলিস্টে তারা কিন্তু অ্যাসেট। (কেউ খচে গেল নাকি?)
হিন্দিতে বলে পড়িলিখি আদমী। বাংলায় বলে লেখাপড়া জানা লোক। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে কার কোনটা প্রেফারেন্স। আমরা এত লিখতে ব্যস্ত, তাই ‘পড়া’টা পেছনে আছে।
সত্যি বলতে, আমার নিজেকেও বেশ কাঙাল টাইপের ভিখারী আর ছোটলোক মনে হয়। আত্’মোবিশ্লেষণ আর কি। তার সাথে যোগ হবে কুঁড়ে। মানে, ভার্চুয়ালি লেজি। এই লেজি কিন্তু বাংলা শব্দ। ফেসবুকে লেজ গজালেই লেজি। এটা আমার ভাবনা। যে কেউ ধার নিতে পারে এই অর্থটা। শোধ দিতে হবেনা, এতটাই ধারালো। অর্থাৎ যে ধার আলো ছড়ায়। ছড়ানো কথাটা এসে গেল। আমরা মেডিক্যাল ছাত্রজীবনে বলতাম Oralটা একেবারে ছড়িয়ে মাখামাখি করে এসেছি। তার মানে পুরো ঝুলিয়ে দিয়েছি।
একটা ঘটনা বলি।
বেশ বুঝছি, পড়তে পড়তে, কেউ কেউ ইতিমধ্যে কেটে পড়েছে। (( মানে, যারা এখনো এই ভাট বকোয়াস পড়ে চলেছে)), পাবলিক বোর হচ্ছে। তবুও বলি, ক্লাসিক ছড়ানো কাকে বলে। লেখা দিয়েও এন্টারটেন করতে হয়। নইলে পাঠক ধরে রাখা মুশকিল।
তখন MD পড়ছি, কম্পিউটার প্রিন্টার তখনো ভবিষ্যতের গর্ভে, সাইক্লোস্টাইল আর টাইপরাইটারের জমানা, ডেজার্টেশন জমা দেওয়ার চাপে আছি, কম করে দেড়শো পাতার লেখা টাইপ করাতে হবে, ল্যান্সডাঊন আর্ট স্টুডিও থেকে টিস্যু স্লাইডের ছবি বার করতে হবে, সেই চিন্তায় পাগল, কী খেয়ালে গরীবের ছেলে সরকারি চাকরি করবো বলে ভবানী ভবনে PSC interview দিতে চলে গেছি, সেখানে জিগেস করে বসলো, গ্রামে ডাক্তারি করতে গেছো, কুকুর কামড়ালে প্রথমেই কী করবে?
কী মুস্কিল, শিখছি ছুরি কাঁচি, ধরাচ্ছে কুকুর! ডগবাইট পড়েছিলাম সেই থার্ড ইয়ারে, সাত বছর আগে। ভুলে মেরে দিয়েছি এতদিনে। বলে বসলাম, কোথায়?
বিরক্তি নিয়ে বললো, তোমার রুগীর মাথায়।
মহা ঝামেলায় পড়লাম। আজকাল কুকুরের মুখটা কি লোকজনের মাথা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে? নাকি লোকজনের মাথাটা কুকুরের মুখ অবধি? ডাক্তারকে বিপদে ফেলার জন্য? ভাবলাম দড়িটা বাঁধবো কোথায়? গলায় নাকি? বলেই ফেললাম, মাথায় দড়িটা বাঁধবো কোথায়?
একেই বলে ছড়িয়ে মাখামাখি।
বলা বাহুল্য প্রথম তিন লিস্টে আমার নামই ছিলনা। চতুর্থ লিস্টে ছিল। তার মানে আগের তালিকার পাবলিকগুলো জয়েন করেইনি, বাধ্য হয়ে এই খাজাটাকেও ডেকেছে শেষে।
আসলে, কুকুরে কামড়ালে সেই ক্ষতস্থানটা বার বার জল দিয়ে ধুতে হয় প্রথমে। সেটাই শুনতে চেয়েছিলে। আর আমি ‘বিসি’রাই বাইটের গোলমাল করেছি। কুকুরবাইটকে স্নেকবাইট বানিয়েছিলাম। তাই দড়ি খুঁজছিলাম। এ ‘বিসি’ কিন্তু অন্য ‘বিসি।’
রেগে লাভ নেই।
বকোয়াসের কোন ফিক্সড সিলেবাস হয়না।
সে, তুই/তুমি পড় চাই না পড়, লাইক পড়ুক চাই না পড়ুক। রহো বিন্দাস।
লেখাটার সাইজ দেখে আর কাউকে ট্যাগাবো কিনা ধন্দে আছি। যদি সে আমারই মতো না পড়েই বা শেষ অবধি না পড়েই ট্যাগানোজনিত বাধ্যতামূলক লাইক দিয়ে দেয়, এই ভয়ে।
এরকম ঘটেছে। বড় লেখা। পোস্টানোর তিন সেকেণ্ডের মধ্যেই ফটাফট লাইক। জানতে চাইলাম মগজের রিডিং অ্যাপসটা কোন প্লে স্টোর থেকে পাওয়া, যে, তিন সেকেণ্ডেই তেরো মিনিটের পড়া কমপ্লিট হয়ে গেল?
তার উত্তর ছিল, ‘লে পচা, আপনি পোস্ট মেরেছেন, দয়া করে ট্যাগিয়েছেন, আমি লাইক দিয়েছি। তাতেই তো মানুষ দিলখুশ হয়। এ আবার লেখা পোস্টিয়ে পড়া ধরে। আজব লোক একটা।’
সেই থেকে ইয়েলো লাইনের সেফ সাইডেই থাকছি আমি।
চলো, দুনিয়ার হ্যাংলা এক হও।