অ্যান্টিক লুকের টেবিলটা খুব দামি। একজন বেশ প্রতিবাদী ডাক্তার প্রায় চাপড়টা মেরে বসেছিল। যাঁর টেবিল তিনি প্রায় চেঁচিয়ে উঠে জানালেন যে সেই প্রতিবাদী ডাক্তারের ডিউটিটা তিনিই করে দেবেন। শোনা কথা যে ছাত্রজীবনে সেই ভদ্রলোক রাজনীতি করতো এবং অনেকগুলো সরকারি টেবিল সে অনাবশ্যক চাপড়ে ভেঙে ফেলেছে।
আসল কথায় আসা যাক। সাধারণত পুজোর সময় ডাক্তার এবং নার্সদের ছুটি পাওয়া বেশ ঝামেলার। অফিসিয়াল ছুটি প্রায় কেউই পায়না। এটুকু পড়েই কেউ হাঁ হাঁ করে চেঁচিয়ে উঠতে পারেন “ধুর মশাই, তিনপুজো আগে অমুক ডাক্তারকে সিমলায় কম্বল মুড়ি দিয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে দেখেছিলাম। অবশ্য কম্বলের ফাঁক দিয়ে শুধু নাকটাই দেখা গিয়েছিল।” কিংবা “দুপুজো আগে গোয়ার সমুদ্রে যে রেওয়াজি ভুঁড়িটি ভেসে থাকতে দেখা গিয়েছিল সেটি তমুক ডাক্তারের ছাড়া হতেই পারেনা।”
অস্বীকার করিনা, ঠিকই দেখেছেন। প্রতিটি হাসপাতালে ডাক্তারদের পুজোর ঠিক আগে আগে একটা গোপন পুজো রোস্টারের মিটিং হয়। হাসপাতাল ক্যাম্পাসে এইসব আন্ডারগ্রাউন্ড মার্কা সরকারবিরোধী মিটিং করা সম্ভব হয়না। তাই এই মিটিংগুলো সাধারণত হয় সিনিয়র-মোস্ট ডাক্তারের বাড়িতে। সেখানে ঠিক করা হয় পুজোর সময় কোন ডাক্তার কি ডিউটি করবেন। নিয়ম অনুযায়ী ডিপার্টমেন্টের মোট ডাক্তার সংখ্যার অর্ধেককে স্টেশনে থাকতে হবে। বিজোড় সংখ্যা, ধরুন পাঁচজনের ডিপার্টমেন্ট হলে তিনজনকে স্টেশনে থাকতেই হবে। বিভাগের একজন সেইদিন সারাক্ষণ হাসপাতালে থাকবে। স্টেশনে থাকা বাকিরা আশেপাশের প্যান্ডেলে বউ-বাচ্চা নিয়ে ঘুরঘুর করবে। একবার হাসপাতাল থেকে ডাক এলে ‘কা তব কান্তা, কস্তে পুত্রঃ” বলে প্যান্ডেলে সংসার ফেলে দৌড়াতে হবে। অবশ্য দৌড়াতে দৌড়াতে মনেমনে ছুটি পাওয়া ভাগ্যবান ডাক্তারের মুন্ডুপাত করতে ছাড়বে না। ভাগ্যবান ডাক্তারটি তখন হয় সিমলায় কম্বলের ফাঁক দিয়ে নাক বার করে রেখেছেন নয়তো গোয়ার সমুদ্রে চিত সাঁতার দিচ্ছেন।
কয়েকজন ডাক্তার তো আবার চরম অভাগা হন। ধরুন কোনো ডাক্তারের ফিক্সড ডিউটি কোনো একটি বিশেষ বার। ভদ্রলোক হয়তো বৃহস্পতিবার অ্যাডমিশন ডে করেন। আর বৃহস্পতিবারেই পড়লো সে বছরের বিজয়া দশমী, কালীপুজো আর দোল উৎসব। একেবারে সোনায় সোহাগা। শুভানুধ্যায়ীরা সেই ডাক্তারকে নানা পরামর্শ দেন। কেউ বলে শনিবার দিনটা উপোস করো তো কেউ বলে মুক্তো বা গোমেদ পরো। সবাই বেশ সহানুভূতির চোখে দেখে তাঁকে।
যেকথা হচ্ছিল, পুজো ডিউটির ব্লু প্রিন্ট তৈরি হয় কোনো এক সিনিয়র ডাক্তারের বাড়িতে। এবারেও তাই হয়েছে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি একটু আলাদা। করোনার তৃতীয় ঢেউ যেকোনো মুহূর্তে চলে আসতে পারে। তাই প্রায় সবারই মতামত যতটা সম্ভব পুজোর সময় হাসপাতালে থাকা উচিত। কারণ অভিজ্ঞতা বলে, যে কোনো উৎসবে মানুষ বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এবারে শুধু অ্যাক্সিডেন্ট, মারপিট বা মদ্যপানজনিত অশান্তি নয়, করোনাও আবার আঘাত হানতে তৈরি। ভাইরাসটা জনসমাগমের ফলে উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে যাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার। লকডাউনের অন্ধকার মাখা, দুশ্চিন্তা জড়ানো অনিশ্চিত দিনগুলোকে কে না ভয় পায়? কিন্তু আগেই বলেছি, আমাদের সেই নাছোড়বান্দা ডাক্তারের এবছর পুজোয় ছুটি চাইই। আর আমাদের সিনিয়র ডাক্তারদাদাও তাঁর টেবিলের মায়া ছাড়তে রাজি নন। পুজোর দুতিন সপ্তাহ আগে রোস্টারটা তৈরি হয়ে গেল।
কিন্তু ধর্মের কল আর বাতাসের সেই কথাটা আবার ফলে গেল। রাগী ডাক্তারবাবুর স্ত্রী একেবারে অন্যরকম। মিষ্টভাষী, সমাজসচেতন, ঠান্ডা মাথার মানুষ। তাঁর অল্প একটু জ্বর আর গলা ব্যথা হয়েছিল। ডাক্তারবাবু তো পাত্তাই দিতে রাজি নয়। ঠান্ডার জায়গায় বেড়াতে যাবে বলে আগে থেকেই সর্দিকাশি হচ্ছে। ক্রিকেটের নেট প্র্যাকটিসের মত। কিন্তু তার স্ত্রী নিজে তো করোনা টেস্ট করলেনই, স্বামীকেও করালেন। দুজনেই পজিটিভ। তারপর থেকে তারা একঘরে বন্দী। আর কে না জানে, যত বড়োই বাঘের মতো পুরুষমানুষ হোকনা কেন স্ত্রীর কাছে বাঘের মাসি হয়ে যেতে সময় লাগেনা। তার মতো মানুষের টানা দুসপ্তাহ বউয়ের সাথে একঘরে বাস করে বেড়াল হয়ে থাকা ভয়ংকর সমস্যার।
সেই ডাক্তারবাবু নাকি সবাইকে ফোন করে বলছে যে হাসপাতালের পরিবেশটা বড্ড মিস করছে সে। পুজোতে ডিউটি করার জন্য মুখিয়ে আছে।
সিস্টারদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কিছুটা একইরকম। তবে হাসপাতাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং নার্সিং সুপারিন্টেন্ডেন্টও চায় ঝামেলার দিনগুলোয় করিৎকর্মা মেয়েরা থাকুক। এমনই একজন অপারেশন থিয়েটারের নার্স আছেন, নাম ধরা যাক দুর্গা। বছর পঁয়ত্রিশ বয়স। অনেকগুলো অ্যাক্সিডেন্ট একসাথে ঢুকলে সত্যি দশটা হাত হয়ে যায় তার। পেটে গুলি খাওয়া, নাড়ি ছিঁড়ে যাওয়া রোগীদের অপারেশনে ডাক্তারদের সাথে নেমে পড়ে। দুর্গা সিস্টার থাকলে অনেকটাই নিশ্চিন্ত থাকা যায়। বছরের সব দিনই। গতবারের পুজোতেও ডিউটি দেওয়া হয়েছিল ওকে। বেচারি মোটেই করতে রাজি ছিলনা। সবাই বুঝিয়েছিল যে করোনার সময় কোথায়ই বা ঘুরতে যাবে। দুর্গার দুটো গাবলুগুবলু ছেলেমেয়ে আছে, সদা হাস্যময় এক স্বামী আছেন। তাদের সাথে বাড়িতে সময় কাটাতে চায়। ওর বর নাকি ছুটির দিনে দারুণ দারুণ সব রান্না করে। ‘ছেলেমানুষি’ বলে প্রায় জোর করে ডিউটি ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার পরপরই ওর স্বামী করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। অনেকের ধারণা দুর্গা হাসপাতাল থেকে জীবাণুটা নিয়ে গিয়েছিল।
দুর্গা অবশ্য কোনোদিনও সেকথা বলেনি।
এবছরেও দুর্গাকে পুজোর খারাপ ডিউটিগুলো ধরানো হয়েছে। আপত্তি করেনি সে। অপারেশন থিয়েটারে একা পেয়ে কারণ জিজ্ঞেস করি। হাজার হোক, বাড়িতে দুটো বাচ্চার সাথে তো সময় কাটানো যায়। মৃদু হেসে বলে “এখানে যে অনেকগুলো মানুষের আমাকে প্রয়োজন। ঠিক করেছি করোনা বিধি মেনে চলা যে কতটা জরুরি সেটা সুযোগ পেলেই সবাইকে বোঝাবো। এইসময় আমার ডিউটি থেকে সরে আসলে চলে?”
হাসপাতালের করিডর দিয়ে মাথা উঁচু করে মেয়েটা চলে যায়।
“আন্দোলনে উগ্রপন্থে, শিক্ষাব্রতে কর্মযজ্ঞে / রান্নাঘরে, আতুড়ঘরে।/ মা তুঝে সালাম! / অগ্নিপথে, যুদ্ধজয়ে, লিঙ্গসাম্যে, শ্রেণিসাম্যে / দাঙ্গাক্ষেত্রে, কুরুক্ষেত্রে।/ মা তুঝে সালাম।”
মল্লিকা সেনগুপ্তের কবিতাটা বুকের ভেতর একশো ঢাকির আওয়াজ তোলে। দুচোখ ভর্তি জল নিয়ে সবার চোখের আড়ালে দুহাত জড়ো করে মাথায় ঠেকাই। ‘দুর্গা, সবাইকে রক্ষা করো মা।’
ভালো
জীবন্ত মা দুর্গা কে আমার প্রনাম?।এই রকমই থেকো মা দুর্গা