‘কল করেছেন আজব রকম চন্ডীদাসের খুড়ো’। সেই কবে পড়েছিলাম। এখন সেই উপমাটিই মনে এল। আসলে যখনই যা কিছু পড়ে থাকি, যদি ভাল লেগে যায় আর মনে গেথে যায়, সারা জীবনই তা মনে থাকে । সেই শৈশবের কত কথাই পরিষ্কার মনে আছে, আর ইদানীং একতলা থেকে দোতলায় গিয়ে ভুলে যাই কি নিতে এসেছিলাম।
এই আর এক দোষ হয়েছে ইদানীং, ধান বানতে শিবের গীত গেয়ে ফেলি। এখানেও গাইবো।
যাই হোক, বলছিলাম, আজব কলের কথা। সেই কল এখন মোবাইল। হাতে না নিলে স্বস্তি নেই, শান্তি নেই। এমনকি বড় ঘর, ছোট ঘরে নিয়ে গেলেই যেন ভাল হয়। যাই কর, যেখানেই যাও, ল্যাজে করে বেঁধে নাও, তবে তোমারও শান্তি, লোকেরও শান্তি। তারা যখন খুসি তোমাকে পাবে।
আর এমন একটি পেশা বেছে নিয়েছি, তার জাতাকলে পড়ে পেষাই হয়ে চলেছি জীবনভর। কারো সময় সকালে, কারো দুপুরে, কারো রাত্রিতে। যখনই সে ফোন করবে, ধরতে হবে। না ধরলে পরে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে ঠিক ঠুকে যাবে। ‘আপনাকে না বেশ কয়েকবার ফোন করেছিলাম, আপনার ফোনটা কি খারাপ?’ উলটে ঠুকতে পারি, কিন্তু ওই বলে প্রোফেশনাল হ্যাজার্ড। মেনে নিয়েছি, কিছু বলিনা, শুধু মুচকি মুচকি হাসি। বাইরে গম্ভীর হয়ে বলি ‘ওহ্। তাই নাকি? কখন?’
যাক এ সব। বলছিলাম এখন মোবাইলই মানুষের একমাত্র নির্ভরযোগ্য সঙ্গী। যত দিন যাচ্ছে, আস্তে আস্তে যেন সব কিছু, এমনকি দাম্পত্য জীবনের সুধামাখা দিনগুলোরও অনেকটাই কেড়ে নিচ্ছে! কোথায় প্রেয়সী ঘায়েল করা দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকাবে বলে বেচারা বসে আছে, আর তিনি নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে আছেন কয়েকইঞ্চি পর্দার দিকে। অবশেষে অপেক্ষা-ক্লান্ত তিনিও তাঁর নিজের পর্দায় ফিরে গেলেন। আর সেখানে সব চলন্ত, জীবন্ত পরী থেকে পোকা ঘুরে বেড়াচ্ছে, যা ইচ্ছে তাই নাও। লেখা, জ্ঞান, চলচ্ছবি, কথা, কবিতা, কি নেই!
গবেষণা বলছে, এখন প্রায় প্রতিটি মানুষ ২৪ ঘন্টার ৩ ঘন্টা ব্যয় করে মোবাইল নিয়ে। আমিও সৌর জগতের বাইরে নই, সুতরাং… আমিও।
সারা দিনের ডিউটি করে, রাত এগারোটায় শেষ ছোঁয়া দেবার জন্যে নিয়ে বসেছি সেই আজব কল। শোবার আগে একবার হাতে না নিলে জীবন কেমন ‘শুনা শুনা লাগে’। হঠাৎ করে ইউটিঊব নামক আর এক মায়াবী একটা ভিডিওর থাম্বনেল, মানে যা সামনে আসে নিয়ে হাজির। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও বিসমিল্লা খাঁর যুগল বন্দী। না, আমি কোন তাল লয় বুঝিনা, সত্যি কথা বলতে তালের ত ও বুঝিনা। তবে মাঝে মাঝে শুনতে ভাল লাগে। তাই শুনি। ছবিতে সামনে বিসমিল্লা খানের ফোকলা দাঁতের খোঁচা দাড়ির হাসিযুক্ত মুখ। এগার মিনিটের ভিডিও। এখন কোন ভিডিও দেখার আগে দেখে নিই, কত মিনিটের । ধৈর্য এত কমে গেছে, এখন বেশি সময় আর কিছু দেখতে ইচ্ছে হয় না।
এঁরা সব বড় ওস্তাদ জানি। তাঁদের কাছ থেকে রস পেতে গেলে যে যোগ্যতার দরকার হয়, আমার তাও নেই। কিন্তু তবুও ওই ছবিতে আঙুলের ছোঁয়া লেগে গেল। আর যায় কোথায়! নেটের অবস্থা থঠাৎ করে ভাল হয়ে গেছে কিছুক্ষণ। মুহুর্তে চলে এল চলচ্ছবি। ‘মোহে পানঘাট পে নন্দ লাল ছেড় গয়ে রে’। ‘মুঘল-ঈ-আজম’ সিনেমার গান। সাকিল বাদায়ুনীর লেখা আর নওসাদের সুর। আমার গানটি শোনা। আমার অন্যতম প্রিয় গান।
সেই গান নিয়ে দুই ওস্তাদ কি ওস্তাদি করেছেন, দেখার সাধ হল। বন্ধ না করে খুলে রাখলাম, আর দিনের শেষে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ওস্তাদি দেখতে লাগলাম। কখন যে এগার মিনিট কেটে গেল, বুঝতে পারিনি। অথচ ওস্তাদদের গাওয়া গান নেই, সিনেমার মত মধুবালার নাচ নেই, সিনেমায় যা মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে, তবুও আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলাম! কিসে? তাদের ওস্তাদিতে? না তাও নয়। আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম বিসমিল্লা খানের হাসিতে!
যারা দেখেছেন, অন্ততঃ যারা বিসমিল্লা খানকে দেখেছেন তার বুড়ো বয়সের ছবিতে, তারা নিশ্চয়ই বলবেন, খান সাহেবের মুখে এমন কি আছে? মুগ্ধ হবার মত? আর মেয়েরা ছেলেদের দেখে মুগ্ধ হতে পারে, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তো তাও খাটে না। তবে? সত্য কথা বলতে কি, আমি বিসমিল্লা খানের বিষয়ে প্রায় কিছুই জানিনা। তার কোনোও বাজনা এখনো পুরোটাও শুনিনি। তবুও আমি এগার মিনিটির ভিডিও দেখে আর এগার মিনিট ভেবে এই লেখা লিখতে বসেছি। কতক্ষণ লাগবে জানিনা।
আছে। বিসমিল্লা খানের মুখে এমন কিছু আছে, এমনকি বিলায়েত খানের মুখেও আছে- কিন্তু বিসমিল্লা খানই আমাকে বেশি নাড়া দিয়েছে। তা হল তাঁর হাসি!
সে কি? ছবি দেখে অনেকেই বলবেন, কি আছে ওই হাসিতে। বয়সের ভারিক্কি গাল, খোঁচা খোঁচা অজত্নে লালিত দাঁড়ি, সম্ভবতঃ পান খাওয়া মুখে সামনের দুটো দাঁত ছাড়া অন্য সব দাঁত গুলো কালো এবং প্রায় দেখাই যায় না। কি আছে ওই মুখের হাসিতে? হ্যাঁ, আছে। তবুও, তবুও তাঁর মুখের ভাব, বিলায়েত খানের সেতার ও আল্লারাখার তবলার সাথে মাথা দোলানো, কখনও কখনও যেন ঝোকের মাথায় কয়েকটি শব্দ গেয়ে ওঠা, বাঁশিতে ফুঁ লাগানো, এবং বয়সের ভারে কুঞ্চিত চামড়ার মুখে সরল শিশুর হাসি।
হ্যাঁ, এই সরল শিশুর হাসিই আমাকে নাড়া দিয়েছে। তাঁকে দেখে মনে হয়েছে, তিনি অন্য কোন জগতের লোক। অন্য কোন গ্রহের বাসিন্দা, যেখানে কোন দুশ্চিন্তা নেই, কোন উদ্বেগ নেই, সসংসারের কোন টানা-পোড়েন নেই। অনাবিল আনন্দে একটি শিশু যেমন তার খেলনা-বাটি নিয়ে খেলে, তেমনই তিনি তাঁর সঙ্গীত জগতে বসে সুরের মুর্ছণায় ভেসে চলেছেন। কোন চিন্তা নেই, কোন ভাবনা নেই, কোন তাড়া নেই। সময় এখানে এসে থেমে গেছে।
এই যে সরল শিশুর হাসি, কোথা থেকে আসে? কি ভাবে আসে? কে আনে? কিংবা কি ভাবে আনা যায়! আয়না নিয়ে নিজের সামনে বসি। আমার চামড়া কুঁচকে যায়নি, আমার দাঁড়ি পরিষ্কার করে কামানো, মাথায় এখনো টাক পড়েনি। কিন্তু হাসি? আমার হাসি কোথায়? আমি তো হাসি না। এমনকি এই টানা সাত ঘন্টা ইমারজেন্সি ডিউটিতে বসে এক বারও কি হেসেছি? যদিও বা কখনও কখনও হাসি বের হয়, সেখানে সরলতা কোথায়? সে সব তো নিয়ম রক্ষার হাসি, দেঁতো হাসি, মুচকি হাসি, শয়তানী হাসি অথবা অট্টহাসি। কিন্তু বিসমিল্লা খানের সরল নিস্পাপ শিশুর হাসি?? না! আমার হাসি তার ধারে কাছে যায় না। কোথায় এই হাসি পাওয়া যায়? এই হাসি হাসতে গেলে যে সরলতা লাগে, যে পবিত্রতা লাগে, যে মনের আনন্দ লাগে, তা অর্জন করতে আমাকে আরও কয়েক জন্ম পার করতে হবে!
শিখছি। প্রতিদিনই অনেক কিছু শিখছি। কখনও ফুটপাতের দোকানদারের কাছ থেকে, কখনও আমার হাসপাতালের ঝাড়ুদারের কাছ থেকে, কখনও বাজারের শব্জিওয়ালার কাছ থেকে, সহকর্মীর কাছ থেকে, আবার কখনও আমার ছোট্ট মেয়েদের কাছ থেকে। আর নিজেকে শিক্ষিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। জীবনের প্রথম তিরিশ বছরের বেশি শুধু পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন করে গেছি। পাশ করার জন্যে নিজেকে শিক্ষিত করে গেছি। কিন্তু সরলতা শিখিনি, নিস্পাপ হাসি হাসতে শিখিনি। জীবনে আনন্দ পেতে শিখিনি।
হঠাৎ করে এক রাত্রিতে এসে পক্ককেশ, কুঞ্চিত মুখের খোঁচা দাঁড়ির বিসমিল্লা খান যেন আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন, তুমি যতই যা কিছু কর, এই হাসি একবার হাসো- তোমার আর কিছুর দরকার হবে না। এটাই জীবনের লক্ষ্য ও মোক্ষ হওয়া উচিত। আর এই হাসি তখনই হাসতে পারবে, যখন তুমি ছোট খাট সুখ-দুঃখ ব্যথা-বেদনা রাগ-অনুরাগ মান অভিমানের অনেক উর্ধে উঠে সব কিছুকেই শিশুর মত সুন্দর দেখতে পারবে।
—০—
২৮/৯/২১
ভালো লাগলো।