পূর্বপ্রকাশিতের পর
আবার সেই তেনজিং নোরগে বাসষ্ট্যান্ড। চেঁচামেচি, বাসের হর্ন, রিকশার প্যাঁক প্যাঁক। বাস থেকে নেমে ভীড় ঠেলে বেরিয়ে কাছেই হিলকার্ট রোডের পাশে একটা সাধারণ ছোটখাটো হোটেলে উঠলাম। এখানে লোডশেডিং চলছে। জেনারেটর নেই। একটা মোমবাতি আর দেশলাই দিয়ে গেল ঘরে। অর্থ্যাৎ, প্যাচপ্যাচে গরমে দরদর করে ঘামলেও ফ্যান চলবে না। ঘরে বসে থাকার কোনো মানে হয় না।
হাত-মুখ ধুয়ে ব্যাগ রেখে বেরিয়ে পড়লাম।
এসটিডি বুথে গিয়ে টেলিফোন করলাম কটকে। বেশ কয়েকবার চেষ্টার পরে লাইন পাওয়া গেল। শুচিস্মিতার এম ডি-র থিওরি পরীক্ষা হয়ে গেছে। পরের সপ্তাহে প্র্যাকটিক্যাল। যাক, ছ’মাস বাদে শেষ পর্যন্ত দেখা হবে। আমার চাকরীর নাটকীয় ঘটনাবলী শুনে ও প্রায় আঁৎকে উঠল।
একটা রিকশা ধরলাম। ‘প্রধান নগর যাবে?’
‘প্রধান নগরে কোথায়?’
‘নিবেদিতা নার্সিংহোমের কাছে।’
‘চলুন।’
চললাম। কিন্তু বাড়িটা ঠিক নিবেদিতা নার্সিং হোমের পাশে নয়। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে দেখা গেল সেটা আরো আধ কিলোমিটার দূরে স্যালভেশন আর্মির সেবাকেন্দ্রের পাশে।
সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে রিক্সা থেকে নেমে নিজের পরিচয় দিলাম অশোক দাশগুপ্ত বাবুকে। আমাকে সরাসরি চেনেন না। বন্ধুর আত্মীয়। তাও দূর সম্পর্কের। আমার সঙ্গে ছিল বন্ধুর লেখা দু’ লাইনের একটা চিঠি। তার জেরে সেদিন সন্ধ্যায় যে সম্পর্ক তৈরী হল তা উনি গত হওয়া পর্যন্ত গত কুড়ি বছর অটুট ছিল।
ছাপোষা মধ্যবিত্ত গৃহস্থ মানুষ। সরকারী চাকরী করতেন জলপাইগুড়িতে। গৃহিণী শান্তা, মেয়ে দোয়েল ক্লাস এইটে। আমরা পরে মা-মেয়েকে মজা করে ডাকতাম ‘দোয়েল-কোয়েল।’
অশোকবাবু প্রায় অচেনা এই আমাকে ওনার স্কুটারের পেছনে বসিয়ে চম্পাসারী আর শিলিগুড়ির আরেকটা মার্কেটে নিয়ে গিয়ে কোয়ার্টারের প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র কিনিয়ে দিলেন। রাতে ওনার বাড়িতেই খেতে হল। আগেভাগে হোটেলে ওঠার জন্য খুব অনুযোগ করলেন ওঁরা। পরে শিলিগুড়ি এলে আর কোনদিন যেন হোটেলে না উঠি তারজন্য প্রতিজ্ঞা করিয়ে রাখলেন। শিলিগুড়িতে এত বছরে আর কোনোদিন হোটেলে থাকতে হয় নি।
রাতটা বাসস্ট্যান্ডের সেই হোটেলে কোনোরকমে কাটিয়ে ভোরবেলা রাম্ভীর বাস ধরলাম। রোদ উঠেছে। করোনেশন ব্রীজের কাছে বেশ জ্যাম। রাস্তায় ক্ষীরা (শসা) আর নারকোল ফালি করে বিক্রি হচ্ছে। সঙ্গে টকটকে লাল লঙ্কার আচার। ক্ষিদে পেয়েছে। ভাবলাম চ্যালেঞ্জটা নিয়েই ফেলি। ভয়ঙ্কর ঝাল লঙ্কার আচার অ্যাসিডের মত গলা দিয়ে নামল।
বর্ষার তিস্তা। মেটে সবুজ রঙের ঘোলা জল প্রবল বেগে বয়ে চলেছে। করোনেশন ব্রীজের ওপারে রাস্তাটা চলে গেছে বাগরাকোট হয়ে ডুয়ার্সের দিকে। ইংরেজি ‘সি’ অক্ষরের মত দেখতে এই ব্রীজ তৈরী করা হয়েছিল সেই ১৯৩৭ সালে, ব্রিটেনের রাজা ষষ্ঠ জর্জের অভিষেক উপলক্ষে। সেইজন্য নাম করোনেশন ব্রীজ। লোকমুখে সেভক ব্রীজ বা বাঘপুল।
জঙ্গলে মাঝে মাঝে দেখা দেয় রঙবেরঙের বুলবুল, ময়না, টিয়া, কাঠঠোকরা। নদীতে বক, মাছরাঙা। কখনো কাঠবেড়ালী। কোথাও কোথাও রাস্তার ধারে কয়েকটা বাঁদর লাইন দিয়ে বসে আছে- যাত্রীদের দেওয়া বাদাম ইত্যাদির আশায়। অন্য সময় রাফটিং হয় নদীতে। কিন্তু বর্ষার তিস্তার ধারে কাছে যাওয়ার সাহস কারও নেই।
সেদিন রাতে একটা রুগী এল অ্যাক্সিডেন্ট করে। স্কুটার চড়ে তিস্তাবাজার যাচ্ছিল রাতে। স্কুটারসহ পিছলে গিয়ে সোজা নদীতে। লোকটা বরাতজোরে একটা গাছের গুঁড়ি জড়িয়ে ধরে বেঁচে গেছে। কোমর এবং উরুর হাড় ভাঙা। শকে চলে যাচ্ছে। দ্রুত দু’হাতে ফ্লুইড চালিয়ে, হাসপাতালের কাপড় দিয়ে হ্যামক বানিয়ে আর পা’টাকে স্প্লিন্ট করে কালিম্পং হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলাম। পরবর্তী চিকিৎসা জানা সত্ত্বেও রাম্ভীতে করতে পারলাম না। পরিকাঠামো নেই। বিপিএইচসি-তে থাকার কথাও নয়।
জুলাই-এর শেষ। টানা বৃষ্টিতে ধ্বস নেমে শিলিগুড়ি আর কালিম্পং থেকে রাম্ভী আলাদা হয়ে গেল দিন তিনেকের জন্য। শুধু মংপুর রাস্তা খোলা। কার সাহস আছে ভালুকখোপ পেরিয়ে ওই রাস্তায় যায়! সুতরাং অরুণদের হোটেলে সকাল-বিকেল খিচুড়ি, ডিম ভাজা আর স্কোয়াশের তরকারি। শুধু একদিন রাতে এত বৃষ্টি হচ্ছিল যে, শিলিগুড়ি থেকে কিনে আনা স্টোভে ম্যাগি বানিয়ে খেয়ে শুয়ে পড়লাম।
হাসপাতালে কোনো রুগী নেই তখন। রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে। প্রয়োজন হলেও লোকজন খুব একটা আসতে পারছে না। শুধু টারজং বস্তি আর গেলখোলা থেকে আট-দশ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে বাঁশ আর কাপড়ে তৈরী স্ট্রেচারে শুইয়ে দু-একটা সিরিয়াস রুগী নিয়ে আসে।
সঙ্গের গল্পের বইগুলো শেষ। শিলিগুড়ি থেকে আরো কয়েকটা কিনে এনেছি। অরুণ একটা এফ এম রেডিও দিয়েছে। বেশীরভাগ সময় নেপালী সেন্টার ধরে তাতে। গান ছাড়া বিশেষ কিছু বুঝি না। তবুও চালিয়ে রাখি, বিশেষতঃ রাতে। একাকীত্ব কাটে।
হাসপাতালের ফোনটা সারিয়ে দিয়ে গেছে। এখন মাঝে মাঝে ফোন আসে। বারাসাতের বাড়ী থেকে, বাবা-মায়ের, ভাই-এর। কটক থেকে, শুচিশ্মিতা-র। শিলিগুড়ি থেকে দাশগুপ্ত-বাবুও করেন মাঝেমাঝে। শুচিশ্মিতা কটকের পাট চুকিয়ে কলকাতায় ফিরে আসছে। আমারও ডিএনবি পরীক্ষা। কলকাতা ফিরতে হবে।
ছুটি নিয়ে শিলিগুড়ি গেলাম প্রথমে। গাইসাল ট্রেন দুর্ঘটনার পরে রেল আবার চালু হয়েছে। টিকিট পাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার তখন। খোঁজটা কে দিয়েছিল এখন আর ঠিক মনে নেই। পানিট্যাঙ্কি মোড়ের কাছে এক ক্যুরিয়ার কোম্পানীর অফিস। তারা ঠিক দার্জিলিং মেল-এর টিকিট জুটিয়ে দিল। অবশ্য বর্ধিত দক্ষিণার বিনিময়ে। টিকিটটা হল গয়াবাড়ী থেকে। টয়ট্রেনের প্রত্যেকটা ষ্টেশন থেকে টিকিটের আলাদা আলাদা কোটা ছিল দার্জিলিং মেলে। তারই কোনো একটা ব্যবহার করে ওরা টিকিট কাটত। টিকিটটা অদ্ভূত। আগেকার দিনের লোকাল ট্রেনের টিকিটের মত। ছোট্ট হলুদ পিসবোর্ডের টিকিট, তারিখের ইম্প্রেশন সহ।
ট্রেন ছাড়ল। আলুয়াবাড়ির পরে গুঞ্জরিয়া পেরোতেই নাকে এল গন্ধটা। স্লীপার কোচ। সব জানলা বন্ধ হয়ে গেল মুহুর্তে। গাইসাল পার হচ্ছে। হ্যালোজেনের আলো জ্বালিয়ে উদ্ধার কর্মীরা তখনো কাজ করছে। ক্রেন দিয়ে ধ্বংসস্তুপ সরাচ্ছে। রেললাইনের ধারে সারি সারি মৃতদেহ। আর সাথে বীভৎসভাবে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া দুটো ট্রেনের কঙ্কাল। ব্রহ্মপুত্র আর অবধ-আসাম এক্সপ্রেস। মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমি-র ডিসেকশন হলে ফর্ম্যালিন জারিত শবদেহের ডিসেকশন করেছি দিনের পর দিন। ক্যালকাটা পুলিশ মর্গে পোষ্ট-মর্টেম দেখার অভিজ্ঞতাও ছিল। তবু কেন জানিনা, পেট মুচড়ে বমি এল আমার। গোটা ট্রেন তখন বমি করছে। ট্রেন আরো এগোতে খোলা হাওয়ায় সবাই সুস্থ হল।
মানুষের জীবন পদ্মপাতায় জল। কখন গড়িয়ে চলে যাবে, কেউ জানে না। ঘুম আসছিল না অনেকক্ষণ। খেতেও পারলাম না। শেষরাতে ট্রেনের দুলুনিতে ঝিমুনি এসে গেছিল। চোখ খুলতেই দেখি ট্রেন দক্ষিণেশ্বরে ঢুকছে।
ক্রমশ