বাড়ি ফিরলাম। বাড়িতে অনেক রেখে ঢেকে অভিজ্ঞতাগুলো বলতে হল। উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়ে লাভ নেই। শুধু ভাই বলল, ‘কলকাতার হাসপাতালের চাকরিটা একবার দেখতে পারতিস। অনিমেষ দত্ত আরো একবার ফোন করেছিল। ওদের অর্থোপেডিক্সের লোক চাই।’
‘হ্যাঁ জানি। ডাক্তার ঝা ছেড়ে দিয়ে বিহারে ফিরে গেছে।’
কিন্তু সরকারি চাকরির নিরাপত্তার মোহ ছাড়া অত সহজ নয়। বাবা অসুস্থ। ভিআরএস-এর আবেদন করে দিয়েছে। শুচিশ্মিতার হেল্থ সার্ভিসের পোষ্টিং হয়েছিল পুরুলিয়ার ঝালদায়, দেড় বছর আগে। স্বভাবতঃই এমডি ছেড়ে দিয়ে চাকরিতে যোগ দেওয়া সম্ভব হয় নি।
কোনোক্রমে ডিএনবি পরীক্ষা দিয়ে কটক চললাম। ফেরার পথে প্রচুর জিনিসপত্র আর অসংখ্য বই। জিনিসপত্র প্রায় সব ট্রেনের লাগেজ কম্পার্টমেন্টে। সঙ্গে অতগুলো ব্যাগ দেখে টিকিট চেকারের রক্তচক্ষু। ব্যাগ খুলতেই বেরিয়ে পড়ল অসংখ্য ডাক্তারী বই। সেসব দেখে সে ভদ্রলোক প্রশ্রয়ের হাসি হেসে ওড়িশি ভাষায় গল্প জুড়ল শুচিশ্মিতার সঙ্গে। প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি, শুচিশ্মিতা-র এই ঝরঝরে ওড়িশি ভাষার জন্য আমি একবার পুরীর সী-বীচের সান্ধ্যকালীন মেলায় ইলোপের কেস খেতে খেতে বেঁচেছিলাম। দোকানদারদের ধারণা হয়েছিল যে বাঙালী ছেলে উড়িষ্যার মেয়েকে বিয়ে করে পালাচ্ছে।
হাওড়া ষ্টেশন থেকে বইগুলো বইতে গিয়ে ওদের পুরনো পারিবারিক ফিয়েট গাড়ীর ছাদটা তুবড়ে গেছিল। ওর এই বস্তাবস্তা বই কেনার বদ অভ্যেস চিরকাল আছে। আমি কৃপণ লোক। আমাকে শুধু মাঝে মাঝে বইগুলো বইতে হয় এবং অর্ডার করতে হয়। কিনতে হয় না।
ফেরার দিন দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসব। লম্বা, লম্বা বক্তৃতা চলছে। আমার ডাক আর আসে না। এদিকে ট্রেনের সময় হয়ে আসছে। সার্টিফিকেটটা হাতে পেয়ে শেষ পর্যন্ত ষ্টেশনে যখন পৌঁছলাম ততক্ষণে ট্রেন ছেড়ে চলে গেছে। পরদিন রাম্ভী পৌঁছতেই হবে। পরের ট্রেনে অসংরক্ষিত টিকিটে একা বহু কষ্টে পৌঁছলাম এনজেপি।
আবার রাম্ভী। বর্ষার পাহাড়। সেই এক জীবন। সারা দিনে কয়েকটা মাত্র রুগী। বিকেলে আড্ডা। একদিন জয়ন্তদা আর মুখার্জীবাবুর সাথে রিয়াং বনবাংলোয় ঘুরতে গেলাম। বাংলোটা কাঠের। বড় রাস্তা থেকে অনেক নীচে, তিস্তার একেবারে কোলে। বাংলোটা এখন বোধহয় আর নেই। তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের গর্ভে চলে গেছে।
ফরেষ্ট অফিসার বাঙালী। নামটা এতদিনে ভুলে গেছি। একা একা থাকেন। একজন লোক এলে যেন বর্তে যান। প্রচুর আপ্যায়ন করে রাতে থেকে যেতে বললেন। ডিনারে গরম ভাত আর বনমুরগীর ঝোল। খাবারের অপার্থিব স্বাদ আর রাতে গর্জনমুখর তিস্তার ঠিক পাশে শুয়ে থাকার অনন্য অভিজ্ঞতা। মাঝে শুধু একটা কাঠের দেওয়াল।
দুপুরে খেতে খেতে মাঝে মাঝে ডাঃ সুদীপ ঘোষের সঙ্গে কথা হত। হোমিওপ্যাথিক আউটডোরটা আলাদা ঘরে। তাই অন্যসময় দেখা হয় না। অনেক মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছিল সুদীপদা।
‘সার্ভিস বুক তৈরী হয়েছে?’
‘না তো! এই পাহাড়ে সার্ভিস বুক কোথায় পাব?’
‘যে কোনো একটা বাঁধানো খাতা নিয়ে বানিয়ে ফেলো, আর তাতে বিএমওএইচ-এর সই করিয়ে রাবার ষ্ট্যাম্প দিয়ে রাখো।’
সত্যিই একটা বঙ্গলিপি ধরনের বাঁধানো খাতাতে হাতে লিখে সার্ভিস বুক বানিয়েছিলাম। পরে চাকরীতে খুব কাজে দিয়েছিল সেটা। পে স্লিপ ছিল না বিপিএইচসি-তে। আর একটা খাতায় রেভিনিউ ষ্ট্যাম্প দিয়ে সই করিয়ে রাখতাম।
সুদীপদার স্ত্রীও হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। শিলিগুড়িতে প্র্যাকটিস করতেন। সুদীপদা আমাকে বলল, ‘তোমার মিসেস চাইল্ড স্পেশালিষ্ট?’
‘হ্যাঁ’
‘সে বেচারা রাম্ভী-তে বসে করবে কি? ওকে শিলিগুড়িতে চেম্বার করে দাও। পরে সুযোগ পেলে চাকরিতে জয়েন করবে। বছর খানেকের মধ্যেই মেডিক্যাল কলেজে আর এম ও নেবে শুনেছি।’
সুদীপদা আর নেই। আমার কৃতজ্ঞতা জানানোরও আর সুযোগ নেই।
দু-সপ্তাহ দিন ডিউটি করে শিলিগুড়ি এসে অশোকবাবু-র শরণাপন্ন হলাম। বাড়ী ভাড়া খুঁজতে হবে। শুচিশ্মিতা রাম্ভীবাজারে থেকে আর কি করবে! ওখানে ওর চাকরি নেই। পাহাড়ের তিনটে শহর বাদে বাকি কোথাও একটা ওষুধের দোকান পর্যন্ত ছিল না। ডাক্তারের চেম্বার তো দূরের কথা। শিলিগুড়িতে থাকলে তবু প্র্যাকটিস করতে পারবে। অশোকবাবুরা শিলিগুড়ির পুরোনো লোক। অনেক লোকের সাথে যোগাযোগ। ওঁর সাহায্যে বেশ সস্তায় প্রধাননগরে একটা ভাল বাড়ী জুটল। একটা চেম্বারে কথাও বলে রাখা হল।
বাড়ীওয়ালা পাপিয়া সেন একজন উকিল। ওনার স্বামী মুকুলদা শিলিগুড়ি পৌরনিগমের কাউন্সিলর। গৃহিণী তখন কলকাতায়। গৃহস্থালীর কিছুই বুঝতাম না। পাপিয়া-দি আর অশোক বাবুর স্ত্রী শান্তা নিজেরা দায়িত্ব নিয়ে আমাদের ঘর গুছিয়ে দিলেন। আপাততঃ ঘর বন্ধ করে কলকাতা চললাম।
শিলিগুড়ি ফেরার পথে আর এক কান্ড। বোলপুরের পরে একটা মাঠের মধ্যে দার্জিলিং মেল থেমে গেল। গাড়ীতে নাকি বোমা রাখা আছে বলে খবর এসেছে। তখন সদ্য গাইসাল দুর্ঘটনা ঘটেছে। সেটা আসলে দুর্ঘটনা না নাশকতা- তার সমাধান হয় নি। তাই কর্তৃপক্ষ ভীষণ সতর্ক। কম্পার্টমেন্টগুলোতে আড্ডা, হইচই থেমে গেল মুহুর্তে। সবার জিনিসপত্র সার্চ করল পুলিশ কুকুর। আমাদের জিনিসপত্র ছিল বেশী, তাই ভোগান্তিও হয়েছিল বেশী। সবশেষে তন্নতন্ন করে ট্রেনের আগাপাশতলা খুঁজেও যখন কিছু পাওয়া গেল না, তখন ট্রেন আবার ছাড়ল। ততক্ষণে পাঁচঘন্টা পেরিয়ে গেছে।
তবে জীবনে দুর্যোগের সেটাই ছিল শুরু। গোটা উত্তরবঙ্গে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে তখন। শিলিগুড়ি পৌঁছে খবর পেলাম রাম্ভীবাজার ধ্বস নেমে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। হাসপাতালে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। পরদিন রাতে খেতে বসেছি। উপর থেকে পাপিয়া-দি এসে ভয়ংকর দুঃসংবাদ-টা দিল। বারাসাতের বাড়ি থেকে টেলিফোন এসেছিল। ভাই-এর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। প্রিয়জনের ক্ষেত্রে কেন জানি না কু-ডাক টা-ই প্রথমে মনে আসে। ফোনেই আভাস পেয়েছিলাম, ভাই আর নেই। সারারাত প্রবল বৃষ্টি। ফ্লাইট বাতিল। পরদিন মুকুলদা কোত্থেকে ট্রেনের টিকিট জোগাড় করে এনে দিল।
আমাকে সামলে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে চলেছে শুচিশ্মিতা। আমাদের পাশের বার্থে ছিলেন এক তরুণী। ট্রেন ছাড়তেই কয়েকটা যুবক এসে শুচিশ্মিতা আর ওই মহিলা-কে পাশের কোচে যেতে বলল। ভদ্রস্থ পোষাক। কথাবার্তাও তথাকথিত শিক্ষিতদের মত। হাতে তাদের মদের বোতল এবং গ্লাস। মহিলাদের তারা অন্য কোচে পাঠিয়ে দিয়ে চলন্ত ট্রেনেই মদ্যপান ও মাতলামো করতে চায়।
শুচিশ্মিতা কিছুতেই ওই অবস্থায় আমাকে ছেড়ে যেতে রাজি হল না। পাশের তরুণীও থেকে গেলেন। তখন ওখানেই শুরু হল মদ্যপ যুবকদের অবাধ মদ্যপান ও উচ্ছৃংখলতা। টিকিট চেকার একবার দেখে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। কিছুই করল না। সবকিছু জেনেশুনেও আমাদের নিয়ে চলল খিল্লি। চুড়ান্ত অমানবিক লোকজন। বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে। পাশের তরুণীটি আমাদের ভাইয়ের অ্যাক্সিডেন্টের কথা শুনে সমবেদনা প্রকাশ করলেন।
সব রাতের শেষেই একসময় ভোর আসে। তবে সে ভোর কোনো সুখবর নিয়ে এল না। বাড়ি পৌঁছে জানলাম, আমার সন্দেহই সত্যি। আমার ভাই চব্বিশ বছরের জীবনে ইতি টেনে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।
(ক্রমশঃ)
Khub valo laglo pore..amar husband onekdin Sukhiapokhri BPHC te posted chilen..seisob diner kotha mone pore gelo..??