(এ স্মৃতিচারণে বড় যুদ্ধ…)
ও ছিল একদম অন্যরকম।
ব্যতিক্রমের থেকেও ব্যতিক্রমী।
সৃষ্টি ছাড়া। নিয়ম ভাঙা।
প্রথম দেখা উনিশশো বিরাশিতে।
যেবার আমরা মেডিক্যাল কলেজে ভরতি হই এম.বি.বি.এস পড়তে।
একটা হাড় জিরজিরে চল্লিশ কেজি ওজনের ছেলে।
কিন্তু ব্যারিটোন ভয়েস।
প্রথম আলাপে
রামায়ণের এক চরিত্রের ডায়ালগ গমগমে গলায় বলে চমকে দিয়েছিল সকলকে।
কলেজের কমন রুমের
সামনে দাঁড়িয়ে।
বলেছিল গুপ্তিপাড়ায় বাড়ি।
যেখানে রবিঠাকুরের বিশ্বম্ভর বাবুও থাকতেন।
তখন মেডিক্যাল কলেজের
ইউনিয়ন ছিল অতি বাম সংগঠন এম.সি.ডি.এস.এ’ র।
আজকের স্বনামধন্য মেডিক্যাল অ্যাকাডেমীসিয়ান ডক্টর অরুণালোক চক্রবর্তী,
শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ডক্টর পূণ্যব্রত গুণ, সুরেশ ঠাকুর, পার্থ ত্রিপাঠী দাপুটে নেতা ছিল কলেজের।
আমরা তাঁদের স্নেহচ্ছায়ায়
তাঁদের আশ্রয়ে মেন হোস্টেলে উঠলাম তাঁদের গেস্ট হিসাবে।
সে ছিল আমাদের মানুষ হিসাবে আদর্শবাদ শিক্ষার প্রথমদিকের দিনগুলো।
তাঁদের অতি বাম রাজনীতি
হিংসা বরদাস্ত করত না। খুনোখুনির রাজনীতি বরদাস্ত করত না। বলত মানুষ হিসাবে মানুষের পাশে থাকার আদর্শবাদের কথা,
যা আমাদের গ্রাম্য সারল্যকে
ভিজিয়ে দিয়েছিল চোখের জলের আবেগ দিয়ে।
রাজ্যের সে বামফ্রন্ট শাসনকালে ও জড়িয়ে পড়ল সেই আদর্শবাদের ছাত্র রাজনীতিতে। আরও অনেকের সঙ্গে। সে রাজনীতি সে বিশ্বাস আজীবন তার সঙ্গী ছিল। আরও অনেকের মত।
ইউনিয়নের কাজ, পোস্টার লেখা, মিছিল মিটিং, সহপাঠীদের অভাব অভিযোগ শুনে সমস্যা সমাধান, সম মনোভাবাপন্ন বাইরের কলেজগুলোর ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা,
সর্বোপরি জনস্বাস্থ্যের দাবিতে রাজ্যের সাতটা মেডিক্যাল কলেজ মিলে উনিশশো তিরাশি সালের ঐতিহাসিক এ.বি.জে.ডি.এফ মুভমেন্ট এসবে জড়িয়ে
এসব করে পড়াশোনার বিশেষ সময় পেত না সে, যার জন্য মূলত কলেজে আসা।
যদিও ব্যাপারটা সে অতিক্রম করে যেত তার ব্যতিক্রমী মেধা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে।
সেই স্বল্প ম্যাচ্যুরিটির বয়সেও ওকে কোনও বিরোধী ছাত্রনেতার সঙ্গে কোনওরকম বিরোধিতায় জড়িয়ে পড়তে দেখিনি। ওর জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা প্রতি বছর ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ ইলেকশনে প্রচুর ভোট দিয়ে জেতাতো ওকে।
স্টুডেন্টস হোস্টেলে ও ছিল একদম ভিন্ন চরিত্র। ভিন্ন সত্তা। আড্ডাবাজ, মস্তিবাজ।
বয়সসুলভ ফিচলেমিতে ভরা।
টিটি খেলা,ব্যাডমিন্টন খেলা, নাইট শো সিনেমা দেখতে যাওয়া, হোস্টেলের ছাদ থেকে রাস্তা দিয়ে চলে যাওয়া মানুষদের পিছনে লাগা….
আরও কত কি।
মাঝে মাঝে রাস্তা থেকে পুলিশের নো এন্ট্রি বোর্ডও তুলে আনত চুপি চুপি। নিজের ঘরের সামনে রেখে দিত।
পুলিশ সার্জেন্ট তা খুঁজতে খুঁজতে চলে আসত হোস্টেলে। হাসতে হাসতে ফেরত নিয়ে যেত তা।
একবার ফাইনাল ইয়ারে কোলাঘাট পিকনিক করতে যাবার সময় রাতারাতি তৈরি হল ব্যানার। এম.এইচ.পি.এ, মেন হোস্টেল পিকনিক অ্যাসোসিয়েশন,
সেই ব্যানার নিয়ে মিছিল করে সেবার আমরা অসংখ্য বিনা টিকিটে ছাত্র মিছিল করা ছাত্ররা টিটির নাকের ডগা দিয়ে পেরিয়ে গেছিলাম হাওড়া স্টেশন। তারা হেসেছিল সে কান্ড দেখে। কিছু বলেনি আমাদের।
এরপর আমাদের ছাত্রজীবন শেষ হলো।
জীবন ও জীবিকার তাগিদ নামক বিচ্ছিন্নতাবাদ বন্ধুদের ছড়িয়ে দিল বিভিন্ন দিকে।
কয়েক বছরের জন্য যোগাযোগ ক্ষীণ হলো কলেজের সে সব আদর্শবাদের সহমর্মিদের।
তখনও বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর পেতাম ওর।
শুনতাম পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের
উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছেড়ে ও হাউসস্টাফশিপের অবসরে ও নিজেকে নিয়োজিত করেছে সমাজের বৃহত্তর সেবায়।
গরীব জনজাতি ও প্রত্যন্ত গ্রামের পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য অতি বাম সংগঠনের সঙ্গে করছে মেডিক্যাল ক্যাম্প। জোগাড় করে দিচ্ছে ওষুধ।
নিজের খরচ চালানোর জন্য হাসপাতালের ডিউটির ছাড়াও করছে নার্সিংহোমের খুচখাচ কাজ।
ক্রিটিক্যাল কেয়ার ট্রেনিং।
অ্যানেস্থেসিয়ার ট্রেনিং।
শিখছে জেনারেল সার্জারি, অর্থোপেডিক্স ,প্লাস্টিক সার্জারি, থোরাসিক সার্জারি ক্রিটিক্যাল কেয়ারের কাজ,
সেই সাধারণ মানুষের কাজে লাগবে বলে।
অনায়াস উপেক্ষায় ছেড়ে দিয়েছে সে সময়ের প্রভাবশালী এক কার্ডিওথোরাসিক সার্জনের করে দেওয়া এম.সি.এইচ’ এ ভর্তি সুযোগ।
ক্রমশ এসব করতে করতে ও বিয়ে করেছে। সংসারী হয়েছে। রাজ্য ই.এস.আই এ চাকরি নিয়েছে। করেছে জেনারেল ডিউটি, নাইট শিফট, অ্যানেস্থেসিয়ার কাজ।
কিন্তু পুরনো দায়িত্বগুলো ছাড়তে চায়নি। হাসিমুখে যাবতীয় চাপ নিয়েছে।
কিছু কিছু ঘটনা কালের গহ্বরে হারিয়ে যায় নাড়াচাড়ার অভাবে।
এমন অনেক ঘটনা আছে ওর জীবনের। তার মধ্যে বিশেষ একটা ঘটনা ওর ব্যথা বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠার আগের এক বেলার ঘটনা।
আমার সঙ্গে দশ মিনিটের কথা।
সেটা বিশ শতকের শেষ দশক।
আমার মা উডল্যান্ডস এ ভর্তি হয়েছেন ডক্টর ভবতোষ বিশ্বাসের অধীনে। মাইট্রাল স্টেনোসিসের ক্লোজড মাইট্রাল ভালভোটমি অপারেশনের জন্য।
অপারেশনের পরের দিন ও এল আমার সঙ্গে দেখা করতে। বহুদিন বাদে সেই আবার তার সঙ্গে দেখা। খুব বিষন্ন লাগছিল ওকে।
বলল, খুব মানসিক যন্ত্রণায় আছে। কাজেকম্মে খুব নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য হলেও অ্যানেস্থেসিয়াতে প্রথাগত ডিগ্রি না থাকায় কিছু মুখোশ পরা মানুষ তার কাজে বাধা দিচ্ছে।
এরকম যন্ত্রণা পেতে ওকে দেখিনি আগে। সবকিছু উড়িয়ে দেওয়া মানসিকতার মানুষটার ডিপ্রেসন হচ্ছে ডিগ্রিহীনতার কারণে?
আমি বললাম,
চলে যা দিল্লি। ডক্টর জিপি দুরেজার কাছে পেন মেডিসিনের ট্রেনিং করে আয়।
ব্যথা চিকিৎসায় নিয়োজিত কর নিজেকে।
তুই যাদের জন্য কাজ করিস সেসব শ্রমিক কৃষকদের শারীরিক যন্ত্রণা লাঘব হবে তাতে। আর তোর মানসিক যন্ত্রণা।
আমার মত সাধারণ বন্ধুর এ উপদেশ সে নিয়েছিল।
দিল্লি গেছিল
তার কয়েক মাস পরেই।
সেই শুরু। বাকিটা সরকারের বিরুদ্ধে, প্রশাসনের বিরুদ্ধে এক অসম যুদ্ধে জয়ী হওয়ার ইতিহাস।
ওর দু হাজার দশের আমেরিকার পেন ফেলোশিপ, ওর আরও উত্তরকালের যাদবপুর ইউনিভার্সিটির পি.এইচ.ডি, ক্রনিক ব্যথা চিকিৎসায় ওর সামাজিক অবদানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, এবং তার থেকে প্রাপ্ত পুরো অর্থটা ব্যথা চিকিৎসায় নিয়োজিত করা…. সবটাই সেদিনের সে তুচ্ছ ঘটনার উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। ভারত পেয়েছে ব্যথা চিকিৎসার এক লেজেন্ডকে।
দু হাজার কুড়ি সনে ধরা পড়ল ওর অ্যামাইয়োট্রপিক ল্যাটেরাল স্ক্লেরোসিস। শরীরের সব পেশীগুলো এতে নিস্তেজ ও শক্তিহীন হয়ে যায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।
এ রোগে মৃত্যু শুধু সময়ের অপেক্ষা।
শক্তিহীন অথচ সাড় থাকা পেশীগুলো আস্তে আস্তে জবাব দেয় তাদের কাজে।
জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত থেকে যায় দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, মস্তিষ্কের বোধ।
ও এটা জানত। তবুও বলেছিল,
বুঝলি, আমি এই নিয়েই টেনে দেব আরও দশটা বছর।
অনেক কাজ বাকি।
সে টানা আর হয়নি।
মনে মনে যেদিন বুঝেছে আর পারবে না, দিন শেষ হয়ে আসছে,
সেদিন ভলুন্টারী রিটায়ারমেন্ট নিয়েছে কাজ থেকে।
তারপরেও কাজের টানে বার বার ছুটে গেছে তার সাধের গড়া পেন ইনস্টিটিউটে যা আজ সরকারি লেভেলে এক আন্তরজাতিক মানের চিকিৎসাকেন্দ্র।
মাস পাঁচেক আগে ওর বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে ও বলেছিল,
আমি এ রোগে পড়ার পর থেকে আরও বেশি করে অনুভব করি মানুষ আমাকে কত ভালবাসে।
তাই এখন আর খুব একটা খারাপ লাগেনা একে।
মৃত্যুর মাস দুয়েক আগে আমাদের মত কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে ও ডেকেছিল গল্প করতে।
বিছানায় শুয়ে নন ইনভেসিভ সাপোর্ট সিস্টেমে থেকে মুখ বের করে শান্ত গলায় বলেছিল,
নো ট্রাকিওস্টমি।
নো ভেন্টিলেশন।
এসবের আগেই চলে যেতে হবে। দরকারে উইল করে দেব।
দুহাজার তেইশের পাঁচই জুলাই ভোরবেলা ও চলে গেল পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে।
ওর বাবার কাছে।
ওর প্রিয় মান্না দের কাছে,
যাঁর মৃত্যুর পর ও খবরের কাগজে লিখেছিল,
আবার হবে তো দেখা…
রেখে গেল তার নিজের হাতে তৈরি করা অগুন্তি ব্যথা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
ওর মশালের শিখা।
ও একটা মশাল।
ও একটা ইতিহাস।
এক অপরাজেয় যোদ্ধা
ডক্টর সুব্রত গোস্বামী।
আমাদের আদরের টাকো।
জুনিয়রদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার টাকোদা।
থিয়েটার পাগল, লেখক, কবি,গায়ক, কার্টুনিস্ট, বাগ্মী, ভ্রমণপ্রিয়,বন্ধু বৎসল….
অসংখ্য ব্যথা কাতর রোগীর ভরসাদায়ী প্রিয় ডাক্তারবাবু।
বস্, ভাল থেক।
রেস্ট নট ইন পিস,
বাট ইন পাওয়ার,
অ্যাজ উইশড বাই ইয়োর ফেলো বিলিভার।
পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়
১০.০৭.২০২৩
সুব্রত গোস্বামী
(১৯৬৪-২০২৩)
যা লিখতে পারলাম, তার থেকে লিখতে পারলাম না অনেক বেশি।