আজ থেকে দু’হাজার বছর আগের কথা। চম্পকনগর বলে এক সমৃদ্ধ দেশ ছিল। দেশের মানুষের কোনও কিছুর অভাব নেই। গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, ঘোড়াশালে ঘোড়া, হাতিশালে হাতি। শুধু একটাই দুশ্চিন্তা তাদের। মাঝে মধ্যেই দেশের পশ্চিম প্রান্তের খড়্গারন্য থেকে দৈত্য আক্রমণ করে। যখন আসে চারদিক ছারখার করে যায়। রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়ে যায়। দেশের মানুষ ভয়ে থরথর করে কাঁপে। চোখ ফেটে জল আসে। তবু মুখ বুজে সহ্য করতে বাধ্য হয়। দৈত্য যে ভয়ানক শক্তিশালী! দৈত্যের কথামতো না চললে গর্দান যাবে।
সব অত্যাচারিত মানুষই একদিন জেগে ওঠে। প্রতিবাদ করে। চম্পকনগরের মানুষও করলো। সবাই মিলে একযোগে দৈত্যকে আক্রমণ করলো। দৈত্য ভীষণ রাগে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে তেড়ে আসতে শুরু করলো। এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল কয়েকজন। বড় বড় ফাঁদ পেতে দৈত্যকে ধরে ফেলা হয়। হাত-পা বেঁধে লোহার খাঁচার মধ্যে রেখে দেওয়া হয়। অসুবিধে একটাই, এ দৈত্য অমর। মাষ্টারমশাই বলেছেন, নগরের একদম মাঝামাঝি খাঁচাটা রেখে দিতে। যাতে পরের প্রজন্মের চিনতে অসুবিধে না হয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকলে এ দৈত্য রূপ বদলে ফেলে। এমনকি মানবদরদী ভাষণ অব্দি দেয়। শুধু মুখ খুললেই দেখা যায়, দাঁতে রক্ত লেগে আছে।
এরপর বহু বছর কেটে গেছে। মাঝে মাঝেই অনেক দৈত্য আসে। বিভিন্ন তাদের গায়ের রঙ। কেউ লাল, কেউ সবুজ, কেউ নীল-সাদা, কেউ গেরুয়া। যদিও দেশের মানুষ এখন অনেক সচেতন। দৈত্যের চকিত আক্রমণে প্রথমে দিশেহারা হয়ে পড়ে বটে, তারপর ঠিক সামলে নেয়। দৈত্যরা সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে পড়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
এভাবে আরও অনেকদিন কাটলো। এর মধ্যে খাঁচার দৈত্য দাঁত মাজতে শিখে গেছে। দাঁতে লেগে থাকা রক্ত আর দেখা যায় না। গায়ের রঙ লুকিয়ে ধপধপে সাদা জামা গায়ে দেয়। সকাল সকাল উঠেই গলায় একটা তুলসীকাঠের মালা জড়িয়ে নেয়। শ্বদন্তে কলমী শাকের পাতা চিটিয়ে রাখে। বেলা বাড়লে ছোট ছেলেমেয়েরা খাঁচার সামনে আসে। তারা জিজ্ঞেস করে– দৈত্য তুমি কী খাও?
দৈত্য গলার স্বরটাকে কোমল ‘ধা’র মতো করে বলে– শাকপাতা ছাড়া জীবনে কিছু খাইনি।
ছেলেমেয়েরা অবাক হয়। এত ভালো একটা দৈত্যকে বিনা অপরাধে আটকে রাখা হয়েছে কেন? তারা মাষ্টারমশাইয়ের কাছে গিয়ে এই প্রশ্নটাই রাখে। বিনা অপরাধে কাউকে বন্দী করার জন্য ক্ষোভ উগরে দেয়। মাষ্টারমশাই তাদের সব বুঝিয়ে বলেন। তাদের অত্যাচারের যাবতীয় ইতিহাস জানান। তারপর বলেন– মুখে রক্ত লেগে থাকা দৈত্য দেখে সহজেই চেনা যায়। সতর্ক হওয়া যায়। এ হচ্ছে ধূর্ত শয়তান। আরও ভয়ংকর। মুখের সামনে ভালোমানুষ সেজে থাকে। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে। একে কোনোদিন বিশ্বাস করে দরজা খুলে দিও না। মুহূর্তেই রূপ বদলে ঘাড় মটকাবে।
– আমরা তো এসবের কিছুই জানতাম না মাষ্টারমশাই।
– এবার বুঝলে তো, ইতিহাস জানাটা কেন দরকার? দৈত্য মাত্রেই ভয়ংকর। এদের সম্পর্কে সতর্ক থেকো।
এর মধ্যেই খবর এলো দেশে আবার দৈত্য আক্রমণ করেছে। এবার পূর্বপ্রান্ত থেকে। অনেক মানুষ তার আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে। দলে দলে লোকে লাঠিসোটা নিয়ে দৈত্য তাড়াতে বেরোলো।