বাসের জানালার ধারে বৃদ্ধ বসে। মাঘী বাতাসে কাঁপুনি। জানালার কাঁচ নামিয়ে মাথা ঠেকিয়ে ভীড়ের গুঞ্জরণ আর কন্ডাক্টরের হাঁকাহাঁকির ফাঁকে ফাঁকে কখন যেন মশার পিনপিনানির মতোন মৃদু সুরে একটা বহু পুরোনো গান কানে এলো। বুড়ো এদিকে চায় – ওদিকে চায় – গানের উৎস পায় না। পরে দেখতে পেলো মাথার ওপরে একটা ছোট্ট স্পিকার। গানের তালে দুলে দুলে বাস চলছে – ড্রাইভারও দুলে দুলে হাত ঘুরু ঘুরু গাড়ি চালাচ্ছে। ‘বাগোঁ মে বাহার হ্যায়’ …. বৃদ্ধ ডাক্তারের কৈশোর বেলার গান। গানের সঙ্গে কোন যেন মেয়েটির কথা ডাক্তারের মনে পড়ে। শীর্ণকায় – বক্ষসর্বস্ব – মুখে রং মাখা সস্তা ঝকমকে সালওয়ার কামিজ পরা ওড়নাহীনা এক ভীরুনয়না – আপাত অসুন্দর নারী – না না নারী নয়, অপরিণত এক কিশোরী। তখন ডাক্তার কোঁকড়া চুলের এক যুবক – ময়লা কলার জামা – ওষুধের দোকানের ঘুপচি ঘরের গুমোটে ঈষৎ ঘেমো এক ক্লান্ত শরীর মানুষ।
“নাম?”
স- টান উত্তর “ফুল্লরা”
কথোপথনের পরে দুচারটে ওষুধ লেখা – তারপর কামিজের ভেতরের বক্ষবন্ধনীর অন্তরে হাত দিয়ে একটা ছোট্ট মাইনেব্যাগ খুলে দশটা টাকা বার করে বললো “আজ দশটা ট্যাকা রাখো – পরে বাকি দশ দিয়ে যাবোনে”
ঘর্মাক্ত যুবক হাতটাত নেড়ে বলে “ আরে না না ঠিক আছে – বাকি ইয়েটা আর মানে লাগবে না – থাগ্গে”
ফুল্লরার ডাক্তারকে পছন্দ হয়েছে। কদিন পরে ভাইকে নিয়ে আসে। “আজ কিন্তুক ট্যাকা দিতে পারবো না”
তাই সই। মুখচোরা ডাক্তারের তখন দিন চলে না। আজও অবশ্য দিন আনি দিন খাই। ডাক্তার বলে
“ আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে ”
শত হলেও একটা রোগী তো – বলে সারাটা সন্ধে ঘুপচি ঘরে বসে থাকা – নয়তো বেরিয়ে সামনে সত্যনারায়ণ থেকে একটা গজা আর জিলিপি খেয়ে ঢকঢক জল। ক্ষিধে ভ্যানিশ। ফিরে দোকনদারের দয়ার চায়ের জন্য অপেক্ষা। এরপর এলো ফুল্লরার মা। হিজাব বোরখা পরে। হাত টুকু বার করে নাড়ি ধরা। হিজাবের ফাঁকে কালিপড়া সহস্র কুঞ্চন দুটি ফ্যাকাশে চোখ “আমাদের ধর্মে তো মুক দ্যাকানো বারণ ডাক্তারবাবু –”
মুখ দ্যাখা হলো। বুক পরীক্ষাও হলো। রক্ত আর ইউরিন পরীক্ষা করতে হবে শুনে ফুল্লরার পাংশু মুখ আরও সাদা হয়ে গেল। ডাক্তার মাছি তাড়ানোর মতো করে টাকা ফিরিয়ে দিলো। কখনও কখনও গরীব ডাক্তারও সম্রাট হয়ে ওঠে। অনেকটা ঐ হরিপদ কেরানীর আকবর বাদশা হয়ে ওঠার মতো।
পরে ফুল্লরা এলো বিনা প্রসাধনে। যেন সদ্য পড়েছে কবিতার এই লাইনটি কাজল দিতে প্রদীপ খানি মিথ্যে কেন জ্বালো? ইউরিন রিপোর্ট বলছে ইনফেকশন।
“সেরে যাবে” শুনে ফুল্লরার রক্তহীন চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ওষুধ বুঝে বাঁকা ভুরুতে কটাক্ষ হেনে বন্য একটা হাসি উপহার দিয়ে ঝলকিয়ে চলে গেল বনহরিণী। কদিন পরে আবার হাজির। এসে বসে রইলো ডাক্তারের উল্টোবাগের চেয়ারে। নখ দিয়ে রং চটা টেবিলের রং খুঁটতে লাগলো। তারপর বিনা ভূমিকায় বললো “ আমার নাম জাবেদা খাতুন ..”ফের নখ খোঁটাখুঁটি।
“মুসলমান জানলে কাস্টমার আসতে চায় না – ফুল্লরা নামটা সুন্দর না?”
ডাক্তার ঘাড় নাড়ে। “সুন্দর – তুমিও সুন্দর”
“আম্মু ভালো আছে”
ডাক্তার খুশী হয় “চা খাবে?”
“না চা খেলি গায়ের রং কালো হয়ে যাবেনে – এমনিতেই বলে কালিন্দী” খিলখিল করে জাবেদা হাসে। “আমি তো তোমারে ট্যাকা কড়ি দিতে পারিনা..” আবার নখ খোঁটা “একবার আমার ঘরে যাবা?”
হতভম্ব ডাক্তার না বলায় কন্যা ফুঁসে ওঠে “ক্যানো মুসলমানী বলে?” ক্রুদ্ধা বাঘিনীর মতো বিসর্পিল গতিতে চলে যায়।
আবার কতো মাস পর যেন আসে। বসে থাকে নখ খোঁটে। ডাক্তার নীরবতা ভাঙার প্রশ্ন করে “মা কেমন আছেন?”
“এখন আর দেখা হয়নি”
“আসে না?”
“না … ত্যাখন তো অসুক হৈছিল তাই …এখন আসে না”
“তুমি বাড়ি কখন যাও? ঈদে?”
হঠাৎ চিতাবাঘিনীর কাজলচোখে অশ্রুবিন্দু উঁকি দেয় । “বাড়ি যাই না – ইস্টিশনের চায়ের দোকানে মাসের টাকা দিয়ে আসি …. ভাই এসে নে যায়”
“বাড়ি…?”
“আমি তো নষ্ট মেয়েমানুষ – আমি ঘরে গেলে .. গেরস্ত ঘরে …অমঙ্গল.. হবেনে?” উদ্গত অশ্রু হঠাৎ করে পেছন বাগে ফিরে যায় … একগাল হেসে নষ্ট সেই মেয়েছেলে বলে “ও ডাক্তার আমার না অনেক দিন কাশি আর জ্বর … তুমি দেখে দেবা? ট্যাকা কিন্তু নেই .. কদিন লোক বসাতে পারি নি, শরীরটা খারাপ তো?”
ডাক্তার নিরুচ্চার দেখে দেয় । সব পরীক্ষার পর আবার দুজনে দেখা হলো । দুজনেই চুপচাপ । ডাক্তারই নীরবতা ভঙ্গ করে। “শোনো জাবেদা তোমার বুকে দোষ হয়েছে – হাসপাতালে ওষুধ পাবে… টিবি হাসপাতালে…. আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি তুমি খেলেই ঠিক হয়ে যাবে … আর শোনো আজকাল অনেক বিচ্ছিরি সব রোগ হচ্ছে কাস্টমারকে কন্ডোম পরতে বলবে – বুঝলে?”
অস্থিচর্মসার দেহাঙ্গনা ঝর্ণার মতো হাসে
“নাগো .. নাগর তো পয়সা দিয়ে আমার শরীরের সুখ খুঁড়তে আসে – ওসব পর্লি কি সুখ হবে? কেউ শুনবে নে”
দিন যায় – সপ্তাহ – আর এক সন্ধ্যাবসানে জাবেদা নাকি ফুল্লরা নাকি এক কঙ্কালিনী আসে – সেন্ট ছাপিয়ে সস্তা মদের গন্ধে ভুরভুর করছে সেই বারাঙ্গনা । হনু উন্নত – স্তন মিশে গেছে বুকের খাঁচায়।
“ ফুল্লরা তুমি ওষুধ খাচ্ছো না?”
“আমি হাসপাতালে গেলি পরে সব্বাই জেনে যাবে – একটা কাস্টমারও আর আসবে নে…” ফুল্লরা কাঁদে। ভাঙা দুগাল বেয়ে সস্তার অশ্রু গড়িয়ে পড়ে উন্মুখ কন্ঠা হয়ে ছিন্ন বস্ত্রের ’পরে।
অসহায় ডাক্তার বেচারা ক্লান্ত মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দ্যায়। ফুল্লরা ডাক্তারের বুকে মাথা রেখে কাঁদতেই থাকে। তারপর একদিন ডাক্তার সত্যিই ফুল্লরার বেশ্যাপাড়ার কুঠিতে যায়।
সন্ধ্যা থেকেই একটি লম্পট শুর্মা চোখের যুবক দোকানে দাঁড়িয়ে ছিলো। ডাক্তার বেরোতেই বললো “ডাক্তারবাবু ফুল্লরা মরে গেছে একবার .. একটা ইয়ে …মানে…” মদগন্ধী দালালটি বোঝাতে পারে না প্রয়োজনটা।
ডাক্তার রংচটা অ্যাটাচি নিয়ে নীরবে তাকে অনুসরণ করে .. করতেই থাকে। একটু এগিয়েই গড়িয়া মোড়। তার পাশে অন্ধকার জ্বালানো গলি। দশ-বারটি রংমাখা নারীশরীর দাঁড়িয়ে আছে। একটা অনুজ্জ্বল ঘরে একটা কাপড় পরা শায়িত কঙ্কাল। বেশ্যাপাড়ার মালকিন মাসি – নিশ্বাসে যার চুল্লুর গন্ধ – এক কোণে নাকে আঁচল দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তার সার্টিফিকেট লিখে ফুল্লরার পায়ে হাত ছোঁয়ায়। মাসির বোধহয় অবাক লাগে।
“জানো না? বেশ্যাবাড়ির মাটি না হলে মা দুগ্গা ঘরে আসে না? আমি আজই জানলাম” ডাক্তার মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসে বাড়ির দিকে।
রূঢ় করুণ বাস্তব।
??
সত্যিই
আমার মনে হয়, সমস্ত বেশ্যা নারী দেরকে cervical cancer এর টিকা Gardasil দেওয়া উচিত ও ligation করানো উচিত।
হা হা হা হা হা হা হা
বাস্তবের মুখোমু।
মুখোমুখি।
সারা জীবনই তাই
মর্মস্পর্শী
এই পেশার মেয়েদের বেশিরভাগই বঞ্চিত