খবরের কাগজ পড়ি না, টিভি দেখি না…..সে বহুদিন হ’ল। চারপাশের খবরও আর সেভাবে পাই না। কোভিডের গ্রাফ কদ্দূর উঠে আর কদ্দূর নেমে গেল, ভ্যাক্সিন ঠিক কোন স্টেশনে দাঁড়িয়ে সেসব আমার জানা নেই। শুধু প্রতিদিন সহকর্মীদের অকালে ঝরে যাওয়ার খবর পাই। নীরবে শ্রদ্ধা জানানো ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। কাজ, ব্যায়াম, বই, খুব দরকারি কিছু হাতে গোনা ফোন আর ঘুম.. এই নিয়েই আপাতত থোড়-বড়ি-খাড়া জীবনের রোজনামচা।
গত পরশু কেউ একজন না বললে জানতেই পারতাম না আজ মহালয়া। শুধু আমি নয়, সহকর্মীদের বেশিরভাগের দশা-ই এরকম। আজই যেমন একজনের সাথে প্রায় একচোট হওয়ার উপক্রম। তিনি কারও কাছে শুনেছেন আজ বিশ্বকর্মা পুজো। আমি শুনেছি মহালয়া। দুজনেই নিজেদের দাবী নিয়ে অনড়। কেউ কাউকে এক ইঞ্চি ছেড়ে কথা বলছি না। প্রায় মিনিট দশেক তর্কাতর্কির পর যখন জানা গেল আজ আসলে দুটোই.. যাক গে! নিজেদের ভেবলে যাওয়ার মুখের সামনে আয়না ধরে নি কেউ।
সিনিয়র ম্যাডাম গতকালই বলে রেখেছিলেন আজ খুব সকালে রাউন্ড দেবেন। সেইমতো আমরা ‘ছোট ডাক্তার’রা ওয়ার্ডে ভিড় জমিয়েছিলাম। নবজাতকের ওয়ার্ড। এ এক বিচিত্র রাজ্য! কোনও ব্যাটা উল্টে পেছন উঁচু করে শুয়ে আছে, কাউকে দুধ খাওয়াতে গিয়ে মা আর নার্সদিদি জেরবার, কেউ জন্মগত অঙ্গবিকৃতি নিয়ে প্রতিকূল পরিবেশের সাথে লড়ে যাচ্ছে, কারও সকাল সকাল চিল চিৎকারে কান পাতা দায়, কেউ জীবাণু সংক্রমণে ধুঁকছে, কারও মাথা অব্দি জন্ডিস পৌঁছে গেছে, কেউ খিঁচুনিতে মৃতপ্রায়। ভেতরে রোগজর্জর সদ্যোজাত আর বাইরে উদ্বিগ্ন বাড়ির লোক- এর মাঝে পড়ে প্রায় চিড়েচ্যাপ্টা অবস্থা।
এরই মধ্যে ইমার্জেন্সিতে প্রবল শ্বাসকষ্ট নিয়ে এসে পড়েছে এক অপরিণত নবজাতক। শ্বাসকষ্টে ধুঁকতে ধুঁকতে ছোট্ট শরীরটা নীল। ফুসফুস ফুলিয়ে রাখার তরল সঠিকভাবে তৈরি হয়নি। ফলে বুকের খাঁচা চুপসে যাচ্ছে বারবার। অনেক কসরত করে তাকে খানিক স্থিতিশীল করতে না করতে পাশের বেডের বাচ্চার রক্তশর্করার মাত্রা পড়ে এসেছে! আবার ত্রাহি ত্রাহি রব!
সব সামলে-সুমলে এবার ছুটি লেখার পালা। আইভিএফ হওয়া মায়ের বাচ্চাটার আজ ছুটি। পেটের ইনফেকশন, জ্বর নিয়ে ভর্তি হয়েছিল। পেট ফুলে জয়ঢাক, সঙ্গে বমি আর জলশূণ্যতা। এক সপ্তাহ বাদে সে আজ সুস্থ হয়ে বাড়ি যাচ্ছে। ছুটি লেখার সময়েও খেয়াল করিনি, বাচ্চার নাম অদ্রিজা! আবাহনের দিন সমাগত। মায়ের তো এবার বাড়ি ফেরারই পালা..
পুজোর আচারে বিশ্বাস হারিয়েছি বহুদিন। মহালয়ায় ভোরে ওঠা, রেডিও শোনা.. সেসবেরও পাট চুকেবুকে গেছে। মহালয়ার আর নতুন কোনও অর্থ খুঁজে পাই না। তবু এখনও স্যাঁতসেঁতে সকাল, কাশফুল আর বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্রপাঠ শুনলে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যাই। কড়া অ্যান্টিবায়োটিক, ভেন্টিলেটরের অ্যালার্ম, রক্তের ব্যাগ, স্টেথোস্কোপ, স্যানিটাইজার, স্যালাইন.. সবকিছুর মধ্যে থেকেও সবকিছুর থেকে বহুদূরে এ আমার একান্ত অবসর। আমার বিবর্ণ অসামাজিকতায় দু-এক পোঁচ রঙ।
বাইরে রাস্তাঘাট ফাঁকা। পুরো ছুটির আমেজ। যদিও একমাস বাদে পুজো আর করোনা মিলিয়ে সেই চেনা উদ্দীপনা নেই। তবু নতুন করে বেঁচে ওঠার গান বাজতে শুরু করেছে।
মারীর দেশের উৎসবের দিনে আমাদেরও সময় হয়ে এল। ‘অসুর’ সাজার।
***************
চিত্রগ্রাহকঃ মনোজিত খামরাই। গতবছর শালবনীতে তোলা।