৬ই মে, ২০১৫ মাঝ রাতে শেষ নিঃশ্বাসত্যাগ করলেন ফাগুরাম যাদব, আমার একসময়ের সহযোদ্ধা। আধুনিক ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের কথা বলতে গেলে এসে যায় ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ-এর কথা, শ্রমিক সংঘের প্রধান সংগঠক শংকর গুহ নিয়োগীর নাম, দল্লী-রাজহরার বীর লোহা খনি শ্রমিকদের সংগ্রাম-আত্মত্যাগ-বিজয়ের কাহিনী; নিপীড়িত জাতিসত্ত্বাগুলির মুক্তি আন্দোলনের কথা বলতে গেলে ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার কথা আসে, তেমনই ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ ও ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার কথা বলতে গেলে আসে ফাগুরাম যাদবের নাম। এই আন্দোলনের প্রধান গীতিকার ছিলেন ফাগুরাম।
ফাগুরাম কোনও মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী ছিলেন না, ছিলেন লোহাখনির ট্রান্সপোর্ট শ্রমিক, ট্রাকে লোহাভরা যাঁর কাজ। গ্রামের পাঠশালায় চতুর্থ শ্রেণীর বেশী পড়া হয়ে ওঠেনি তাঁর। রায়পুর জেলার চঁওর গ্রামে ১৯৮৬-এ ফাগুরামের জন্ম। বাবার মৃত্যু হয় ছোটবেলায়, মা সবজি বিক্রি করে সন্তানদের প্রতিপালন করতেন। অন্যের ভাঙা স্লেটের টুকরো জোগাড় করে পাঠশালার গুরুমশাইয়ের ফাইফরমাশ খেটে পড়াশুনা ফাগুর। চতুর্থ শ্রেণীর পর জীবিকার জন্য শুরু করতে হয় অন্যের জমিতে কৃষি-শ্রমিকের কাজ। ছোটবেলা থেকে ফাগু এক বিশেষ গুণের অধিকারী ছিলেন—গ্রামে ঘটে যাওয়া যে কোনও ঘটনাকে গানে রূপ দিয়ে সুর দিয়ে গাইতে পারতেন তিনি।
১৯৭৩-’৭৪ সালে ছত্তিশগড়ে এক ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ হয়। সে সময় কাজের খোঁজে ফাগুরামের দল্লী-রাজহরায় আসা। তখন থেকেই ভিলাই স্টীল প্ল্যান্টের দল্লী লোহাখনির ঠিকাদারী ট্রান্সপোর্ট শ্রমিক ফাগুরাম।
সে সময়ে ঠিকাদারী শ্রমিকদের ওপর চলত অমানবিক শোষণ—ভোরের অন্ধকার থাকতে ঠিকাদারের ট্রাক শ্রমিকদের তুলে নিয়ে যেত, ১৪-১৫ ঘন্টা কাজ করার পর ভর সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা, এতো মেহনতের পর দৈনিক মজুরি মিলত ২-৩ টাকা। দুই প্রতিষ্ঠিত ইউনিয়ন আইএনটিইউসি ও এআইটিইউসি শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা না করে রক্ষা করত ম্যানেজমেন্ট ও ঠিকাদারদের স্বার্থ। এই দুই ইউনিয়নের এক অন্যায্য বোনাস-চুক্তির প্রতিবাদে শ্রমিকরা ইউনিয়ন ছেড়ে বেরিয়ে এসে গঠন করেন নিজেদের স্বাধীন ইউনিয়ন—ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ, ১৯৭৭-এর ৩রা মার্চ। পুরানো দুই ইউনিয়নের তেরঙ্গা ও লাল পতাকার বদলে তাঁরা হাতে তুলে নেন লাল-হরা (লাল-সবুজ) পতাকা—শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর প্রতীক। ইউনিয়ন গঠনের ঠিক তিন মাস পরে ঘর সারানোর দাবীতে বাঁশ-বল্লী কেনার জন্য ভাতার দাবীতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের আন্দোলন ভাঙ্গতে গুলি চালায় পুলিশ, এগারো জন শহীদ হন। শ্রমিক আন্দোলনে অনুপ্রাণিত ফাগুরাম নতুন ধরনের গান লেখা শুরু করেন—সংগ্রামের গান, রাজনৈতিক চেতনা প্রচারের গান। তারপর থেকে ফাগুরামের কলম কখনও থেমে থাকেনি। ১৯৯১-এর ২৮শে সেপ্টেম্বর কমরেড শংকর গুহ নিয়োগীর হত্যার কয়েক বছর পর আন্দোলন দুরবল হওয়ায় লেখনী স্তিমিত হয়েছে বটে কিন্তু থেমে যায়নি।
ফাগুরামের প্রতিভার যথাযথ বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা বা যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৪ তিনি আমার সহযোদ্ধা ছিলেন, তাই আমাকে লিখতে হচ্ছে। লিখছি বাংলায়, ফাগুরাম গান লিখতেন ছত্তিশগড়ীতে, তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য গানের অক্ষম বাংলা অনুবাদ করে বোঝানোর চেষ্টা করব কেমন গীতিকার ছিলেন তিনি। ১৯৮৯-এ ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার প্রকাশন বিভাগ লোক সাহিত্য পরিষদ প্রকাশ করেছিল ‘ফাগুরাম যাদব কে চুনে হুয়ে গীত’। তা থেকেই গানগুলি সংগৃহীত।
প্রথম পর্যায়ের গানগুলিতে ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘের জন্ম ইতিহাস সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
‘ছত্তিশগড় কে মজদুর মন হা দল্লী রাজহরা মা আইন গা, লোহা কে পত্থরা লা ফোর-ফোর কে ভিলাই লা উৎপাদন করাইন গা, সদা উৎপাদন বর জোর লগাথে ইয়ে মজদুর কে বানী গা। লোহা কে পথরা ফোরাইয়া মন হা অপন পসীনা বোহাইন গা, দিন ভর করীন কড়া মেহনত গা সহী মজদুরী নই পাইন গা। আঘু মা রোহিন দলাল মন হা লুট-লুট কে খাওন লগীস, ছত্তিশগড়িয়া মজদুর উপর শোষণ অত্যাচার হোওন লগীস। তব পাপী মন বর জন্ম ধরীস দু রঙ ওয়ালা নিশানী গা। … ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ হা জব জনম ধরকে আইস গা, শোষণ লে মুক্তি করেবর হর মজদুর লা জগাইস গা, জাগ উঠীন সব মজদুর সাথী, দুশমন হোগে হৈরানী গা।’
(ছত্তিশগড়ের শ্রমিকরা দল্লিরাজহরায় এসেছিল লোহা পাথর ভেঙে ভিলাইকে জোগান দেওয়ার কাজে। ম্যানেজমেন্ট চায় উৎপাদন আরও উৎপাদন। পাথর ভাঙার দল কতই না ঘাম ছোটায়, কিন্তু মেলে না ন্যায্য মজুরি। দালাল নেতারা শ্রমিকদের লুটতে থাকে, ছত্তিশগড়ী মজুরের দুঃখের শেষ নেই। এমন সময় জন্ম নিল দু-রংওয়ালা পতাকা। জন্ম নিল ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ, তার আহ্বান শোষণ থেকে মুক্তির। শ্রমিকরা জেগে উঠল, আতঙ্কিত মালিকরা।)
অন্য একটি গানের অংশবিশেষের অনুবাদঃ
হাজার হাজার শ্রমিকের ইঁট জোড়া হয়েছে একতার সিমেন্টে, তৈরি হয়েছে লোহার দেওয়াল বাঁধ। বাঁধ থেকে নালী বয়ে গেছে বিলাসপুরে তে, রাজনাঁদগাঁও, দানীটোলায়। যে স্নান করেছে এ জলে সে নতুন মানুষ।
লাল-সবুজ পতাকার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে ফাগু লিখেছেন—
‘মেহনতকশ কে হিতকারী হে ইয়ে দু রঙ ওয়ালী নিশানী হ্যাঁয়, লাল রঙ মজদুর মনকে অউ হরিহর রঙ কিসানী কে, দোনোঁ রঙ একি মেঁ মিলকে জইসে গঙ্গা যমুনা কস পানী হে… লড়নে মেঁ বড়া বাঁকা হে, ইয়ে দু রঙ ওয়ালা পতাকা হে, মজদুর কে খুন মা রঙ্গে হাবে, দুশমন বর এক ধমাকা হে..য়ে…’
(মেহনতি মানুষের মুক্তিকামী এ দু-রঙা নিশান, লাল রং শ্রমিকের, সবুজ কৃষকের, দু-রং মিলেছে, যেমন মেলে গঙ্গা-যমুনার জল। লড়াইয়ের আঁকাবাঁকা পথে চলতে এর কোনো ভয় নেই, শ্রমিকের রক্তে রাঙা এ পতাকা, এ শত্রুর কাছে আতঙ্ক।)
১৯৭৭ সালে ইউনিয়ন তৈরি হওয়ার পর শ্রমিকের প্রথম আন্দোলন ছিল ঝোপড়ি মেরামতের বাঁশবল্লীর দাবিতে। আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশগুলি চালায় ২রা ও ৩রা জুন, ১১ জন শহিদ হন। গুলি চালিয়ে শ্রমিক আন্দোলনকে দমন করা যায়নি। শহিদদের আত্মত্যাগ দল্লিরাজহরার শ্রমিকদের সংগ্রামকে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে, একের পর এক বিজয় হাসিল করতে থাকেন তাঁরা। শহিদদের স্মৃতিতে ফাগুর গান—
‘শহীদ ভগৎ সিংহ, বীরনারায়ণ সিংহ, অনুসুইয়া বাঈ, জগদীশ ভাই, ইয়ে সব এক হ্যাঁয় এক হ্যাঁয়। ইনকে সংঘর্ষ আজ ভী জারী হ্যাঁয়, আজ কা সংঘর্ষ হমারী বারী হ্যাঁয়, মরনা হ্যায় তো মরেঙ্গে ফির ভী বড়তে জায়েঙ্গে, তুমহারে অরমান পুরে করতে জায়েঙ্গে। হর জুল্ম, হর অত্যাচার জুঝেঙ্গে হম বার বার, মজদুর কিসান মিলকে আজ উঠায়েঁ হ্যায় হথিয়ার, শহীদোঁ কে খুন সে হম সব হ্যাঁয় তৈয়ার)…’
(শহিদ ভগৎ সিং, বীর নারায়ণ সিংহ, অনুসুইয়া বাই, জগদীশ ভাই। এরা সবাই এক, এদের কোনো ফারাক নেই। এদের সংগ্রাম আজও আমরা জারি রেখেছি, আজও আমাদের সংঘর্ষ আরও তীব্র, মরতে হয় তো মরব, তবুও এগিয়ে যাব, তোমাদের স্বপ্ন সফল করব আমরা। প্রতিটি জুলুম, প্রতিটি অত্যাচার রোধ করব আমরা বারবার, শ্রমিক কৃষক আজ উঠিয়েছে হাতিয়ার, শহিদদের রক্তে আজ আমরা তৈরি।)
অর্থনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি অন্যান্য ফ্রন্টেও কাজ শুরু করে শ্রমিক সংঘ। সবখানেই সাঙ্গীতিক রূপকার ফাগু। ফাগু অন্যান্য শ্রমিকশিল্পী রামলাল, লখন, ইত্যাদিদের সঙ্গে নয়া গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রসারে গড়ে তোলেন ‘নয়া আঞ্জোর’ সাংস্কৃতিক সংস্থা, নয়া আঞ্জোর-এর অর্থ—ভোরের সূরযকিরণ। সংস্থার সবকটি অনুষ্ঠানে যে গানটিতে সংস্থার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করা হতো সেটিও ফাগুর লেখা—
‘গাঁও কে গলী গলী খোর খোর নওয়াঁ অঞ্জোর বগরাবো রে সঙ্গী নওয়াঁ অঞ্জোর বগরাবো। নওয়াঁ অঞ্জোর কে লাল কিরণ সব জগহ বগরহী, সব জগহ বগরহ্ আঁখী সবকে খুল জহী অঁধিয়ারী রাত টরহী, অঁধিয়ারী রাত টরহী, হো জহী বিহান জাগহী মজদুর অউ কিসান…’
(গ্রামের গলি গলিতে ছড়াবো নয়া আঞ্জোর, ছড়াবো নতুন সূরযের কিরণ, নতুন সূরযের লাল কিরণ, সর্বত্র ছড়িয়ে যাবে, মানুষ চোখ মেলে তাকাবে, কেটে যাবে রাতের অন্ধকার। ভোর হবে, জেগে উঠবে মজদুর আর কিষাণ।)
১৯৮০-৮১ সালে শুরু হয় সি এম এস এস-এর ‘স্বাস্থ্য কে লিয়ে সংঘর্ষ করো’ (স্বাস্থ্যের জন্য সংঘর্ষ করো) আন্দোলন। ফাগু লেখেন—
‘চল সঙ্গবারী রে মিতান, স্বাস্থ্য বর গা সংঘর্ষ করবো ইয়ে জিনগী কে করবো গা সুধার, হম গা বীমার মা কাবর মরবো।’
(চলো সাথী, চলো বন্ধু, স্বাস্থ্যের জন্য লড়াই করতে চলো, জীবনে আনব রে সুধার, আর কেন রোগে ভুগে মরব।)
সি এম এম এস-এর মদ্যপান বিরোধী আন্দোলনেও ফাগুর কলম চলে—
‘শরাবী ভাইয়া রে মত পিবে বটলকে শরাব লা।, মত পিবে বটলকে শরাব লা।‘
শোষণমুক্তির জন্য আন্দোলনরত মানুষকে অনুপ্রেরিত করে তাদের পূর্বজদের সংগ্রামের ইতিহাস, আত্মদানের ইতিহাস। ছত্তিশগড়ের প্রথম শহিদ ছিলেন নারায়ণ সিংহ, ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কিষাণ বিদ্রোহের নেতা ছিলেন তিনি। ইংরেজ শাসকেরা এবং তৎপরবর্তী শাসকবর্গ নারায়ণ সিংহকে ডাকাত আখ্যা দিয়ে বিস্মৃতির অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখেছিল। বীর নারায়ণ সিংহের কাহিনিকে জনসমক্ষে আনে ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চা। এই কাহিনিকে জনবোধ্য করে ছত্তিশগড়ের গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার কাজও করেছে ফাগু।
মধ্যপ্রদেশে দক্ষিণে ও পূর্বে সাতটি জেলা নিয়ে ছত্তিশগড়। ছত্তিশগড়ের জমি এতই উর্বরা ছিল যে, ছত্তিশগড়কে ধানের ডালা বলা হত। বিপুল এখানকার বনজ সম্পদ, বিশাল খনিজ ভাণ্ডার। তবু গ্রামে গ্রামে বেকারি ও দুর্ভিক্ষ, সেচের জল নেই, জঙ্গলের উপর আদিবাসী জন্মগত অধিকার আজ লুপ্ত, ছত্তিশগড়েরই শিল্প উদ্যোগে ছত্তিশগড়ী জনতার কাজ মেলে না। ফাগুরাম তার একদিকে যেমন ছত্তিশগড়ের দুঃখ-বঞ্চনার কাহিনি শুনিয়েছেন, তারই পাশাপাশি মুক্ত ছত্তিশগড়ের আহ্বান রেখেছেন—
‘জন সংগঠন, জন আন্দোলন, জন যুদ্ধ কে রস্তা মা আঘু বড়ো, ছত্তিশগড় কে মুক্তি কে খাতির, সঙ্গী কোই জতন করো। ইয়ে ভুইয়া কে হম সব বেটা ইয়ে মাটী কে রক্ষা করো। …ইয়ে ভুঁইয়া কে মালিক আবে ইহাঁ কে মজদুর কিসান হা গা, তেকর বেটা সরহদ মা লড়ত হে দেশ কে উহী জওয়ান ইয়ে গা। অত্যাচার শোষণ লা ভগাবো কদম কদম সব বড়তে চলো।’
(জন সংগঠন, জন আন্দোলন, জনযুদ্ধের পথে আগে বাড়ো। ছত্তিশগড়কে মুক্ত করতে সাথী তোমরা প্রয়াস করো। এ মাটির সন্তান আমরা, এ মাটিকে রক্ষা করব। এ মাটির মালিক এ দেশের মজদুর কিষাণ, এদের পুত্র নওজোয়ান। অত্যাচার শোষণ দূর করতে কদম কদম আগে বাড়ো।)
লাল-সবুজের ঝান্ডার সবচেয়ে বড়ো কৃষক আন্দোলন রাজনাদগাঁও জেলার নাদিরা গ্রামে হয়। ১০০ বছরেরও আগে নাদিরা গ্রামবাসীরা দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করতে সামুহিক এক তহবিল গঠন করেন, কবীরপন্থী, তাই সম্পত্তি এঁরা জড়ো করেন কবীর সাহেবের মঠের নামে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্পদ বাড়তে থাকে। পরে উত্তরপ্রদেশে থেকে আসা এক মহন্ত আত্মসাৎ করে। গ্রামবাসীরা মহন্তর হাত থেকে ভূসম্পদ উদ্ধার করেন এবং জমির উপর সার্বজনীন অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। এ আন্দোলনে গ্রামবাসীদের পুলিশি দমনপীড়নের মোকাবিলা করতে হয়। এ সময় ফাগু গেয়ে ওঠেন—‘অত্যাচার কা বদলা লো’ (অত্যাচারের বদলা নাও)।
ছত্তিশগড়ের প্রথম শিল্প উদ্যোগ ছিল রাজনাদগাঁও শহরের বেঙ্গল নাগপুর কটন মিলস, এ কারখানার শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসও খুব পুরোনো। ১৯২০ সালে এ কারখানার শ্রমিকরা ৩৭ দিন ব্যাপী এক হরতাল করেন। ১৯২৩ সালে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন জরহু গোঁড়। ১৯৪৮ সালে জ্বালাপ্রসাদ এবং রামদয়াল। ১৯৮৪ সালে বি এন সি মিলে লাল-হরা ইউনিয়ন গঠিত হয়। শ্রমিকরা উন্নত কর্ম-পরিবেশের দাবিতে আন্দোলন করেন, শহিদ হন জগৎ, রাধে, মেহন্তর এবং ঘনারাম। ফাগুরামের গানে ধরা আছে এই অতীত এবং বর্তমানের সংগ্রাম কাহিনি।
বিকাশের নামে শিল্পে মেশিন লাগিয়ে শ্রমিকদের ছাঁটাই করা মালিকদের নীতি। সরকার দল্লিরাজহরার লোহা খাদানে মোস্ন বসাতে চায়। সি এম এস এস ১৯৭৮ থেকে আন্দোলন করে ১৯৯৪ অবধি মেশিনিকরণকে রুখে রেখেছিল। এ আন্দোলনে ফাগুর লেখাঃ
‘আগে মশীনীকরণ কে রাজ, জুচ্ছা কর দেহী সবকে হাথ, জাগো মজদুর কিসান হো। বেরোজগারী হা অইসে বাড়ে হে, অউ আঘু বড় জাহী রে, মেহনতকশ জনতা হা, বিন মৌত মারে জাহী রে, ফির হোহী অনর্থ বাত, সব পীটত রবো মাথ। জাগো মজদুর কিসান হো। আয়ে বিদেশী মশীন সঙ্গী, দেশ মা ডেরা জমাওত হে, ইহাঁ কে কমইয়া মনকে, হাথ লে কাম নঙ্গাওত হে, ইয়ে মে ভিড়ে হাবে দলাল, হোওত হাবে মালামাল, জাগো মজদুর কিসান হো।‘
(এসেছে মেশিনিকরণের রাজ, কেড়ে নেবে সবার হাতের কাজ, জাগো মজদুর, কিসান হো। বেকারি তো আছেই, বেকারি আরও বাড়বে, হায়, মেহনতি মানুষ মারা পড়বে। তখন মাথা চাপড়ে লাভ নেই, জাগো মজদুর কিসান হো। দেশের মাটিতে ডেরা বাঁধছে বিদেশি মেশিন, দেশের শ্রমিকদের কাজ কেড়ে নিতে। হুঁশিয়ার হও, জোর আওয়াজ তোল, জাগো মজদুর কিসান হো।)
ছত্তিশগড় আন্দোলনের অন্যতম লড়াই ভিলাই শ্রমিক আন্দোলন, ১৯৯০-এ শুরু হওয়া এই আন্দোলনে ভিলাই ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ার প্রায় ৩০ কারখানায় ইউনিয়ন গড়ে ওঠে, শ্রমিকরা সংগঠিত হওয়ার অধিকারের দাবীতে, বেঁচে থাকার উপযুক্ত বেতনের দাবীতে আন্দোলন চালান। আন্দোলনকে দমন করতে শ্রমিকদের কাজ থেকে বরখাস্ত করা, গুন্ডা-পুলিশের আক্রমণ, নিয়োগীকে জেলবন্দী করে রাখা, ছত্তিশগড়ের ৭টি জেলার মধ্যে পাঁচটিতে নিয়োগীর প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা, অবশেষে ১৯৯১-এর ২৮শে সেপ্টেম্বর গুপ্ত ঘাতক দিয়ে নিয়োগীকে হত্যা করা ও ১৯৯২-এর ১লা জুলাই পুলিশী গুলি চালনায় ১৬ জন শ্রমজীবী মানুষের মৃত্যু—এই পরযায়ে শ্রমজীবী শিল্পীদের নেতৃত্ব দেন কমরেড ফাগুরাম।
কমরেড গুহ নিয়োগীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্য—‘শংকর গুহা নিয়োগী লা ভইয়া করথোঁ মেঁহা লাল সলাম’। ছত্তিশগড়ী ভাষায় লিখিত এই দীর্ঘ গীতিকবিতাটি পাবেন www.sanhati.com –এ ছত্তিশগড় আন্দোলনের আর্কাইভে।
ফাগুরামের গানের কিছু উদাহরণ দিলাম মাত্র। ছত্তিশগড়ী ভাষায়, লোকসঙ্গীতের সুরে ফাগুর উদাত্ত কণ্ঠে না শুনলে অবশ্যই এগুলির পূর্ণ রস আস্বাদন করা যায় না। ১৯৯২ সালে ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার উদ্যোগে গণসঙ্গীত শিল্পী বিপুল চক্রবর্তীর আয়োজনে কলকাতায় ফাগুরামের ৮টি গান রেকর্ড করা হয়, ক্যাসেট বেরিয়েছিল ‘লাল হরা ঝন্ডা হমর’ নামে। সেই ক্যাসেটটি এখন আর পাওয়া যায় না। ফাগুরামের মৃত্যু পর বিপুলদা উদ্যোগ নিচ্ছেন গানগুলিকে ফেসবুকে পোস্ট করার, সিডি বার করারও পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
শেষ করার আগে ব্যক্তি ফাগু সম্পর্কে কিচু না বললে লেখা অপূর্ণ থেকে যাবে। ফাগুরামকে আমি একদম কাছ থেকে দেখেছি আট বছর, যখন আমি ছত্তিশগড়ে ছিলাম। প্রতিদিন সকালে ছেঁড়া হাফপ্যান্ট আর লাল হয়ে যাওয়া গেঞ্জি পরে খাদান যাওয়া, ফিরে এসে ঘরের কাজ অথবা ইউনিয়নের কাজ। শ্রমিক সংঘের স্বচ্ছ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিব সম্পন্ন শ্রমিক অ্যাক্টিভিস্টদের মধ্যে ফাগু একজন, বিপুল তাঁর কলাভাণ্ডার। অথচ কোনো দম্ভ নেই, কোনো অহমিকা নেই। ফাগুর সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি—ফাগু তাঁর এলাকায় দ্বিশতাধিক শ্রমিকের নির্বাচিত ইউনিয়ন প্রতিনিধি। সবাই এক বাক্যে বলতেন –মানুষ হিসাবে অপূর্ব মানবিক গুণের অধিকারী ফাগু। ফাগুরাম কিন্তু ফাগুরাম হয়ে উঠতে পারতেন না যদি না থাকত দল্লি রাজহরায় জঙ্গী শ্রমিক আন্দোলনের ধারা, সঠিক সাংগঠনিক নেতৃত্ব।