ভদ্রমহিলার অবস্থা জটিল। হেন রোগ নেই, ওনার শরীরে খুঁজলে পাওয়া যাবে না। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হৃদপিণ্ডের। বছর পাঁচেক আগে হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। তারপর ইশ্চেমিক কার্ডিও মায়োপ্যাথি হয়ে গেছে। দুর্বল হার্ট কোনও রকমে রক্ত ঠেলে ঠেলে পাঠাচ্ছে। যেকোনো সময়ে হাল ছেড়ে দেবে।
তাছাড়া ডায়াবেটিস আছে। হাইপার-টেনশন আছে। পিত্ত থলি পাথরে ভর্তি। মাঝে মাঝেই ব্যথা ওঠে। কিন্তু কোনও চিকিৎসকই অস্ত্রোপচার করতে রাজি হন নি। তিনি ভেলোর ঘুরে এসেছেন। লাভ হয়নি।
দুই পা হাঁটলেই ভদ্রমহিলার হাঁফ ধরে। বসে থেকে থেকে ওজন একশ কেজি ছাড়িয়েছে। কিন্তু ওজন কমানোর মতো কিছু করেও উঠতে পারছেন না।
ভদ্রমহিলার স্বামীর অবস্থাও ভালো নয়। ধূমপান করে করে হাঁপানি বাধিয়েছেন। তবু ধূমপান ছাড়বেন না। একমাত্র মেয়েও বিয়ের পর ব্যাঙ্গালোরে থাকে। বাবা মায়ের সাথে যেটুকু যোগাযোগ ওই ফোনেই।
এই অবস্থায় সাধারণত রোগীরা মানসিক অবসাদে ভোগে। রাতের ঘুম চলে যায়। ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। এই ভদ্রমহিলা কিন্তু দিব্যি আছেন। যদিও এনার রাতের ঘুম ভালো হয় না। তবে সেটা অবসাদের জন্য নয়, হৃদপিণ্ডের দুর্বলতার জন্য। শুলেই ওনার শ্বাসকষ্ট হয়। মাথার নিচে তিন চারটে বালিশ দিয়ে খাটের সাথে প্রায় ৪৫ ডিগ্রি কোণ করে তবে তিনি ঘুমাতে পারেন। তাও দু তিন ঘণ্টার জন্য।
ভদ্রমহিলা আজ ঢুকেই বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, আবার জ্বালাতে এলুম। কাল থেকে পেটে ব্যথা শুরু হয়েছে।‘
বললাম, ‘এইতো কদিন আগেই পেটে ব্যথা নিয়ে এসেছিলেন।‘
‘হ্যাঁ, সেটা তো বেশ কমে গেছিল। তবে এবারে হয়েছে নিজের দোষে। গতকাল একটু বাইরের দোকানের বিরিয়ানি খেয়েছিলাম।‘
রাগ দেখিয়ে বললাম, ‘পেট ভর্তি পাথর নিয়ে আপনি বিরিয়ানি খাচ্ছেন? আপনার কোনও আক্কেল নেই?’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘কী করব? সময় কাটেনা, মোবাইলে ফেসবুকে নানা জনের পোস্ট দেখি। কদিন ধরেই এক অ-ভদ্রলোক মধ্যমগ্রামের সব বিরিয়ানির দোকানের রিভিউ দিচ্ছেন। তাঁর মধ্যে একটা আবার আমাদের পাড়ার দোকান। ভদ্রলোক লিখেছেন ওই দোকানের বিরিয়ানি না খেয়ে মরলে নাকি আফসোস নিয়ে মরতে হবে। লেখা পড়ে ভাবলুম, আমি তো মরার পথে পা বাড়িয়েই রয়েছি। এই বেলা বিরিয়ানিটা খেয়েই নি।‘
বিরিয়ানির প্রতি আমার বেশ দুর্বলতা আছে। একটু উৎসাহিত হয়ে বললাম, ‘তা কেমন খেলেন?’
‘একেবারে জঘন্য। পুরো ডালডায় ভর্তি। মাটন থেকে বাসী গন্ধ বেরোচ্ছে। ওই অ-ভদ্রলোকটাকে যদি একবার পাই, ওই বিরিয়ানির দাম আর আপনি যে ওষুধপত্র লিখছেন তাঁর দাম আমি আদায় করবই।‘
হেসে বললাম, ‘আসল দোষ তো আপনার। আপনি জেনে শুনে বিষ পান করে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন কেন?’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আপনার সম্পর্কেও আমার অভিযোগ আছে।‘
‘যা বাব্বা, আমি আর কী করলাম?’
‘আপনি আর ফেসবুকে নিয়মিত লিখছেন না কেন? আপনি লেখা টেখা পোস্ট করলে সেটাই পড়তাম। ওসব বিরিয়ানি দোকানের রিভিউ পড়তামই না।’
গম্ভীর ভাবে বললাম, ‘আমি তো লেখক নই। আমার কল্পনা শক্তিও লেখকদের মতো জোরদার নয়। তাছাড়া আমি সারাদিনই প্রায় খুপরিতে কাটাই। পড়াশুনোর সময় পাইনা। ঘুরতে টুরতেও যাইনা, অভিজ্ঞতাও কম। লেখারও সময় কম। লেখা একটা সাধনা। নিয়মিত না লিখে গেলে ভাষার উপর নিয়ন্ত্রণ আসেনা।‘
‘কেন, আপনি তো রোজ কয়েকশো মানুষের সাথে কথা বলেন, তাঁদের সুখ দুঃখের গল্প শোনেন।‘
হেসে বললাম, ‘কোথায় আর গল্প করি। দুচার মিনিট কথা বলি। তাও পুরোটাই রোগসংক্রান্ত। মহৎ কিছু সৃষ্টি ফাঁকিবাজির দ্বারা হয়না।‘
ভদ্রমহিলা হাসলেন। বললেন, ‘মহৎ কিছু জানার জন্য তো আপনার লেখা পড়ি না।‘
‘তাহলে পড়েন কেন?’
‘আমাদের কথা তো কেউ লেখে না। আমাদের জীবনে কোনও নাটকীয়তা নেই। জীবন-যুদ্ধে ওঠাপড়া নেই। সাফল্য বলতে একমাত্র মেয়েকে এক মোটা মাইনের প্রবাসী ছেলের সাথে বিয়ে দিতে পেরেছি। সেটুকু দিয়ে নিশ্চয়ই গল্প হয়না। ‘
‘তা হবে কেন? এতোগুলো বছর আপনি নির্ভয়ে এই সব মারাত্মক রোগের সাথে হাসিমুখে লড়ে যাচ্ছেন, সেটাই বা কম কী? সেটাওতো একটা যুদ্ধ।‘
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘তা আপনি না লিখলে সেই যুদ্ধের গল্প কে লিখবে? কার দায় পড়েছে? কোনদিন ফটাশ করে চলে যাবো, চলে যাওয়ার সাথে সাথে এই পৃথিবী থেকে একেবারে মুছে যাব? না না… ফাঁকি মারলে হবে না, ডাক্তারবাবু। লেখা চাই। যাদের নিয়ে কেউ লেখেনা, সেই হতভাগ্য রুগীদের নিয়ে লেখা চাই।‘
কী আর করি। আজ একটু সময় পেয়েছি, লিখতে বসে গেছি। আজ আবার আমাদের বিবাহবার্ষিকী। বউয়ের সাথে কথাবার্তা না বলে বাড়ি ফিরেই লিখতে বসে যাওয়াটা উচিৎ হয়নি। তবে বউয়ের নাম রূপালী বলেই সাহস পাচ্ছি।