আইনস্টাইনের স্পেশাল এবং জেনারেল রিলেটিভিটি ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের খুব সাধারণ উল্লেখের পরে আমরা আবার আগের আলোচনায় ফিরে আসছি। আগেই বলেছি যে দুটো জায়গায় আমরা আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারি না, একটি বিগ ব্যাং-এর ঠিক পরে কী হল ও অপরটি ব্ল্যাক হোলের কেন্দ্রে। অথচ এই দুই ক্ষেত্র আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুটো জায়গা। আমরা এখনও সেই মহান সমীকরণ পাই নি যা দিয়ে রিলেটিভিটি ও কোয়ান্টাম ফিজিক্সকে আমরা একই সূত্রে বাঁধতে পারব। মিচিও কাকু যেমন বলেছেন, পৃথিবীর সব শ্রেষ্ঠ মস্তিষ্করা এখন শুধু এটাই স্বপ্ন দেখেন যে সেই ‘থিওরি অফ এভরিথিং’ কি হবে? সেই ‘গড ইকুয়েশন’ বা ‘ঈশ্বর সমীকরণই’ বা কী?
এই ভাবনা নিয়েই বেশ কয়েক বছর আগে থেকে বিজ্ঞানের এক নতুন স্তরে চিন্তাভাবনা করা শুরু হয়েছে। আপেক্ষিকতা সবসময় মসৃণ তলের ওপর কাজ করে। তার ব্যাখ্যা বক্রতলের জ্যামিতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। পদার্থের পরমাণুর ভেতরের ‘সাব অ্যাটমিক পার্টিকল’ বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ইলেক্ট্রন, নিউট্রন, প্রোটন, মেসন, বোসন, কোয়ার্ক, নিউট্রিনো এদের আচরণের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স। দুটো তত্ত্বের ভিত্তিভূমি তাই আলাদা।
কিছু কিছু বিজ্ঞানীরা বলছেন আমরা তো পদার্থের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাদের নিয়েই কথা বলছি। কী হবে যদি কোনোভাবে আমরা সেই ক্ষুদ্র কণাদেরকেও ভেঙে দিই? আমরা কণাদের দেখি একেকটা বিন্দু হিসেবে। তারা বলছেন যদি কোনোভাবে আমরা সেই বিন্দুদের ভেঙে দিতে পারি তাহলে কী পাব? তারা বলছেন তাহলে আমরা কিছু রাবার ব্যান্ডের মত ব্যান্ড পাব। তারা আসলে কিছু তারের মত জিনিস যারা প্রত্যেকে একটা নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কে কাঁপছে। প্রতিটি কণার এমনই একটি নির্দিষ্ট কম্পাঙ্ক আছে। তারা ঠিক যেন গিটারের তার। একেকটি তার একেক কম্পাঙ্কে কাঁপছে। কোয়ার্ক, মেসন, বোসন, ইলেক্ট্রন প্রত্যেকের তার আলাদা, তাই তাদের কম্পাঙ্ক আলাদা। তাদের সঙ্গীত আলাদা।
অর্থাৎ এই বিপুল মহাবিশ্ব যেন এক অনন্ত সঙ্গীতের উৎসভূমি। তার হৃদয়ের কেন্দ্র থেকেই যেন নিরন্তর এক গান উৎসারিত হয়ে চলেছে। সেইভাবে ভাবতে গেলে আমরা প্রতিটি জীব, প্রতিটি পদার্থই যেন সেই বিপুল গানের এক সমবায়। কিন্তু সেই সঙ্গীত অব্যক্ত। এই বিরাট মহাবিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলই নিঃশব্দ। বাতাসহীন। তাই কোনো শব্দ তার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয় না। অথচ সেই বিজ্ঞানীদের কথা যদি সত্যি হয় তাহলে আমাদের মেনে নিতে হবে মহাবিশ্ব বোবা তো কি হবে তার অন্তরে সর্বদাই কোনো মহাসঙ্গীত প্রবাহিত হয়ে চলেছে।
এই নতুন তত্ত্বের নামই ‘স্ট্রিং থিওরি’। সারা পৃথিবীতে এই তত্ত্ব নিয়ে বিরাট হইচই চলছে। এই তত্ত্বের প্রবক্তারা দাবি করেন এই তত্ত্ব যে শুধু বিগ ব্যাং- এর পরের ঘটনাক্রমকে ব্যাখ্যা করতে পারে তাই না, এটা যে রিলেটিভিটি আর কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে একসাথে ব্যাখ্যা করতে পারে তাই নয়- এটা বিগ ব্যাং-এর আগে কী ছিল এবং কেন বিগ ব্যাং হল তাকেও সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে।
এই দাবিটা একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার। এতদিন আমারও সবসময় আপনার মতই মনে হত আচ্ছা বিগ ব্যাং যদি একটা ঘটনা হয় তবে তার আগে কী ছিল? সঠিক উত্তর জানা ছিল না। বিজ্ঞানীরা বলতেন কিছুই ছিল না। সেই মাহেন্দ্রক্ষণ থেকেই সময়ের উৎপত্তি হল। তবে আমাদের মনে হত আমরা যেন আমাদের প্রশ্নের সঠিক জবাব পেলাম না। স্ট্রিং থিওরির প্রবক্তারা বলছেন তারা তাদের তত্ত্বের সাহায্যে বলতে পারেন বিগ ব্যাং-এর আগে কী ছিল?
এই তত্ত্ব একদিকে যেমন বিজ্ঞানীমহলে বিরাট উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে তেমনি প্রচন্ড সমালোচনার মুখেও পড়েছে। তার অন্যতম কারণ একে এখনও প্রমাণ করা যায় নি। বিজ্ঞান প্রমাণ ছাড়া কোনো কিছু মেনে নেয় না। কিন্তু এই তত্ত্বের গণিত খুব সুন্দর। তার সৌন্দর্য এতটাই যে শুধু তার নির্ভুলতার ওপর ভিত্তি করে এর প্রবক্তারা বলছেন এই তত্ত্ব সঠিক বলে একদিন প্রমাণ হবেই।
এর প্রবক্তা দুইজন প্রধান বিজ্ঞানীদের একজন ব্রায়ান গ্রিন এবং অন্যজন মিচিও কাকু। এরা দুজনেই সুবক্তা। তাই ইউ টিউব, টেড টক-এ এদের অনেক ভিডিও আছে। এদের লেখা কিছু বইও আছে। সেখানে তারা তাদের তত্ত্বকে খুব সহজে ও সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। একটা কথা মনে রাখতে হবে এই তত্ত্বকেও কিন্তু সাধারণ গণিতের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায় না। একে ব্যাখ্যা করতে হলে বিজ্ঞানীরা বিভিন্নরকম ডায়মেনশনের সাহায্য নেন। এখনো পর্যন্ত তারা ১১ টি ডায়মেনশনের সাহায্য নিয়েছেন। আমরা আমাদের পৃথিবীতে তিনটি ডায়মেনশনে অভ্যস্ত। খুব বেশি হলে বিজ্ঞানীরা চারটি ডায়মেনশন নিয়ে কথা বলতে পারেন। চতুর্থ ডায়মেনশনটি সময়। কিন্তু এগারোটি ডায়মেনশন! কি সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার! সেই জগতে পৌঁছলেও আমাদের দৃষ্টির অভিজ্ঞতা দিয়ে আমরা হয়ত কিছুই দেখতে পাব না।
ইন্টারস্টেলার সিনেমার কথা নিশ্চই মনে আছে। সেখানে ব্ল্যাক হোলের ভেতরে কুপার যখন পঞ্চম ডায়মেনশনে চলে এসেছে সেখানের জগৎকে কেমন দেখানো হয়েছিল তা নিশ্চই আপনার মনে আছে। সেই ডায়মেনশন থেকে কুপার তার মেয়েকে পৃথিবীতে ব্ল্যাক হোলের মধ্যেকার কোয়ান্টাম ডেটা পাঠিয়েছিলেন।
আনন্দের কথা সারা পৃথিবীর যত প্রথম সারির বিজ্ঞানীরা এই স্ট্রিং থিওরি নিয়ে কাজ করছেন তাদের মধ্যে একজন বাঙালি আছেন। তিনি অশোক সেন। ২০১২ সালে তিনি থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সের সেরা পুরস্কার ‘ফান্ডামেন্টাল ফিজিক্স প্রাইজ’ পেয়েছিলেন। তার পুরস্কার মূল্য ছিল তিন মিলিয়ন ডলার। আমাদের দেশে তারপর তার কৃতিত্ত্বের কথা যত না মিডিয়ায় ছাপা হয়েছিল তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল তার পাওয়া বিপুল পুরস্কার অর্থের পরিমাণ নিয়ে।
সে যাই হোক এই তত্ত্বে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলা হয়েছে। এই তত্ত্বে আমাদের মহাবিশ্বকে একটা প্রসারণশীল বুদবুদ হিসেবে দেখানো হয়েছে। বলা হয়েছে এমন মহাবিশ্ব শুধু একটাই নেই, অসংখ্য আছে। এভাবেই এই তত্ত্ব নিয়ে এসেছে প্যারালাল ইউনিভার্স বা মাল্টিভার্সের কথা। দুটো বুদবুদ যেমন পাশাপাশি জুড়ে গিয়ে একটা হয়ে যেতে পারে তেমনই বুদবুদের মত দুটি মহাবিশ্বের পারস্পরিক মিলনে বা একটি মহাবিশ্বের দুটো আলাদা অংশে বিভাজনে আমাদের এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হতে পারে। সেই সংযোজন বা বিয়োজনের ঘটনাটাই হল ‘বিগ ব্যাং’।
এই তত্ত্ব আমাদের যেমন একাধিক মহাবিশ্বের অস্তিত্ত্বের কথা জানায় তেমনভাবেই এই তত্ত্ব আমাদের টেলিপ্যাথি, টেলিকাইনেসিস, দেজাভু এমনই সব প্যারাসাইকোলজির জগতে নিয়ে যায়। বিজ্ঞান চিরকাল এদের ‘সিউডোসায়েন্স’ বলে অবজ্ঞা করে এসেছে কিন্তু আজ বিজ্ঞানেরই এক অংশ মনে করছে এসব ধারণা সত্যি হলেও হতে পারে। স্ট্রিং থিওরি আমাদের কল্পবিজ্ঞানের কাছাকাছি নিয়ে যায়। নিয়ে যায় দর্শনের কাছে সাহিত্যের কাছে। আমার তো মনে হয় কোনোদিন এই থিওরি যদি সত্যি বলে প্রমাণিত হয় তাহলে তা শুধু আপেক্ষিকতাবাদের সাথে কোয়ান্টাম থিওরিকে মিলিয়ে দেবে না, মহাবিশ্বের চারটি বলকে একসাথে ঈশ্বর সমীকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করবে না তা এই পৃথিবীর সব প্রজ্ঞা ও চেতনাকেও হয়ত একসাথে জুড়ে দেবে।
কবিতা আর বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধের মূলসুর তখন হয়ত একই হবে। নিরীশ্বরবাদী ও ঈশ্বরবিশ্বাসী সকলেই হয়ত কোনো মাধ্যমিক গ্রহণযোগ্য ধারনাকে একই সাথে বিশ্বাস করবে। বিজ্ঞানীরা খুব আশাবাদী শিগগিরই হয়ত তারা প্রমাণের কাছাকাছি পৌঁছে যাবেন। বৈজ্ঞানিক মহলে এই থিওরির প্রবক্তাদের নিয়ে ব্যঙ্গ ও সমালোচনারও শেষ নেই। কে জানে কারা ঠিক কারাই বা ভুল? তবে দীর্ঘকালীন বিজ্ঞানের ইতিহাস আমাকে একটা কথাই বুঝতে শিখিয়েছে সব কিছুর মত সত্যও একটা রিলেটিভ ব্যাপার। আজ যাকে সত্য বলে বিশ্বাস করছি একদিন তাকেই মেনে নিতে কষ্ট হয়।
আমরা ত্রিমাত্রিক জগতের বাসিন্দা। আমাদের মস্তিষ্ক তাই সেভাবেই দেখে অভ্যস্ত। তাই চার বা পাঁচ মাত্রার জগত আমাদের চোখের সামনে থাকলেও আমরা হয়ত দেখতে পাই না। আমরা যেসব উপলব্ধি বা ঘটনা ব্যাখ্যা করতে পারি না, বিজ্ঞান তাকে ব্যাখ্যা করতে পারছে না বলে তা সত্যি নয় এটা নাও হতে পারে। চেতনার জগত আমাদের কাছে একটা ধাঁধাঁ। আমি তো লেখক। কল্পনাই আমার রসদ। মুজতবা আলি যেমন বলেছিলেন, স্বপ্নেই যখন পোলাও রাঁধছি তখন একটু বেশি করে ঘি দিতে দোষ কি?
আমারও তাই মত। কল্পনাতেই যখন ডানা মেলে দিয়েছি তখন একটু বেশিক্ষণ ঘুরে আসতে দোষ কোথায়?
(চলবে)
পরের কিস্তির জন্য অপেক্ষায় রইলাম।