এভা মোজেস যে দিনগুলোর কথা মনে করছেন, তখন তিনি ন’বছরের বালিকা। আর ডাঃ জোসেফ মেনগেলের বয়স বত্রিশ – জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত সইতে সইতে সুকুমার মনোবৃত্তি হারিয়ে ফেলে পাষাণহৃদয় হয়ে ওঠার মতো বয়সের যুক্তি, অতএব, তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তাহলে, ঠিক কেমন করে এক সদ্য তরুণ তাঁর সামনে হাজির হওয়া শিশুদের প্রতি হয়ে উঠতে পারেন এমন আবেগহীন – নৃশংস??
নাৎসি জমানার তথাকথিত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার আরেক গিনিপিগ যমজ সারা ভিগোরিতো ডাঃ মেনগেলের পরীক্ষার ধরণটির কথা বলেন –
…ডাঃ মেনগেল এগোতে থাকেন একটি কাঠের খাঁচার দিকে। খাঁচার মধ্যে বন্দী দুটি শিশু। তিনি একটি শিশুকে বেছে নেন। বলেন, পরীক্ষার টেবিলে নিয়ে আসতে। বাচ্চাটিকে টেবিলে শোয়ানো হয়। নগ্ন করে। তার মুখে একটা কাপড় গুঁজে দেওয়া হয়, চোখও ঢেকে দেওয়া হয়। দুদিক থেকে দুজন সহকারী এসে বাচ্চাটিকে টেবিলের উপর চেপে ধরে। এবার ডাঃ মেনগেল স্ক্যালপেল হাতে এগোতে থাকেন। শিশুটির টিবিয়া (হাঁটু থেকে গোড়ালি অব্দি যে মূল লম্বা হাড়) ধরে লম্বা করে কাটেন। চামড়ার নীচে হাড়ে পৌঁছালে হাড় থেকে কুড়ে কুড়ে নমুনা সংগ্রহ করতে থাকেন। কাজ হয়ে গেলে পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে বাচ্চাটিকে খাঁচায় ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। না, ব্যথার জন্যে কোনো ওষুধপত্র দেওয়া হয় না।…
আমরা যারা এই বিবরণ পড়ে শিউরে উঠছি, তাদের মনে প্রশ্ন জাগছে – জাগা উচিত – ডাঃ মেনগেল, চিকিৎসক তো দূর, তিনি কি আদৌ মানুষ ছিলেন!!! হ্যাঁ, অবশ্যই তিনি মানুষ ছিলেন, রক্তমাংসের মানুষ – আর ঠিক সেকারণেই আমাদের আরো বেশী করে এই কথাগুলো মনে রেখে দেওয়া দরকার, কেননা উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিস্থিতি পেলে, স্রেফ নৈর্ব্যক্তিক বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে আমরা খুব সহজে তাঁর মতো নির্মম না হয়ে উঠলেও, অন্তত তাঁর সহযোগীদের পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারি।
সারা ভিগোরিতো-র বয়ানে ফেরা যাক –
…সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটা মনে রাখা দরকার, নাৎসি ডাক্তার বা বিজ্ঞানীরা কেউই দানব বা উন্মাদ ছিলেন না। তাঁদের শারীরিক গঠনে বা আচার-আচরণের মধ্যে এমন কিছুই ছিল না, যা তাঁদের আমার-আপনার পারিবারিক ডাক্তারবাবুর থেকে আলাদা করে চিনিয়ে দেবে।… নাৎসি ডাক্তারদের কথা এজন্যেই বলতে বসেছি, কেননা মানুষকে নিয়ে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের আরো সচেতন হতে হবে। সবকিছুই নির্ভর করছে পরীক্ষার মুহূর্তে আমাদের মনোভাবের উপরে। গবেষণার মুহূর্তে শুধু একবার যদি আমরা নিজেদের অগ্রাধিকার বদলে ফেলি, যদি একবার মানুষের জীবনকে প্রাথমিক বিবেচ্য ভাবার পরিবর্তে বিজ্ঞান ও অগ্রগতিকে প্রাথমিক লক্ষ্য ভাবতে শুরু করি, তাহলেই আমাদের কারো পক্ষেই “নাৎসি ডাক্তার” হয়ে উঠতে সময় লাগবে না।…
চিকিৎসাবিজ্ঞান বা চিকিৎসা, তার মূল কথা হল মানুষকে কষ্ট থেকে আরাম দেওয়া। ঠিক কোন পথে সেরা আরাম আসতে পারে, তার জন্যে গবেষণা জরুরী, অবশ্যই। কিন্তু, গবেষণার মুহূর্তেও চিকিৎসকের সামনে যিনি উপস্থিত, তিনি একজন মানুষ – কোনো গিনিপিগ নয় (অবশ্য গিনিপিগের ক্ষেত্রেও যথেচ্ছ পরীক্ষা করে চলা যেতে পারে কিনা বা গিনিপিগকে কষ্ট দিয়ে মানুষের রোগমুক্তির গবেষণা যুক্তিযুক্ত কিনা, সেও তর্কযোগ্য – কিন্তু, আপাতত সে তর্কে যাচ্ছি না)। চিকিৎসা বা গবেষণা – কোনো মুহূর্তেই একথা ভুলে গেলে চলবে না, মানুষের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছুই নয় – একজন মানুষের প্রাণের বিনিময়ে বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুক্তি মান্য নয়।
হিপোক্রেটিসের নামাঙ্কিত শপথটি নব্যচিকিৎসক জীবনের শুরুতে হুবহু গ্রহণ করুন বা না করুন, ওই শপথের মূল কথাগুলো বিভিন্ন বয়ানে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসের শুরু থেকেই চলে আসছে। চিকিৎসকের প্রথম লক্ষ্য রোগীর ক্ষতি না করা, এই আপ্তবাক্য আধুনিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে সবক্ষেত্রে মেনে চলা সম্ভব হয় না, কেননা ক্যানসারের মতো আরো অনেক অসুখই আছে, যার চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রচুর এবং রোগীর কিছু ক্ষতি হবে মেনে নিয়েই চিকিৎসা করতে হয়। কিন্তু, সেক্ষেত্রেও লক্ষ্য থাকে সংশ্লিষ্ট রোগীরই অসুখের নিরাময় বা কষ্টের উপশম – পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার যন্ত্রণা অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশ মাত্র, এবং যাকে বলে নেসেসারি ইভিল।
মানুষের ক্ষতিই নাৎসি চিকিৎসকদের গবেষণার লক্ষ্য ছিল সর্বদা, এমন নয় (অনেকক্ষেত্রে অবশ্য ব্যাপারটা ঠিক তেমনই ছিল। অর্থাৎ সবচেয়ে কম ব্যয়ে ঠিক কেমন করে মানুষকে মেরে ফেলা যায়, গবেষণা হত তা নিয়েও)। কিন্তু, সংশ্লিষ্ট মানুষটির হিতসাধন সেই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল না। এভা বা সারা-র মতো শিশুরা ছিল স্রেফ গিনিপিগ – গবেষকের চোখে মনুষ্যেতর, কিন্তু নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষার মুহূর্তে মানুষ, বায়োলজিকালি হিউম্যান বা হোমো সেপিয়েন্স – অর্থাৎ কিনা পরীক্ষানিরীক্ষার জন্যে ব্যবহৃত প্রাণিমাত্র, কিন্তু এমন এক্সপেরিমেন্টাল ম্যামাল, যাদের উপর পরীক্ষা করে পাওয়া ফল মানুষের উপর প্রয়োগ করতে বাড়তি ঝুঁকির আশঙ্কা নেই (আমরা তো জানিই, ইঁদুর বা গিনিপিগের উপরের পরীক্ষালব্ধ ফল মানুষের উপর সবসময় সমান কার্যকরী নয় – তাই না?)। পরীক্ষার ফলাফল মানুষের পরীক্ষানিরীক্ষালব্ধ জ্ঞান ব্যবহৃত হতে পারবে উন্নততর আর্য জার্মান মনুষ্যসমাজ সৃজনের উদ্দেশে। এই যে মুখ্য উদ্দেশ্যটিই গুলিয়ে যাওয়া, অর্থাৎ উন্নততর খুঁতহীন আর্য মনুষ্যসমাজ সৃষ্টিই মুখ্য অভীষ্ট হয়ে দাঁড়ানো – এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে যেকোনো পথ ও যত ইচ্ছে বলিদান গ্রাহ্য – বিপদ এখানেই – এই পথ ধরেই আমার বা আপনার মতো একজন মানুষ, যিনি কিনা কাজের শেষে বাড়ি ফিরে আসেন, টিভি দেখতে দেখতে সন্তানের সাথে খুনসুটি করতে ভালোবাসেন, তিনি হয়ে উঠতে পারেন “নাৎসি ডাক্তার” বা ওরকম আরো অনেক কিছু।
মনে রাখা যাক, নাৎসি জমানার রমরমার সময় সেদেশের চিকিৎসকদের বড় অংশই ছিলেন নাৎসিবাদের সমর্থক – আদর্শগতভাবে তো বটেই, এমনকি প্রায়োগিক ভাবেও। দেশের বাকি সব পেশার চাইতে ডাক্তাররাই সবার আগে হিটলারের রাজত্বের পাশে দাঁড়িয়েছেন, এই গর্ব তৎকালীন জার্মান চিকিৎসকদের সংগঠন একাধিকবার করেছেন।
অতএব, মানসিক রোগগ্রস্ত বা জড়বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের নির্বীজকরণ প্রকল্প, যাতে ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে সাড়ে তিন লক্ষ মানুষকে সন্তানোৎপাদনে অক্ষম করে ফেলা হয়, সেই সময় চিকিৎসকদের বড় অংশ “সরকারের সাথে” ছিলেন।
অতএব, ১৯৪০ থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যে যখন মানসিক রোগীদের গ্যাস চেম্বারে পাঠানো শুরু হয়, সত্তর হাজার মানসিক রোগগ্রস্ত মানুষকে যখন মেরে ফেলা হয়, সামগ্রিকভাবে চিকিৎসকরা প্রতিবাদ করেন নি। বরং সেই একই সময়ে আরো প্রায় এক লক্ষ মানসিক রোগী মারা যান মানসিক হাসপাতালের অসহনীয় পরিবেশে – চিকিৎসকরা প্রতিবাদ করেছিলেন, এমন খবর নেই।
অতএব, ১৯৪১ সালে যখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, যে, সমস্ত মানুষ, যাঁরা এক-চতুর্থাংশ ইহুদি – অর্থাৎ দাদু-দিদিমা-ঠাকুরদা-ঠাকুমার মধ্যে অন্তত একজন পুরোপুরি ইহুদি বা বাবা-মায়ের মধ্যে অন্তত একজন অর্ধেক ইহুদি – তাঁদের সবার নির্বীজকরণ হবে, যাতে তাঁরা আর “অশুদ্ধ রক্তের” সন্তানের জন্ম দিতে না পারেন এবং আর্য জার্মান শুদ্ধতার পবিত্রতা নষ্ট না করতে পারেন – না, গরিষ্ঠ অংশের চিকিৎসকরা প্রতিবাদ করেন নি। আর সেই প্রকল্প তো চিকিৎসকদের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া সম্ভবও ছিল না, তাই না?
এবং, সেই একই সময়ে যখন সিদ্ধান্ত হয়, যে, যাঁরা পুরোপুরি ইহুদি বা অর্ধেক ইহুদি (অর্থাৎ বাবা-মায়ের মধ্যে একজন সম্পূর্ণ ইহুদি), তাঁদের ক্যাম্পে পাঠানো হবে মেরে ফেলার জন্যে – তখনও চিকিৎসকদের মধ্যে থেকে প্রতিবাদ উঠে আসেনি।
বারবার চিকিৎসকদের কথা এজন্যেই বলছি, কেননা এই পেশার কাছে আমাদের প্রত্যাশা কিছুটা ভিন্ন – একমাত্র এই একটিমাত্র পেশার কাছে এসেই আমাদের সমস্ত গোপনীয়তা পরিত্যাগ করতে হয় – একমাত্র এই একটি পেশার মানুষই আমাকে এমনভাবে চিনতে পারেন, যতখানি চেনেন নি আমার একান্ত ঘনিষ্ঠ মানুষটিও – এবং সেই চিনে ওঠাটা চিকিৎসকের কোনো মহানুভবতা নয়, সেটা তাঁর রুটিন কাজের মধ্যেই পড়ে, তাই না?
প্রতিটি পেশার মধ্যেই কিছু মূল্যবোধ থাকে। পেশার মানুষটির ব্যক্তিগত মূল্যবোধ এবং পেশাটির নিজস্ব মূল্যবোধ – দুইয়ে মিলেই পেশাদারের যাপন। তবু, চিকিৎসকের ক্ষেত্রে বিষয়টা একটু আলাদা। আপনাকে আমার যদি খুব বিরক্তিকর এমনকি অসহ্য মানুষ বলেও মনে হয়, আপনার সাথে কোনোরকম সাধারণ সামাজিক সম্পর্করক্ষা যদি আমার পক্ষে অভাবনীয়ও বোধ হয় – তবু আপনার চিকিৎসার মুহূর্তে আপনার আরোগ্য বা উপশমের বাইরে আমার আর কিছুই বিচার্য হতে পারে না। মেডিকেল এথিক্স তা-ই শেখায়। এবং সেজন্যেই, বাস্তুকার বা উকিলের পেশার এথিক্স বলে ঠিক কী কী বিষয় শেখানো হয়, সে বিষয়ে সম্যক ধারণা না থাকলেও মেডিকেল এথিক্স বলে যে একটি বিষয় ডাক্তারদের শিরোধার্য, এই কথা সবাই জানেন, এবং মানেন।
(চলবে)