দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি বিশেষ ৩৪
– ধুস শালা! ওসব **র করোনা-ফরোনা পেছনে গুঁজে শান্ত হয়ে শুয়ে পড়ুন
– সব কিছুতে ব্যবসা পেয়েছিস বোকা? সব ভ্যাক্সিন বেচার ছক। পাবলিক গা* নাকি?
– কোথায় তোদের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর? কোথায় তোদের থার্ড ওয়েভ? পুরো পুজো মাস্ক না পরেই ঘুরেছি। বড়দিনেও চুটিয়ে মস্তি করেছি। তোর কোভিড আমার ইয়েটাও ছুঁতে পারবে না।
– পুরোটাই মিডিয়া আর এই ছাগলের অষ্টম সন্তান ডাক্তারদের বানানো গল্প। কোভিড বলে কোনোদিনই কিছু ছিল না।
– আজকাল ফেসবুকে কোভিড নিয়ে অনলাইন নিউজগুলো দেখবি… বারোশো লাইক। তার মধ্যে আটশো হাহা।
****
বহুদিন আগে মহাপুরুষেরা বলে গেছেন জীবনের কোনও কিছুই ফেলনা নয়। সবটাই অর্জন। অতঃপর যখন শিখলাম কোভিডের ভয়ে নিট পিজির মতো গুরুত্বপূর্ণ ডাক্তারি পরীক্ষা বারবার পিছিয়ে দেওয়া যায় অথচ যাবতীয় ভোট-ঘোঁট, খেলা-মেলা পুরোদমে চলতে পারে তখন মনে করেছি- আহা! এই শেখাটাও তো কম নয়… ফুর্তির দিনে কোভিডও ভরসন্ধেবেলায় দিশি টেনে রাস্তার পাশে ভোঁসভোঁসিয়ে ঘুমোয় সম্ভবত। কী লাভ ফালতু লোকের শরীরে ঢুকে ক্যাচাল বাঁধানোর? ইনফেকশন বাড়লেই রোজ রোজ গরম গরম খবর, হাজারো সংখ্যার কচকচি। এত হইচই হ’লে হার্দিক পান্ডিয়ার হাতঘড়ির দাম কিংবা সেলিব্রিটি দম্পতির বাচ্চার ন্যাপি বদলানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ খবর মিস হয়ে যায়। ভাল্লাগে না!
সবকিছু বেশ চলছিল। হঠাৎ একদিন কোনও এক উজবুক খবর দিলো আবার কোভিড বাড়ছে। শুনে সম্মিলিত জনতার সে কী হাসির ধুম! বাংলা খিস্তির দিগন্তে কত নতুন নতুন তারকার আবির্ভাব! অন্য কিছুতে না হোক অন্তত খিস্তিশিল্পে বাঙালীর উন্নতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখে শিহরিত হচ্ছিলাম। মাঝে মাঝেই সর্বঘটের কাঁঠালিকলারা ঝলসে উঠছিলেন, “বুইলেন না জগদীশবাউ, সব মার্কিন সাম্মাজ্যবাদের চকান্তো। সাদারণ মানুষকে ভাতে মারার নোংরা খেলাটা বুজে নিন।” বলেই রাস্তার ওপরে পচাৎ করে একদলা থুতুসহ পানের পিক…
শেষ ক’দিনে কোভিড শুধু সংখ্যায় বাড়েনি, এটা কোভিডের সুনামি। সে যাই হোক, মেলা-পুজো-ভোটের প্রচারের মতো অত্যাবশ্যকীয় জিনিস বন্ধ রাখা সম্ভব নয় কিন্তু লোকাল ট্রেন, বাস, স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়াটা আশু প্রয়োজন।
মাঝে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে জ্বরের রোগীর সংখ্যা একশো’র নিচেই থাকছিল। এখন আবার সেটা দু’শো ছাড়াচ্ছে। “ডাক্তারবাবু, এই জ্বরটা করোনা নয় তো?” প্রশ্নগুলো আবার ফিরে এসেছে। বহুদিন খালি পড়ে থাকা আইসোলেশন ওয়ার্ড ভরতে শুরু করেছে। ক’দিনে যতবার প্যারাসিটামল লিখেছি সেটা পরপর লিখলে বোধহয় চাঁদে যাওয়ার সমান হ’ত। পরবর্তী সম্ভাব্য ছবিটা বলে ফেলার মতো বাড়তি মাথা আমার নেই।
“ডাক্তারবাবু, একটু বেশি দিনের ওষুধ লিখে দিবেন। সবাই বলতিছে নাকি আবার আবার ট্রেন-বাস বন্ধ হ’তে পারে…”
একটানা সর্দি-কাশির একঘেয়ে প্রেসক্রিপশন লেখায় ছেদ পড়লো। এই বাচ্চাকে অন্তত মাসে একবার করে দেখিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এসেছে প্রায় ন’মাস বাদে। স্বাভাবিকভাবেই খিঁচিয়ে উঠলাম।
– হঠাৎ অর বাবা মারা গেল। টাকাপয়সারও সমস্যা।
– ওহ্! কী হয়েছিল বাবার?
– খুন
এত নির্লিপ্তভাবে ‘খুন’ বলা শুনে চমকে উঠলাম।
– অটো চালাইত। হাতে সনার আংটি ছিল। অর বন্ধুরাই খুন করে…
পেন থেমে গেছে। ভদ্রমহিলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলছেন- – এখন দেখি যদি কারো ঘরে বাসন মাজা, কাপড় কাচার কাজ পাই… দু’টা বাচ্চা… কী জানি কী হবে…
***
সরকারি হাসপাতালে যে পরিমাণ জীবনের গল্প তৈরি হয়; জানি না আর কোথাও সেরকম হয় কিনা। ডাক্তারি আর কী করি ছাই… ওই তো ক’টা ওষুধ, ক’টা ডায়াগনোসিস। স্টেথোস্কোপ আসলে জীবনের গল্প শোনার ছাড়পত্র। কত মানুষ, কত জীবন, কত টুকরো হাসিকান্না। বেখেয়ালে কুড়িয়ে নিচ্ছি ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা কাঁচা হাতে লেখা পান্ডুলিপি। এ লেখা প্রকাশ হবে না কোনোদিন। শুধু গল্পের চরিত্রেরা বেঁচে থাকবে। নামগুলো একটু বদলে নিলেই সেই একই টালির চাল, সেই একই খড়ি ওঠা পা, শিরা ওঠা হাত… সে জীবনকে কলমে ধরা আমার সাধ্যাতীত।
জানি, এ লেখা খুব কমজনই পড়বেন। পড়ার দরকার আছে বলে আমার নিজেরই মনে হয় না। শুধু পারলে মাস্কটা পরে ফেলুন। ওটা দরকার।