না, আত্মহত্যা করতে হয়নি তাকে। সেই সুযোগও তিনি পাননি। মেরে ফেলা হয়েছিল।
প্রায় দেড়শো বছর আগের ঘটনা। অথচ স্থান, কাল আর পাত্র বদলে দিলেই, এক অতি পরিচিত দৃশ্য দেখতে পারি। হ্যাঁ, পরিচিত দৃশ্যে, ওনাকে আত্মহত্যা করতে হয়েছিল।
১৮৬৫ সালের, ৩০ শে জুলাই, অস্ট্রিয়ার ল্যাজারেটগ্যাজ (Lazarettgasse), এর অ্যাসাইলামে, ভর্তি করা হল এক রোগীকে। সমস্ত পৃথিবী তখন তার বিরুদ্ধে।
সকলে, এমনকি তার স্ত্রীও।
১৮৫৭ সালে, উনিশ বছরের ছোট মারিয়া উইডেনহোফার (Maria Weidenhofer; ১৮৩৭–১৯১০) কে বিয়ে করেন। সেই সময় সারা পৃথিবীর সাথে লড়াই চালাচ্ছেন। বলা ভাল, লড়াইটা ছিল, ডাক্তারদের বিরুদ্ধে। নিজে ডাক্তার হয়েও এক অসম যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। না, বিবাহিত জীবনেও, সুখী হতে পারেননি তিনি। পাঁচ সন্তানের মধ্যে দুই সন্তানের মৃত্যু দেখতে হয়েছিল। ঘরে বাইরে ক্রমশ কোনঠাসা হয়ে আসছিলেন। ঝগড়া, ঝামেলা, তর্ক, নেশা, ডিপ্রেশন। অতলে তলিয়ে গেলেন।
উপরওয়ালার কড়া নির্দেশ, কোন রকম বেচাল দেখলেই যেন উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ১ লা অগাস্ট, হাসপাতালের আনাচকানাচ জেনে গেল, ‘উপযুক্ত ব্যবস্থা’ নেওয়া হয়েছে। এরপর ২ রা, ৩ য়, ৪ র্থ , ৫ ম, ৬ ই আগস্ট, রোজ, রোজ উপরওয়ালার নির্দেশ মেনে ‘উপযুক্ত ব্যবস্থা’ নেওয়া হয়েছে। অচৈতন্য, আহত, রক্তাক্ত শরীরটা পরে থেকেছে ঘরের এক কোণে। আট তারিখ থেকে জ্বর আসতে শুরু করলো। ডান হাতে একটা কাটা জায়গা, ফুলে উঠলো, গ্যাংগ্রিনের পূর্ব লক্ষণ। অচৈতন্য দেহ, প্রচন্ড জ্বর, ইনফেকশন ছড়িয়ে পারলো সারা শরীরে। সারা জীবন কাজ করেছেন ইনফেকশন প্রতিরোধের জন্যে। কিন্তু আজ!!
না আর খুব বেশী কষ্ট সহ্য করতে হয়নি। তেরই অগাস্ট সমস্ত কষ্ট থেকে মুক্তি পেলো শরীরটা।
না, পৃথিবী বুক থেকে একটা নাম নিঃশব্দে মুছে যায় নি। আজ অনেকেই ওনার নাম জানে। কিন্তু মারা যাবার পর। খুন হবার পর। নৃশংস মৃত্যুর পর।
আজ সমস্ত পৃথিবী ইগনাজ সেমমেলউইজকে চেনেন ‘পায়োনিয়ার অফ অ্যান্টিসেপটিক পলিসি’ হিসেবে।
সেমমেলউইজের কাজ স্বীকৃতি পেল, তার মৃত্যুর পর। লুই পাস্তুর যখন “জার্ম থিয়োরি” আবিষ্কার করলেন, তারপর। সেমমেলউইজের কাজের থিয়োরেটিক্যাল উত্তর পাওয়া গেল।
কী কাজ করেছিলেন সেমমেলউইজ? সমস্ত পৃথিবী কেন তার বিরুদ্ধে গেল?
কয়েকটি বছর পিছিয়ে যেতে হবে।
স্থান: অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা
কাল: ১৮৪৬ সাল, ১ লা জুলাই
পাত্র: ইগনাজ ফিলিপ সেমমেলউইজ (১৮১৮ – ১৩ অগাস্ট, ১৮৬৫) (Ignaz Philipp Semmelweis)
অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা জেনারেল হাসপাতালে আজ নতুন এক ডাক্তারবাবু কাজে যোগ দিলেন। না, তার জন্যে ফুলের তোড়া নিয়ে কেউ অপেক্ষা করছিলেন না। নেহাতই জুনিয়র ডাক্তার। বলা যেতে পারে, একজন সিনিয়র রেসিডেন্ট।
প্রফেসর যোগান ক্লেইনের নেহাতই সহকারী
(অ্যাসিস্ট্যান্ট) হিসেবে ফার্স্ট অবসস্টেটিক্যাল ক্লিনিকে।
কাজ করতে গিয়ে দেখলেন, অদ্ভুত এক জিনিস। যা ঘুরিয়ে দিল, তার জীবনের মোড়। যা আদতে সমস্ত পৃথিবীকে এক নতুন দিশা দিল। কিন্তু একটা নৃশংস মৃত্যুর বদলে।
ভিয়েনার জেনারেল হাসপাতালে ধাত্রীবিদ্যার (অবসস্টেটিক্যাল) দুটো ওয়ার্ড ছিল। প্রথমটা চলতো ‘জুনিয়র’ ডাক্তারদের (জুনিয়র রেসিডেন্ট) তত্ত্বাবধানে আর দ্বিতীয়টি মিডওয়াইফদের পরিচালনায়।
দুটি ক্লিনিকে একই ধরনের রোগী ভর্তি হয়। প্রসব আসন্ন মায়েরা। একই পদ্ধতিতে সমস্ত চিকিৎসা প্রণালী। সব কিছু এক। প্রসব আসন্ন মায়েদের জ্বর খুব অস্বাভাবিক কিছুই না। পুয়েরপেরাল ফিভার (Puerperal fever) বা ‘চাইল্ডবেড ফিভার’ নামেই পরিচিত ছিল। যা ছিল ভয়ানক। পরিনতি ছিল মৃত্যু। দুটো আলাদা ওয়ার্ড।
ফারাক ছিল মৃত্যু সংখ্যায়। সকলেই জানতেন। কোন এক অজানা কারণে, জুনিয়র রেসিডেন্টদের তত্ত্বাবধানে চলা ওয়ার্ডে পুয়েরপেরাল ফিভারে মৃত্যুর পরিমাণ প্রায় ১৪% থেকে ২০% যেখানে মিডওয়াইফদের পরিচালিত ওয়ার্ডে মাত্র ৪%। অথচ প্রথাগত শিক্ষায়, নৈপুণ্যে সব কিছুই নিয়মমাফিক। জুনিয়র রেসিডেন্টদের কাজে কোন ফাঁকি নেই।
পার্থক্য কেন? কেন? সারাদিন-রাত চিন্তা করতে শুরু করলেন, সেমমেলউইজ। তাঁর নিজের কথায়,
“It made me so miserable that life seemed worthless”.
সংগ্রহ করলেন সমস্ত নথী। ১৮৪১ থেকে ১৮৪৬ সাল অবধি সমস্ত নথীর মধ্যে মুখ গুঁজে পরে রইলেন। একে একে সমস্ত সম্ভাব্য কারণ বাদ পরতে থাকলো। বাদ দিলেন ধর্মীয় কারণ, বাদ পারলো ওভারক্রাউডিং, বাদ পারলো পরিবেশগত কারণ। পৃথিবীতে তখন অবধি “দূষিত বাতাস” থিয়োরি বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। সমস্ত সংক্রমণ এবং সংক্রামক রোগের কারণ ধরে নেওয়া হয় “দূষিত বাতাস”। “জার্ম থিয়োরি” তখনো ভবিষ্যতের গর্ভে।
আশার আলো পাওয়া গেল অচিরেই। ইন্টার্ন বা জুনিয়র রেসিডেন্টদের নিয়মিত পুয়েরপেরাল ফিভার বা সেপসিসে মৃতদেহের শবব্যবচ্ছেদ করতে হতো। মিডওয়াইফ দের তা করতে হতো না।
তাহলে?
কারণ কি লুকিয়ে আছে শবব্যবচ্ছেদের মধ্যেই। হয়তো?
কিছুদিন পরেই মারা গেলেন, সহকর্মী এবং বন্ধু ডাক্তার জেকব কোল্সচকা (Jakob Kolletschka)। এক রোগীর শবব্যবচ্ছেদের সময় সেই স্কেলপেল (ব্লেড) থেকে হাতে আঘাত লেগে কেটে যায়, কোল্সচকার। কিছুদিনের মধ্যেই জ্বর, তারপর মৃত্যু।
সহকর্মীর শবব্যবচ্ছেদ নিজের হাতে করলেন, সেমমেলউইজ। অদ্ভুত। কোল্সচকার শরীরে একই রকম লক্ষণ, ঠিক যেমনটা দেখা গেছিল রোগীর শরীরে। দুয়ে দুয়ে চার। তাহলে কি রোগীর শরীরের থেকে স্কেলপেলের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে ছিল রোগ। কিন্তু এই রকম কি হয়? হতে পারে?
তাহলে কি রোগীর শরীরের থেকেই ছড়িয়ে পরছে রোগ আরেক রোগীর দেহে।
মাধ্যম? ডাক্তারের হাত? এটা কি সম্ভব?
ডাক্তাররা শবব্যবচ্ছেদ করার পর সেই হাতে বাচ্চা প্রসব করাতে গিয়ে ‘ক্যাডাভারিক পার্টিকল’ চলে যায় মায়ের শরীরে। ফল? পুয়েরপেরাল ফিভার এবং মৃত্যু।
উপায়?
হাত ধুতে হবে। শবব্যবচ্ছেদ করে হাত ধুলেই রোগ ছড়াতে পারবে না। জুনিয়র রেসিডেন্টদের নির্দেশ দিলেন, সেমমেলউইজ। নির্দেশ দিলেন, শবব্যবচ্ছেদ করে ক্লোরিনেটেড লাইমের (ক্যালসিয়াম হাইপোক্লোরাইট) মিশ্রনে হাত ধুতে হবে। ইস্টার্ন বা জুনিয়র রেসিডেন্টদের এই আদেশ মানতে বাঁধা ছিল না।
ফল?
এপ্রিল ১৮৪৭ সালে ফার্স্ট ওয়ার্ডে মৃত্যুর পরিসংখ্যান ছিল, ১৮.৩%। মে মাসের মাঝামাঝি ‘হাত ধোয়া’ শুরু হয়। জুন, জুলাই, আগস্ট মাসে মৃত্যুর পরিসংখ্যান কমে দাঁড়ায় ২.২%, ১.২%, ১.৯% পর্যায়ক্রমে। সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর মাসে, একটিও আর মৃত্যু হয় নি।
কি ভাবছেন?
ধন্য ধন্য পরে গেল সারা দেশে। সবাই মাথায় করে রাখলো সেমমেলউইজকে? অভিনন্দন বার্তায় ভেসে গেলেন?
না। এর একটিও হয় নি।
কেন? মনে পরে না আপনার সেই পরিচিত দৃশ্যটা। যেখানে তাকে আত্মহত্যা করতে হয়েছিল? অথচ তিনিও…
সিনিয়র ‘বড়ো’ ডাক্তাররা ভালো চোখে দেখলেন না এই আবিষ্কার। জুটলো, উপেক্ষা, লাঞ্ছনা আর উপহাস। হাত আবার ধোয়ার বস্তু নাকি? কী হবে হাত ধুয়ে? হাত ধুতে বলে পরোক্ষে ডাক্তারদের খুনি বলছেন?
প্রশ্ন ধেয়ে আসতে রাখলো চারিদিক থেকে।
কেন? কি করে? কি ভাবে?
সদুত্তর দিতে পারলেন না। হাতে ছিল কেবল, সংখ্যা। মৃত্যু কমেছে। কিন্তু তা নাকি যথেষ্ট নয়। দাবীর স্বপক্ষে থিয়োরির ভিত্তি কোথায়? প্রচলিত তত্ত্বের বাইরে তার এই দাবী কে কেউ সমর্থন করতে এগিয়ে এলেন না।
বাধ্য হয়ে বইয়ের আকারে প্রকাশ করলেন ফলাফল, Etiology, Concept and Prophylaxis of Childbed Fever. যদি কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসে বই পড়ে।
কিন্তু, না।
তবুও আশা হারালেন না, ইয়োরোপের বিভিন্ন জার্নালে লেখা পাঠালেন। ছাপাও হলো, কিন্তু লাভ?
জুটলো অপমান। খোয়ালেন চাকরি। চলে গেলেন বুদাপেস্ট্। জন্মস্থানে। ১৮৫১।
পেলেন একটা ছোট্ট চাকরি। আবার নতুন করে লড়াই শুরু করলেন। পাঁচ বছরে আবার পুয়েরপেরাল ফিভারে মৃত্যুর হার দশ শতাংশ থেকে কমিয়ে আনলেন, ০.৮৫%।
১৮৫৫, আবার চাকরি বদল। আবার লড়াই।
বারবার নিজে প্রমান করেছেন, অথচ যতবার প্রমান করেছেন, সবাই এক জোট হয়ে তার বিরুদ্ধে দাড়িয়েছে।
১৮৬১ সাল থেকে, ভুগতে শুরু করলেন ডিপ্রেসনে।
ইয়োরোপের সমস্ত ধাত্রীবিদদের চিঠি লিখতে শুরু করলেন। ফল? অশ্বডিম্ব।
তারপর? আর সময় নষ্ট করার কোন অর্থ নেই।
ভুলেই গিয়েছিলো, পৃথিবী নামটা। লুই পাস্তুর, যোসেফ লিস্টার তাঁর নামটা পৃথিবীর সামনে আরেকবার তুলে ধরলেন। এক বিরাট দীর্ঘশ্বাস হয়তো পৃথিবীর কোন কোণে কেউ দিয়ে উঠেছিল। মাত্র সাতচল্লিশ বছর বয়সে চলে যেতে হয়েছিল, ইগনাজ ফিলিপ সেমমেলউইজকে।
আজ বাচ্চাদের দেখার আগে, ছোঁয়ার আগে বারবার হাত ধুতে হয় আমাদের। হু (WHO) হাত ধোয়ার নতুন নিয়ম তৈরী করে কিছুদিন পর পরই। পড়তে হয় ‘গোল্ডেন রুল অফ হ্যান্ড ওয়াশিং’।
প্রতিবার একবার করে তার প্রতি হওয়া অবিচারের বিরুদ্ধে নিরুচ্চার গর্জন শুনতে পাই।
খুব অবাক হলেন?
খুব অপরিচিত লাগলো?
জানি দুটো প্রশ্নের উত্তরই না।
স্থান, কাল, পাত্র ভেদে এক বাঙালি চিকিৎসকের নাম মনে করতে পারেন।
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, আমি ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথা বলছি।
ডঃ বিধান চন্দ্র রায়, এক বিশাল সূর্যের মতো। নক্ষত্র। প্রথম ভারতীয় যিনি, একসাথে MRCP, FRCS.
চিকিৎসক। স্বাধীনতা সংগ্রামী, দেশ সেবক। সবচেয়ে সফল মুখ্যমন্ত্রী। আধুনিক পশ্চিমবঙ্গের রূপকার। ভারতরত্ন। তাঁর স্মরণে ভারতে পালন করা হয়, ন্যাশনাল ডক্টর’স ডে।
উনি জ্যোতিষ্ক, নক্ষত্র। উনি অনেক পেয়েছেন। ওনাকে অন্য কোন ভাবে স্মরণ করতে পারি না? অন্য কোন দিনে।
আর “ন্যাশনাল ডক্টর’স ডে” নাহয় পালন করলাম, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিনে, ১৬ই জানুয়ারি।
আর “ইনটারন্যাশনাল ডক্টর’স ডে” না হয়, ১ লা জুলাই। না, ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের স্মৃতিতে নয়।
ওহ্ বলাই হয় নি, ইগনাজ ফিলিপ সেমমেলউইজের জন্মদিনও ১ লা জুলাই।
চমৎকার ।
বিশ্বাসই করতে পারছিনা, যে, হাত ধোয়া নিয়েও মানুষ ঝগড়া করতো।
‘এক ডকটরকি মৌত’ যে কত ডাক্তারের জীবনে ঘটে গেছে!
Suicide among doctor নিয়ে আমার লেখাটাও বেরিয়েছে।
ইগনাজ সেমমেলউইজ এর ব্যাপারে প্রথম জানতে পারি.. একটা CDE Programme এর সেমিনারের সময়। একটা গোটা সিনেমাও আছে ইগনাজ সেমমেলউইজকে নিয়ে ২০০১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত, সিনেমার নাম “SEMMELWEIS, Hope was in his hands”.. সিনেমাটির মুখ্য চরিত্র ইগনাজ সেমমেলউইজের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন Fritz Michel
কুর্ণিশ। প্রণাম। একজন ডাক্তার, গাইনেকলজিস্ট হয়ে এই ডাক্তারকে সহস্র ব্রাভো অার সন্মান না জানিয়ে পারলাম না।
প্রনাম। ???
খুবই ভালো লাগলো
ধন্যবাদ
দারুণ ।ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে কিছু লেখা পাওয়ার আশায় রইলাম ।
অপূর্ব লেখা।
https://waterfallmagazine.com
hello there and thank you for your info
– I’ve definitely picked up something new from right here.
I did however expertise a few technical points using this website, as I experienced to reload
the website many times previous to I could get it
to load correctly. I had been wondering if your hosting is OK?
Not that I’m complaining, but sluggish loading instances times will
often affect your placement in google and could
damage your high quality score if ads and marketing with Adwords.
Anyway I am adding this RSS to my e-mail and can look out for a lot more of your
respective intriguing content. Make sure you update
this again very soon.