তৃতীয় দিন (১৬ অক্টোবর)
আজ সকাল সকাল রাহুল আর স্নিগ্ধা টটগাঁও এলেনবারিতে মেডিকেল ক্যাম্প করার জন্য রওনা দিল। সাথে লালিগুরাসের কিছু বন্ধু। আমাদের গাড়ি একটু পরে তিস্তাবাজারের দিকে এগোলো।
কালিম্পং শহর থেকে অনেকটা নীচে পুল পার হয়ে তিস্তাবাজার। ঘোলা জল এখনও বেশ ভালোই গতিতে বয়ে চলেছে। পুলের দুই পাশে উঁচুতে রেললাইনের সুড়ঙ্গ কাটা হয়েছে দেখা গেল। পুল পেরিয়ে পুলের নীচ দিয়ে পেশক হয়ে দার্জিলিং যাবার রাস্তায় বালিতে ঢাকা পড়ার চিহ্ন এখনও রয়েছে। বালি পরিস্কার ও রাস্তা মেরামতের কাজ চলছে। সেই পথেই ডাম্পারের পিছনে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল। তিস্তাপাড়ের দূর্বল দোকানপাট ভেসে গেছে কিছু ঢালাই কাঠামো দোকানের অস্তিত্ব চিনিয়ে দিচ্ছে। থামতে হলো। ধ্বস নামা রাস্তায় মাটি ফেলে ঠিকঠাক করার কাজে ব্যস্ত যন্ত্রদানবরা। এই ফাঁকে গাড়ি ফেলে পায়ে পায়ে সুমেনের সাথে এক মুদিখানার পিছনদিকে গেলাম। লালিগুরাসের পক্ষ থেকে সুমেনরা ছবি ও ভিডিও তুলছে। নাগরিকসমাজের মন্তব্য সংগ্রহ করছে। তিস্তা ভালোই বেগে বয়ে চলেছে। দোকানদার দেখালেন পিছনের মাটি গাছপালাসমেত প্রতিদিন নীচে নেমে যাচ্ছে। পাকাঘরের ফাটল ক্রমশ বাড়ছে। আতঙ্কে রাত্রিবাস অন্যত্র করতে হয়। ট্রেনলাইনের সুড়ুঙ্গকেটে নদীর উল্টোদিকের পাড়ে ডাম্পিং না করলে এপাড়ের এতো ক্ষতি হতো না বলেই তার ধারণা।
তিস্তাবাজারের কমিউনিটি হলে অনেক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। ভিতরে পার্টিশন এবং বাইরে অতিরিক্ত ছাউনি তৈরি করার কাজ এখনো চলছে। আরো বেশ কিছুকাল থাকার তোড়জোড় চলছে বলেই মনে হলো।
হলের মধ্যে সকাল এগারোটা নাগাদ মেডিকেল ক্যাম্প শুরু হলো। আশ্রিতদের পাশাপাশি নির্মাণকর্মী, রাঁধুনী ও তার সহকর্মীদেরও চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়া হলো। এখানে ৭৬ জন চিকিৎসা পরামর্শ নিলেন। ক্যাম্প শেষে পরম মমতায় কমিউনিটি কিচেনে যাঁরা আমাদের খাবার খাওয়ালেন তাঁরা কিছুক্ষণ আগে আমাদের রোগী ছিলেন।
মেডিকেল ক্যাম্প শেষ করে আমাদের সহযোগী তিস্তাবাজারের বাসিন্দা সাগরকে অনুসরণ করে সদলবলে নীচে নদীপাড়ে গেলাম। খেলার মাঠের বারপোষ্ট এখনও ছয় ফুট বালির নীচে চাপা পড়ে আছে। দর্শক গ্যালারির পুরোটাই বালিঢাকা। মাঠের শেষে বালিঢাকা ইঁটের গাঁথুনি ঘরবাড়ি থাকার সাক্ষী দিচ্ছে। কংক্রিট পাঁচিলের ওপারে তিস্তা এখনও বেগধারিনী। সাগরের অনুমান নদীর বুকেও অনেক বালি-পলি-ময়লা জমে আছে তাই এতো উঁচু দিয়ে জল বইছে। যদিও ওপরে জল আটকানোর ব্যবস্থাগুলো না থাকায় অবিরল ধারায় তিস্তা বয়ে চলেছে। এইরকমই বছরভর চলতে দিলে তিস্তা নদীর নাম হয়তো সার্থক হতো। উন্নয়নের নামে বাঁধ নির্মাণের বিষময় পরিনাম আজকে সর্বত্র দেখা যাচ্ছে। নাগরিক সমাজের মধ্য থেকে আওয়াজ উঠছে – বাঁধ আর নয়। আমারও মনে হয় – তিস্তা সহ সব নদীকেই অবিরল ধারায় বইতে দেওয়া হোক।