হঠাৎই আমি দাবা খেলা শিখে গেলাম।
আমি দাবা খেলা জানতাম না। বস্তুত ছোটোবেলা থেকেই আমার পারিবারিক শিক্ষা ছিল,
তাস দাবা পাশা
তিন সর্বনাশা…
পরিবারের কেউ কেউ বিরোধিতা করেছে আগে। আমার ছোটোকাকাই দীননাথই যেমন। কিন্তু মূল সুর একই থেকে গেছে।
বিখ্যাত কবি দীননাথ এক পর্যায়ে লিখেছিলেন,
তাস পাশা দাবা,
কেউ খেলো না বাবা…
এবং পরবর্তীকালে আবার বক্তব্য পালটে বলেন,
পাশা দাবা তাস,
কেন খেলতে যাস?
বোঝাই যাচ্ছে মোটের ওপর বক্তব্য একই থেকে গেছে।
কিন্তু হঠাৎই আমাকে এক বিকেলে ক্লাবঘরে একলা পেয়ে খেলাটা শেখাল ভজু। ওর পুরো নাম ভজনচন্দ্র সরখেল।
খেতে ভালোবাসে বলে কেউ কেউ ওকে ভোজন চন্দ্র বলেও ডাকে। যেখানে যা পায় সবই খায়। বিয়ে শ্রাদ্ধ ছাদ ঢালাই গৃহ প্রবেশ মায় দরিদ্র নারায়ণ সেবা। অন্য খাবার? হ্যাঁ, তাও খায়! প্রায় শক্তি চাটুজ্যের কবিতায় বলা সেই ভালোবাসার মত
ভালোবাসা সবই খায় – এঁটো পাতা, হেমন্তের খড়
রুগ্ন বাগানের কোণে পড়ে থাকা লতার শেকড়।
শুধু এই সব অ্যাবস্ট্রাক্ট কাব্যিক খাবার নয়। অকাব্যিক অথচ অ্যাবস্ট্রাক্ট অন্যরকম খাবারেও যথেষ্ট আসক্ত সে। নইলে আমার মত কাঠ বেকার তো না। এই অলস বিকেলে নিজেদের চালু সিন্ডিকেট অফিস ছেড়ে এখানে বসে কালক্ষেপ করার পাত্র ভোজন প্রসাদ নয়।
ক্লাবের রাষ্ট্রীয় পাওনা পঞ্চাশ হাজার নাকি সদ্য এসে পৌঁছেছে। সেই কেকের এক টুকরো থুড়ি চেকের এক টুকরো না খেয়ে হতভাগা ক্লাবঘর ছেড়ে বেরুবে না। রোজ আসবে, আমি জানি।
যাক গে, ক্লাবঘরে কেউ না থাকায় সে আমাকে দাবা খেলাটা শিখিয়ে দিল। শেখাল মানে ওই আর কী। চালটাল-গুলো। বোড়ে একঘর। ঘোড়া আড়াইঘর। গজ আর নৌকো, কোনটা সোজা আর কোনওটা কোণাকুণি।
শিখে লাভ হল একটাই। আজ্ঞে না, হুমায়ূন আহমেদের গল্পের নলিনীবাবু যেমন খেলা শেখার পর একটাও গেম হারেননি, সেই রকম না।
আমি শিখলাম কী করে দশ চালের মধ্যে মাত হয়ে যেতে হয় সেই রকমের এক ক্রীড়া সুষমা। আমার ক্লাসমেট সুবীরের ক্লাস ফোরে পড়া ছেলে রণবিজয়কে অবধি লড়াই দিতে পারলুম না। সেও আমাকে তিন চালেই…
সেই রণো অবশ্যি দাবা প্রশিক্ষিত। ওকে ওর বাবা কোচিং-এ পাঠায়। নানান কোচিং। ছবি আঁকা, স্কুলের পাঠ্য, ক্রিকেট, ক্যারাটে। সেই রকমের দাবার কোচিংও করে রণো। মাসে একদিন।
রণোই শেষ অবধি হদিশ দিল আমাকে।– কাকু, আমাদের কোচিং-এ ভর্তি হয়ে যাও। তোমার মত ইয়েদের জন্য স্পেশাল কোচিংএর ইয়ে করেছে আমাদের নরেনকাকু স্যার। খুব গোপন ক্লাস। কোড হচ্ছে হলুদ গোলাপ। তবে ফিজ বেশি না। আমাদের ঢোকা বারণ। ওই স্পেশাল ক্লাস করলে তুমি জিতবে না কিন্তু হারবেও না!
অবিশ্বাস মিশিয়ে বলি,– ধ্যাৎ, তা আবার হয় নাকি?
রণো থতমত খেয়ে চুপ করে আছে দেখে ওর বাবা সুবীর মুখ খোলে।– হ্যাঁ রে বাপু, হয়! আমরা তো ঢুকতে পাই না। শুনেছি নরেনস্যার নাকি শেখায়, ক্যাসলিং করার পর নিজের গুটি কায়দা করে এক এক করে খাইয়ে রাজাকে কী করে ন যযৌ ন তস্থৌ একরকম স্টেলমেট করে রক্ষা করতে হয়। খুব গোপন কায়দা। স্যার নাম দিয়েছেন ডেমোক্রেটিক মুভ।
★
কোচিং শুরু হয়েছে।