অফিসে ঢুকবার মুখে বিরাট এক সেলাম ঠুকল মিজানুর রহমান। খুব আন্তরিক ভাবে রোজ যেমন বলে সেই রকম বলল, — আসসেলাম আলেকুম দীপ্তসাহেব। আজ নাস্তা খাইয়া আসছেন তো? আম্মাজির শরিলডা আইজ বালা?
আসলে আমার মায়ের শরীর মঝেমধ্যেই বেশ খারাপ যাচ্ছে ইদানীং। সেই গোলযোগে পরপর কয়েকদিন সকালে নাস্তাপানি না করেই চলে আসতে হয়েছে কখনও।
আম্মাকে দেখার জন্য চব্বিশ ঘণ্টার আয়া আছে। এ ছাড়াও বাড়ির অন্যান্য কাজের জন্য বুয়া আছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সেই বুয়াটি মা-ছেলের সংসারে মায়ের স্নেহটুকু আমাকে দেবে। কাজেই কোনও কোনও দিন ব্রেকফাস্ট বাদ পড়ে যায় তাড়াহুড়োয়।
আমার এই নিজের প্রতি অবহেলাটা মিজানুর নামের এই সিকিউরিটি জানে। জানে বলেই তার এই উদ্বেগ। আমি তাকে ডাকি মিজান ভাই। আমার অধস্তন কর্মচারীদের আমি অবহেলা করি না।
মিজানুরের মত অধস্তনদের কাছ থেকে এই স্নেহ মাখানো উদ্বেগটুকু আমার বড় ভালো লাগে। এই প্রায় পারিবারিক প্রাপ্যটুকু না পেলে মনে হয় কোথায় যেন কম পেলাম।
ঢাকা বুয়েট থেকে ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর কয়েকবছর বিদেশে কাটিয়েছি। সেখানে মাস্টার্স সেরে পিএইচডি পোস্ট ডক। তারপরেও টেক্সাসে বিদেশি কোম্পানির গোলামি করেছি। সেই দূর বিদেশে থেকে যেতেই পারতাম। অনেকেই থেকে যায়।
কিন্তু আব্বা চলে যাবার পর থেকেই এই বাংলাদেশে আমার মা ছিলেন একলা। আমার আর অন্য ভাইবোন নেই।
এ ছাড়াও, সেই দূর প্রবাসে অনেককিছু থাকলেও অনেক কিছু নেইও। বাল্যাবধি চেনা জিনিসগুলি খুঁজে পাইনি সে দেশে। সেই না পাওয়ার তালিকা বিরাট। একটু বুঝিয়ে বলি। সত্যি বলতে কী বাংলাদেশের মত এই রকম দুপাড় ভাসানো নদী সেই দেশে আছে হয় তো, কিন্তু এখানের আকাশ অন্ধকার করে মাটিতে ঝুঁকে আসা বজ্রবাহন মেঘ আর কিছুটা উষ্ণ বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টির সঙ্গে সে দেশের হিম তুষার বৃষ্টির কোনও তুলনা হয় না। এই রকম আরও বহু কিছুর অভাব।
আমার মা আর এই দেশের টানে মোটমাট আমি দেশে ফিরে এসেছি। এই রকমের টানাপোড়েনে বিয়ে করা… সংসার করা হয়ে ওঠেনি আমার।
নিজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে একটা আইটি স্টার্ট আপ শুরু করেছি। নামটা বাংলাদেশের অন্যান্য আইটি কোম্পানির মত সাহেবি নাম না। আমাদের কোম্পানির নাম স্বাধীনতা ডট কম। এখানে আছে বুয়েটেরই আমার অনেক জুনিয়র দুজন, শুভ্র আর মিলি। এই কোম্পানিতে তারাও আমার সহযোগী।
*
আজকের ব্যাপারটা মিজান ভাই কিন্তু মিলিয়ে দিয়েছে। আজ সত্যিই নাস্তা করে আসা হয়নি। এখানেই চট করে সেরে নেব। আসলে আজ এখানে কয়েকজনকে রিক্রুট করা হবে বলে ইন্টারভিউ। ইন্টারভিউ নেবার কথা ছিল শুভ্র আর মিলির। শুভ্রর পুরো নাম রিয়াজ আহমেদ শুভ্র। তাকে সকালের ফ্লাইটে চট্টগ্রাম যেতে হয়েছে। জাপান থেকে আসা কাস্টমারদের কিছু ডিসপিউট মুখোমুখি মেটাতে তাকে যেতেই হল। জাপানিরা কক্সবাজারে রয়েছে।
এখানে মিলি একলা সামলাতে পারবে না বলে আমাকেও ইন্টারভিউয়ে থাকতে হবে।
*
আমাদের কোম্পানি নতুন। আজকের ক্যান্ডিডেটরা ডিগ্রি আর অভিজ্ঞতায়… ওই যেমন হয় আর কী। কেউ কেউ রিসেন্ট ডিপ্রেশনে বাইরের বড় কোম্পানি থেকে ফায়ারড। দুজন এমনকি এক্স-গুগল। একজন টিসিএসে ছিল আগে। এই রকমই প্রায় সব। ফ্রেশারও আছে কয়েকজন।
একদম শেষে এল সেই ফ্রেশারদের একজন। ভারি কম বয়স। ঠিক সময়ে বিয়ে হলে এই বয়সের ছোট্ট একটা কন্যা থাকতেই পারত আমার।
—- নাম?
—- আমার নাম উম্মে জোহরা বৃষ্টি স্যার।
এই উম্মে জোহরা নামটা খুব যে প্রচলিত তা নয়। কিন্তু আমি এই নামের সঙ্গে পরিচিত। খুব পরিচিত। কেন তা একটু পরে বলছি।
মেয়ের অ্যাকাডেমিক কাগজপত্র সব আমাদের মিলি চেক করছে। এর পর টেকনিক্যাল কিছু প্রশ্ন করা হবে।
প্রশ্ন শুরু করলাম, —- গ্র্যাজুয়েশনের পর আর কিছু না করে সরাসরি চাকরির ইন্টারভিউয়ে কেন?
ফ্রেশারদের এমন ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতেই হয়। কেন না তারা হঠাৎ ছেড়ে গেলে কোম্পানির কাজের ওপর চাপ পড়ে বেশ। এই জন্যই বেশি কমপেনসেশন প্যাকেজ দিয়েও ডিগ্রিটিগ্রি করা শেষ এমন অভিজ্ঞরা প্রেফারেবল।
সে উত্তর দিল, — পারিবারিক প্রয়োজন স্যার। আমার আব্বা নেই। মা গারমেন্টে সামান্য কাজ করেন। তার একলার রোজগারে আমার আর ভাইয়ের পড়াশুনা চালানো খুব কঠিন। আমি মায়ের পাশে দাঁড়াতে চাই।
টেকনিক্যাল পার্ট বেশ ভালো ভাবেই ক্লিয়ার করল। এই মেয়েকে ইন্টারভিউ শেষে আমার দ্বিতীয় লেফটেন্যান্ট মিলি আগ্রহের সঙ্গেই সিলেক্ট করল।
মিলিই তাকে জানিয়ে দিল অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে হাতে দেওয়া হবে বিকেলে। মেইলও যাবে অবশ্য। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগে অল্প করে মিষ্টি হেসে মিলি ওকে এও বলল, —- আমরা কিন্তু তোমাকে ডাকনামেই ডাকব, বৃষ্টি বলে।
কী খেয়াল হল, তখনও বসে থাকা মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম, — তোমার নামটা বেশ আনকমন। কার রাখা নাম?
—- আমার আব্বু রেখেছিলেন। বৃষ্টি ডাকনামটাও উনার দেওয়া।
—- তুমি হয় তো জানো না, তোমার নামের একটা ঐতিহাসিক রেফারেন্স আছে।
মেয়ে মাথা নীচু করে বলল, —- জানি স্যার। বাবার কাছে শুনেছি।
চমকে উঠলাম।
—- কী নাম তোমার বাবার?
আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে বৃষ্টি বলল, —- আমার আব্বার নাম মির্জা মুহম্মদ আলি সিরাজ।
একটু থেমে সে বলল, —- এই নাম আমার আব্বা নাকি নিজেই নিজেকে দিয়েছিলেন। তার আগে তাঁর নাম অন্য কিছু ছিল।
আমি চমকে উঠি। মনে পড়ে যায়, মীর্জা মহম্মদ নামে একজনকে আমিও জানি। বাংলার ইতিহাস তাঁর উল্লেখ করে নবাব সিরাজউদ্দৌলা বলে।
এই মেয়েটির বাবা নিজের নাম সেই মৃত নবাবের নামে রেখেছেন শুধু না, এমনকি নিজের মেয়ের নামও রেখেছেন, নবাবের প্রায় বিস্মৃত কন্যা উম্মে জোহরার সঙ্গে মিলিয়ে। কারণ কী?
আমার চোখের জিজ্ঞাসা যেন পড়তে পারল এই নতুন মেয়ে।
—- হ্যাঁ স্যার, সেই নবাব সিরাজেরই বংশধর আমার বাবা। আমার নামও রেখেছেন সেই নবাবের মেয়ের নামেই। তাঁর বিশ্বাস ছিল কোনও দিন না কোনও দিন মীর জাফরের কোনও বংশধরের সঙ্গে আমার দেখা হবে। কোনও প্রতিশোধ নেবার কথা বলে যাননি আব্বা। শুধু বলেছেন, আমি যেন তাকে জিজ্ঞেস করি — কেন আমার সেই পূর্বপুরুষের রক্তে স্নান করেছিল ঘাতক তলোয়ার?
★
বাড়ি এসে আজকের ঘটনাগুলোর পূর্বাপর ভাবছিলাম।
ভাবছিলাম আমাদের এই উপমহাদেশের ইতিহাসের নানান কথা। এই যে আজকে কাঁটাতারের এপাশে আর ওপাশেও কথায় কথায় যাবতীয় খারাপ থাকার দায় চাপানো হয় অন্য ধর্মের মানুষের ওপর। দাঙ্গা হয় এখানে ওখানে। ভেঙে দেওয়া হয় মন্দির আর মসজিদ।
ইতিহাস কি সেই দায় আদৌ স্বীকার করে? আজ থেকে বহুযুগ আগে কিম্বা আড়াই শতাব্দীরও কিছু বেশি আগে যা ঘটেছে, অনেক জায়গায়ই সেই নিহত আর নিষ্ঠুর আত্মীয়ঘাতক বিশ্বাসঘাতকতার নায়কেরা সবাইই ছিল একই ধর্মের। মানুষের সর্বগ্রাসী উন্মত্ত লোভ ধর্মকে শুধু হননের অস্ত্র বলেই ব্যবহার করেছে চিরদিন।
সেই লোভের পথে ঝাঁপিয়ে পড়া মানুষ কিন্তু স্বধর্মীদেরও ক্ষমা করেনি। স্বধর্মীনিধনে তাদের উল্লাস ছিল দেখার মত। তথাকথিত যুক্তিও ছিল খরশান। সেই কবেকার কুরুক্ষেত্রে আর আড়াই শতাব্দী আগের পলাশীতেও। কী করে ভুলি? সিরাজউদ্দৌলা, মীর জাফর, মিরন, দানা শাহ, মুহম্মদী বেগ সবাই একই ধর্মের।
হ্যাঁ, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার কথা বলছি। পলাশির যুদ্ধে হেরে যাবার পর, সিরাজ তখন সপরিবারে পালাচ্ছেন। ভগবানগোলায় ক্ষুধার্ত নবাব পরিবারকে দানা শাহ নামের একজন খাবার দেয়। সেই একই সঙ্গে সে গোপনে খবর দেয় মীরজাফরকে। খিদের মুখে খাবার দিয়ে কাউকে হত্যার ব্যবস্থা করা, অকল্পনীয় সত্যিই।
সিরাজ ধরা পড়েন। কতবার যে আমি পড়েছি, নানান বই থেকে পড়ে ঝালিয়েছি, যাচাই করেছি সেই ইতিহাস।
‘আ হিস্ট্রি অব দা মিলিটারি ট্র্যান্স্যাকশনস্ অব দা ব্রিটিশ নেশন ইন ইন্দোস্তান’ বইতে রবার্ট ওরমে বর্ণনা দিয়েছেন সেই দিনটার।
“রাজমহল থেকে ধরে আনা সিরাজকে হাজির করা হল মীর জাফরের সামনে। মীর জাফরের সামনে দাঁড়িয়ে প্রাণভিক্ষা করেছিলেন সিরাজউদ্দৌলা। সেপাইরা মহলের অন্য দিকে নিয়ে গেল সিরাজউদ্দৌলাকে। ওদিকে মীর জাফর তার পারিষদদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে কী করা উচিত, তা নিয়ে।
তিনটে পথ খোলা ছিল। হয় তাকে মুর্শিদাবাদেই বন্দী করে রাখা হোক, অথবা দেশের বাইরে অন্য কোথায় কয়েদ করা হোক। তৃতীয় বিকল্প ছিল প্রাণদণ্ড। অনেকেই চেয়েছিলেন সিরাজকে বন্দী করে রাখতে। কিন্তু মীর জাফরের ১৭ বছর বয়সী পুত্র মিরন কড়া বিরোধিতা করেছিলেন। মীর জাফরের নিজস্ব কোনও মতামত ছিল না,” লিখেছিলেন রবার্ট ওরমে।
সিরাজকে নির্মম ভাবে হত্যা করে মীরজাফরের ছেলে মিরন আর মোহম্মদী বেগ। শুধু তাই নয়, পরের দিন সিরাজউদ্দৌলার ক্ষত-বিক্ষত দেহ হাতির পিঠে চাপিয়ে মুর্শিদাবাদের অলি-গলি, বাজারে ঘোরানো হয়েছিল। যেন সকলের কাছে প্রমাণ করার চেষ্টা যে সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত। ইতিহাসে এটুকুই পাওয়া যায়।
তাঁকে খুন করার সময় একটি শিশুকন্যা ছিল সিরাজের। নাম উম্মে জোহরা। সেই কন্যাকে তার মা লুৎফুন্নেসার সঙ্গেই টানা আটবছর বুড়িগঙ্গার তীরে জিঞ্জিরার এক প্রাসাদে বন্দী করে রাখা হয়। তার পরে মুক্ত করে দেওয়া হয়। উম্মে জোহরার পরে সময়ের সঙ্গে বহু শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে এগিয়ে চলে সিরাজের বংশধারা। সবার খোঁজও সেই ভাবে পাওয়া যায় না এখন। কোন প্রজন্ম চলছে তাদের? নবম কিম্বা হয় তো দশম।
আমি যতদূর জানি আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে বাংলাদেশ টিভিতে স্বনামধন্য সাংবাদিক ফজলে লোহানীর পরিচালনায়, ‘যদি কিছু মনে না করেন’ নামের এক ম্যাগাজিন অনুষ্টানে সেই রকম এক বংশধর সৈয়দ গোলাম মুস্তাফার সঙ্গে তিনি পরিচয় করিয়েছিলেন দর্শকদের।
কিন্তু কোনওদিনই আর স্বমহিমায় ফিরতে পারেনি সিরাজের হত্যাকারী মীরজাফরের পরিবার আর বংশধরেরা। তারা বিশ্বাসঘাতক বলে চির-চিহ্নিত হয়ে রয়েছে, এই উপমহাদেশে। উপমহাদেশের কোনও নবজাতক শিশুর নাম রাখা হয় না মীরজাফর। মীরজাফরের বংশ অথচ অবলুপ্তও হয়নি। তারা ঠিকই আনাচেকানাচে ছড়িয়ে রয়েছে। রয়েছে মুখ লুকিয়ে।
পলাশীর যুদ্ধ হয়েছিল আড়াইশ বছর আগে। বংশপরম্পরায় এখনো তারা যেন বয়ে বেড়াচ্ছে সেই পাপ। হীনমন্যতায়, লজ্জায় নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে বেঁচে আছে মীর জাফরের বংশধরেরা।
*
আগামী কাল থেকে আমার সহকর্মী হবে উম্মে জোহরা বৃষ্টি নামে সিরাজউদদৌলার এক অভাগিনী বংশধর। সে বড় হয়েছে তার বাবার নির্দেশ বুকে বয়ে নিয়ে। মীর জাফরের বংশধরের সঙ্গে কোনওদিন দেখা হলে তার কাছে সে কৈফিয়ত চাইবে, —- কেন? কেন সেদিন?
কী উত্তর দেব তাকে?
এই আমি রবিউল আলম দীপ্ত, সাধ্যমত পড়াশুনো করেছি। প্রতিষ্ঠাও কিছু পেয়েছি। কিন্তু মাথা উঁচু করে জানানোর মত বংশপরিচয় নেই আমার।
গোপন বংশ তালিকা থেকে আমি জানি সেই লজ্জার খতিয়ান। আমি সেই মুখ লুকোনোর বাধ্যতায় লুকিয়ে থাকা মীরজাফরের এক উত্তরপুরুষ।
অথচ আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তি যুদ্ধে আহত হয়ে এক পা কাটা যায় তাঁর। আমাদের এই দেশকে আমরা ভালোবাসি কারওর চেয়ে কম নয়। তবু দুই শতাব্দীর পুরোনো অনপনেয় কালির দাগ কি থেকেই যাবে আমাদের গায়ে?
নাকি একদিন বৃষ্টির সামনে নতজানু হয়ে স্বীকার করব হাহাকারটুকু! বলব,
— বৃষ্টি মা গো,মস্ত ভুল করেছিল আমার পূর্বপুরুষ।
নিঃশর্ত ক্ষমা চাইব।
সেই সাহস কি কোনওদিন হবে আমার?