পদার্থবিদ্যায় নিউটন সাহেব জাড্যের ধারণা দিয়েছিলেন, অর্থাৎ যে মাতাল যে তালে চলেছে তাকে না ঘাঁটালে সে নিজের তালেই চলতে থাকবে- ঠিক এরকমই জাড্যের ধারণা চিকিৎসাবিদ্যাতেও রয়েছে, তাকে বলে Therapeutic inertia, অর্থাৎ চিকিৎসা করতে বা করাতে ল্যাদ। ব্যাপারটা চিকিৎসকের ক্ষেত্রেও রয়েছে, রয়েছে রোগীর ক্ষেত্রেও। আবার চিকিৎসার বিভিন্ন স্তরে জাড্য বিরাজমান। উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে।
ধরুন, আপনি ডায়াবেটিক রুগী। টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগী বেঁচেবর্তে থাকলে এবং অন্য কোনো কমপ্লিকেশন না হলে কালক্রমে তার ইনসুলিন ইনজেকশন প্রয়োজন হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু আপনি ইনসুলিন নিতে চান না, অনেকেই চায় না, সত্যি বলতে কেউই চায় না। এখন চার রকম ওষুধ খেয়েও সুগার কন্ট্রোলে নেই, ইনসুলিন আপনি নেবেন না, বেশি পীড়াপীড়ি করলে আপনি অন্য ডাক্তারের কাছে পালাবেন, তাই আপনার ডাক্তারবাবুও বেশি কিছু বলেন না- এটা এক প্রকার জাড্য। চিকিৎসার অপটিমাইজেশনে জাড্য।
আবার আপনার বিপি ক্রমাগত ১৪৪/৯০ আসছে- আপনাকে বলা হচ্ছে ওষুধ শুরু করতে, আপনি বলছেন সারাজীবনের ওষুধ আমি খাবোনা, নুন খাওয়া কমাবো তারপর দেখি ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ কেউ বলবে বয়স বাড়লে বিপি বাড়ে, তাই এই বিপি নর্ম্যাল। এভাবে চলতে চলতে একদিন আপনার স্ট্রোক হলো- এটা চিকিৎসার ইনিশিয়েশনে জাড্য।
আবার ধরুন আপনার গল স্টোন আছে, মাঝে মধ্যে ব্যথা হয়। অপারেশন করানোর কথা শুনলেই জ্বর আসে। হালকা হালকা ব্যথা চলছে, বিভিন্ন ইউটিউবের ভিডিওর জ্ঞান চলছে, কিন্তু অপারেশন শুনলেই জ্বর, তারপর একদিন সত্যি জ্বর আসে, সাথে জন্ডিস এবং পেটে ব্যথা- কোলানজাইটিসের বিখ্যাত ট্রায়াড। এটা কেমন জাড্য?- অপারেশন জাড্য।
তারপর ধরুন ক্রমাগত ডায়রিয়া লেগেই আছে, ডাক্তার দেখালেন- বিভিন্ন টেস্ট লেখা হলো, কেউ কেউ টেস্ট দেখেই পালাবেন, বলবেন আগে ওষুধ খেয়ে দেখি কী হয়, তারপর ভাবা যাবে। কেউ কেউ আবার বেসিক টেস্ট সেরে যেই না কোলনস্কপির কথা শুনবেন, “বাবা গো, মা গো, গেলুম গো” বলে ছুটে পালাবেন। রোগও ধরা পড়বে না, চিকিৎসা তো দূর অস্ত। তারপর তাঁরা যাবেন ভেলোর, সেখানে ব্রেন বায়োপসি বলা হলে সেটাও তাঁরা নিঃসংকোচে করাবেন আর ফিরে এসে বলবেন, বাংলার ডাক্তার রোগ ধরতে পারেনা, ভেলোরে সব ভগবান। এটা হলো ইনভেস্টিগেশন জাড্য।
তবে এই সব জাড্যের উপর আসল জাড্য হলো ‘নিমতা জাড্য’। যদিও জাড্য নিউটনের দান, কিন্তু এই নামকরণটার কপিরাইট আমিই নিলাম। রোগীর হঠাৎ বুক ব্যথা হলে ‘গ্যাসের ব্যথা’ বলে কাটিয়ে দেওয়া এবং ঘরেই গুরুত্বপূর্ণ সময়টা কাটিয়ে দেওয়া এবং পরে রোগিমৃত্যুর অপরাধবোধটা স্থানীয় ডাক্তারের উপর চাপিয়ে দেওয়া- একটা বিখ্যাত ঘটনার প্রেক্ষিতে এই নামকরণ। যদিও এই ঘটনা একদমই বিরল নয়।
এদেশে খুব কম রোগীই হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকে সময়োপযোগী চিকিৎসা পান। সৌরভ গাঙ্গুলির যখন হার্ট অ্যাটাক হয়, উনিও প্রথমে সেটা গ্যাসের ব্যথা বলে কাটিয়ে দেন, কিন্তু ব্যথা ক্রমাগত হতে থাকায় উনি হাসপাতালে আসেন (অর্ণব গোস্বামীর ইন্টারভিউ থেকে গৃহীত) এবং এই জিনিসটা হয়তো কোন ডাক্তারের ক্ষেত্রে হলেও একই ঘটনা ঘটতো। আর এভাবেই salvagable myocardium, salvagable neuron আমরা হারিয়ে ফেলি।
এখন এই জাড্যের কারণ কী? এর কারণ হলো denial, আমার বা আমার আত্মীয়ের যে কোনো বড় রোগ হতে পারে বা তার বড় চিকিৎসা লাগতে পারে এটা মানতেই আমাদের কষ্ট হয়। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির মহাভারতে বলেছিলেন,এত মানুষকে মরতে দেখেও মানুষ ভাবে সে কোনোদিন মরবে না, এটাই সবচেয়ে বড় আশ্চর্য। ঠিক তেমনি এই denial টাও আশ্চর্য, যদিও এটাই সত্যি।
সবশেষে বলি, সব নিয়মের যেমন ব্যতিক্রম আছে, এই জাড্যেরও আছে। কোনো প্রেসারের রোগীকে বলে বুঝিয়ে প্রেসারের ওষুধ শুরু করে দিলেন, বছর খানেক পর তার ঘ্যানঘ্যান শুরু হবে। তারপর এক সময় আপনি দেখবেন উনি বলতে শুরু করেছেন, প্রেসার তো এখন নর্ম্যাল তবে প্রেসারের ওষুধ কেন? এবং এক সময় উনি সেই ওষুধ বন্ধ করে তবেই শান্তি পাবেন। এক্ষেত্রে এই মাতাল কেন এক তালে চললো না, কোন কোন বাহ্যিক শক্তি তার জাড্যে বাধা সৃষ্টি করলো, সে নিয়ে পরে একদিন আলোচনা হবে। আপাতত এটাই থাক 🤣🤣