নীরবে চিকিৎসাজগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল আজ। ডাঃ রামকৃষ্ণ দত্তরায় চলে গেলেন। আমার অকাজের জীবনে এমন একজন মানুষকে গুরু হিসাবে পেয়েছিলাম অনেক বছর ধরে, সে আমার পরম সৌভাগ্য।
ডাক্তারি শিক্ষার প্রথম দিন থেকে আলো হাতে পথ দেখিয়েছিলেন এই পরম শ্রদ্ধার মানুষটি।
এমন প্রচারবিমুখ অথচ নাড়ি টিপে একদম ঠিকঠাক রোগ ধরতে পারেন এমন ডাক্তার আজ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আজ, ঝাপসা চোখে যা যা মনে পড়ছে –এখুনি যদি লিখে না ফেলি, মনে হচ্ছে কালের অতলে হারিয়ে যাবে সব কথা।
স্যারের গলা শুনতে পাচ্ছি –“দ্যাখেন দ্যাখেন, বুকের বাঁ দিকটা স্টেথো বসিয়ে দ্যাখেন, একটু ঝুঁকিয়ে বসান –পেলেন? কি পেলেন? ” হার্টের সঠিক মার্মারের শব্দ বলতে পারলে স্যরের মুখের সেই মৃদু তৃপ্ত প্রশান্ত হাসি । হ্যাঁ, সব রোগী সব ছাত্রছাত্রীদেরই স্যর ‘আপনি’ বলতেন । একদিন অভিমান করে বলেছিলাম আমরা –আমাদের এমন দূরের সম্বোধন করেন কেন ? স্যর বলেছিলেন –“পেশেন্টদের সামনে আমি যদি আপনাদের সম্মান দিই তাহলে পেশেন্টরাও আপনাদের মানবে । এটা সব মানুষকে সম্মান দেবার আমার নিজস্ব একটা সামান্য পদ্ধতি ” । সেই সবাইকে সম্মান দেওয়া যে কতদূর হতে পারে –একটা ঘটনা বলি । আমাদের বর্ধমান মেডিকেল কলেজে সেই সময়ের 1985-86 সালের CBM Ward এর পরিস্থিতি যারা দেখেছেন তারা জানেন , যারা দেখেননি শত বর্ণনা দিলেও বুঝবেন না । এক বিছানায় পাঁচজন, মেঝেও থিকথিক করত রোগীতে । একদিন সকালের রাউন্ডে — বিষ্ঠাআবৃত দেহ, পুঁজনিঃসৃত বিকলাঙ্গ পদযুগল নিয়ে এক পথের মানুষ রোগী বারান্দায় আড়াআড়ি ভাবে পড়ে আছে ওয়ার্ডে ঢোকার মুখে । প্রবেশ পথটা আটকেই । সবাই তাকে ডিঙিয়ে যাতায়াত করছেন –ছাত্রছাত্রী ,কর্মী, সিস্টার এমনকি ডাক্তাররাও । আমাদের নিয়ে রাউন্ডে ঢোকার মুখে স্যর একটু থমকালেন । তারপর নীচু হয়ে হাঁটু মুড়ে বসে , সেই মানুষটিকে পরম মমতায় হাত দিয়ে ধরে সরিয়ে শুইয়ে দিলেন দেয়াল ঘেঁষে যাতে আর কেউ একজন মানুষকে পা দিয়ে ডিঙিয়ে যেতে না পারে । সেই প্রায় অচেতন রোগী কপালে হাত ঠেকিয়ে একটু স্যালুটের চেষ্টা করেছিল সেদিন । আর আমরা স্যরের ওইটুকু নীরব গেসচারে অনেককিছু শিখে গেলাম । মানুষকে সম্মান দেওয়া ।
মনে পড়ে গেল –এই তো , আজও চেম্বারে ঢুকে যখন প্রশ্ন করি –কজন পেশেন্ট আছে ? সহায়িকা বললেন –পনেরোটা । ওনাকে বললাম –বল , পনেরোজন –মানুষ কখনো “টা” হয়না । রোজই একই কথা বলি । অবচেতনে সেই স্যরের শিক্ষা ।
আমি স্যরের প্রথম মহিলা হাউসস্টাফ –আমার আগে নাকি স্যর মহিলা কাউকে নিজের ইউনিটে নিতেন না শুনেছি –নাইট ডিউটিতে অসুবিধে হবে বলে । আমাকে নিতে বাধ্য হলেন , মেডিসিনে টপার ছিলাম আর নিয়ম অনুযায়ী HOD র ইউনিটেই আমার পড়বে । তারপর –নির্দিষ্ট একবছর শেষ হয়ে গেলেও স্যর আর ছাড়েন না , আমিও চর্মবিভাগে নিজের কাজ শেষ করেই স্যরের রাউন্ডে ঢুকে পড়ি , স্যর ছেলেমানুষের মতো বলেন –NBM এর পাঁচ নম্বর বেড দেখে আসবেন , OFM এর বারো নম্বর । সব ইন্টারেস্টিং কেস বেছে বেছে দেখার পর আলোচনা হত ।
প্রতিদিন রাউন্ডের আগে স্যরের হাঁক –হারুউউ–
হারুও বুঝে যেত, আমরাও । এবার হারু কফি আনবে সবার জন্য । আলমারি থেকে হ্যারিসন বা প্রাইস এর বই বেরোবে , বা ব্রেইনের নিউরোলজি –আগের দিনের কেসগুলো সব পড়া হবে ।
রাতের রাউন্ড শেষ করতে বারোটা বেজে যেত , প্রত্যেক পেশেন্টের পাশে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে দেখা , পড়ানো । জন্ডিসের ধরণ বুঝতে বেডপ্যান টেনে রোগীর মলমূত্রও,দেখা হত । স্যর নিজে তো ছাত্র অবস্থায় কোন রোগী মারা যাবার পর তার পোস্ট মোর্টেম হলে সেখানে গিয়েও দাঁড়িয়ে থাকতেন–রোগের কারণটা আরো ভালো করে বোঝার জন্য । ডাক্তারিতে মিরাকেল হয় না , সব রোগী বাঁচে না কিন্তু রোগনির্ণয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । সেখানে স্যর ছিলেন প্রায় মিথ -এমন নির্ভুল ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিস ।
ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার একটা ধাপও যেন বাদ না যায় , একটা ধাপ বাদ দেওয়া মানেই রোগনির্ণয়ে কিছু মিস করে যাওয়া –একথা আমাদের পইপই করে শিখিয়েছিলেন স্যর –ডাক্তারি জীবনে যেটুকু সফলতা তা স্যরের কথা মেনেছি বলে আর যেখানে ভুল হয়েছে তা স্যরের কথা অমান্য করার ফল ।
রাতে রাউন্ড শেষে খেয়াল হত স্যরের –“যাঃ, আপনারা তো মেসে খাবার পাবেন না –চলেন চলেন –বাসু –বৌদিকে খবর দাও, এই পাঁচজন দাদা দিদিও খাবে । ”
সে সময় বাসু ছিল স্যরের অনুগত ড্রাইভার । রাত দুপুরে পাঁচজন ছাত্রছাত্রী নিয়ে স্যর নিশ্চিন্তে টেবিলে বসতেন । রাত একটায় বৌদি ও স্যরের মা আমাদের যত্ন করে খাবার পরিবেশন করতেন । মেসের অখাদ্যপালিত আমরা ঘরের খাবার পেয়ে হাত চাটতাম, স্যর কি যে খেতেন কে জানে –শুধু ওই কেসটা , সেই কেসটাতেই মন পড়ে থাকত ।
পরে , স্যর যখন NRS এ চলে এলেন তখন আমিও কলকাতায় পড়ছি । প্রায়ই স্যরের ফার্ণরোডের বাড়িতে দেখা করতে যেতাম –মনের কোনো ধন্দ মেটাতে , অথবা এমনিই । বৌদি পুজোর ঘর থেকে ডেকে পাঠাতেন , মাসিমা বলতেন –না খেয়ে যাবে না । আর ,স্যর হাজারো প্রশ্ন উত্তর জমা করে রাখতেন –Skin manifestation of Internal Diseases বিষয়ে । প্রায় সকালেই আমাদের ওই সেশন চলত ।
স্যর শিখিয়েছিলেন –নিষ্ঠা ও যত্নে চিকিৎসার পরও রোগী যদি মারা যায় তাহলে ডাক্তারকে দুঃখ গোপনে রেখে কিছুটা নিস্পৃহ হয়ে পরবর্তী রোগীর চিকিৎসা করতে হয় কারণ জীবিত রোগীর প্রয়োজন ডাক্তারের সম্পূর্ণ মনোযোগ ।
আমার দুর্গাপুরে সংসার চাকরিতে স্যরের একটু আপশোস ছিল — চিকিৎসাবিদ্যার পথপরিক্রমাটা হয়তো ঠিক সম্পূর্ণ হল না । স্যর চেয়েছিলেন আমি চিকিৎসক-শিক্ষক হই । জনস্বাস্থ্য ও সাধারণ মানুষের মধ্যে কাজ করার আনন্দ পেয়ে আমি একটু অন্য পথে হেঁটেছি ।
অনেক বছর দেখা করতে যাওয়া হয়নি, কেন কে জানে –ভেবেছি , আলো বাতাস বাবা মায়েরা যেমন চিরকাল থাকে স্যরও তো তেমনি আছেন, থাকবেনই চিরকাল ।
চিরকাল সত্যি থাকবেন আমার ও আমাদের মনে আদর্শ শিক্ষক , চিকিৎসক তো বটেই , একজন দার্শনিক হিসেবেও ।
সেদিন আমরিতে এক মৃত্যু নিয়ে অভিযোগ ভাঙচুরের পর স্যরকে কর্তৃপক্ষ হাসপাতালে যেতে বারণ করেছিল , স্যর দৃঢ় ভাবে বলেছিলেন –“আমি যাব , সব অভিযোগ ফেস করব কারণ আমি চিকিৎসায় কোনো ভুল করিনি ”
রাউন্ডে স্যরের দ্রুত চলার সঙ্গে আমরা পিছিয়ে পড়তাম । আজ-ও দেখছি আকাশের ছায়াপথে এক অনন্ত আলোর দিকে স্যর দৃঢ় পায়ে দ্রুত হেঁটে চলেছেন –সেই ধবধবে সাদা শার্ট পকেটে কলম, সাদা প্যান্ট , হাতে স্টেথো —
প্রণাম নেবেন স্যর ।
আপনার 1986 সালের হাউস স্টাফ -শর্মিষ্ঠা দাস
বিনা অনুমতিতে ভাগ করলাম।এ লেখা ডাক্তারদের গর্ব।
আমরা এমন একজনকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি-আমাদের জীবন সার্থক।
আমার সঙ্গে স্যরের ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিলো; ওনার ভালবাসা পেয়েছি; এর থেকে বেশী কিছু হয়না।
কিন্তু কর্তব্য করতে পারি নি।
অপূর্ব!
দিদি, রাধারাণী ব্লকে মাটিতে শোওয়া রোড ট্র্যাফিক অ্যাক্সিডেন্ট রোগীর ঘন্টার পর ঘন্টা বসে’ সেলাই করা তারপর সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না।মাটিতে শোওয়া রোগীর ক্যাথেটার পরানো-যে করেনি, সে কিছুতেই এই অবাস্তব পরিস্থিতি ভাবতে পারবে না। ইউরো ব্যাগ ওপরে আর রোগী মাটিতে।এক অসম্ভব লড়াইয়ের গল্প।
লেবার রুমে শেষ মুহূর্তে বাচ্চাকে বাঁচাতে এপিসিওটোমি করা। এ্যাম্নিওটিক ফ্লুইড আর মায়ের পায়খানায় মাখামাখি হয়ে-এ এ্যাক অন্য পরাবাস্তব জীবন।