- প্রবল শীতের সে সন্ধ্যেয় বৃদ্ধা যখন জোয়ান নাতির হাত ধরে চেম্বারে এসেছিলেন তখন চেম্বার প্রায় শেষ। হাতে একগুচ্ছ প্রেসক্রিপশনের বান্ডিল। প্রেসক্রিপশনের বান্ডিলে চোখ বোলাতে বোলাতেই বৃদ্ধার জোয়ান নাতি বলে উঠলেন, গত চার বছর ধরে ভুগছে ঠাকুমা। ডান দিকের গাল দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ নাকি ইলেকট্রিক শকের মত যন্ত্রণা হয়। চারদিক ছুটেছি ডাক্তারবাবু। প্রথমে গ্রামের লোকাল দাঁতের ডাক্তারের পরামর্শে ডানদিকের নিচের চোয়ালের একটা দাঁত তুলে ফেলা হলো। কমলো তো না-ই, বরং বেড়ে গেলো। এরপর বিভিন্ন চিকিৎসকের পরামর্শে একে একে মোট চার খান দাঁত তুলে ফেলা হলো। কিছুই কমলো না। অন্য রাজ্যে নিয়ে গেলাম। ইসিজি করে বললো – হার্টের রক্ত সংবহন বাধাপ্রাপ্ত হয়ে নাকি এই যন্ত্রণা। সে জন্য অ্যাঞ্জিওগ্রাফি, ইকোকার্ডিওগ্রাফি করে গুচ্ছের ওষুধ খাওয়া চলছে। তাতে প্রেসারটা নিয়ন্ত্রণে আছে ঠিকই কিন্তু ডান গালের ব্যথার এত্তটুকু উন্নতি হয়নি। এর পর সরকারি হাসপাতালের জেনারেল ফিজিসিয়ানের পরামর্শে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছেও যাওয়া হলো। উনার ওষুধে কিছুটা কমলেও সে মাত্র কয়েকদিনের জন্য। ওষুধ বন্ধ করলেই ব্যথা পূণর্মূষিক ভবঃ। ঠাকুমার পানের বাটা আজ চার বছর ধরে ঘরেই পড়ে আছে। আজকাল পান খেতেও ভয় পান। তাতে নাকি ব্যথাটা চাগাড় দিয়ে ওঠে।
সব কথা গুলো শুনে, ঠাকুমার ডান গালে হাত দিতেই ঠাকুমা বললেন, উপর আর নিচ পাটির মাঝে যন্ত্রণাটা হয়।
যন্ত্রণাটা প্রথমে একদম ইলেকট্রিক শকের মত লাগে, তারপর এক্কেবারে অসহ্য যন্ত্রণা। পান চিবুলে, ঠান্ডা জল খেলে ব্যথাটা বেড়ে যায়। তবে বাপু মিনিট খানেক পরেই যন্ত্রণাটা আর থাকে না। কিন্তু যেটুকু সময় থাকে, সে সময় মনে হয় আর বাঁচবো না। অনেক জায়গায় ঘুরেছি বাপু। তুমি আমাকে বাঁচাও। বলতে বলতেই দাঁত ফোকলা চোপসানো গালের ওপর দিয়ে দুফোঁটা জলের ধারা নেমে এলো।
ততক্ষণে বান্ডিলের সমস্ত কাগজে চোখ বোলানো কমপ্লিট। নিচ থেকে সাইকিয়াট্রিস্টের প্রেসক্রিপশনটা তুলে ধরে বললাম, ইনার ওষুধগুলো খেয়ে তো ভালোই ছিলেন। বন্ধ করে দিলেন কেন?
নাতি বললো- ওই ওষুধ খেলে নাকি অনেক সমস্যা হয়। পাড়ার কোয়াক চিকিৎসক মোবাইল ঘেঁটে বললেন, এ ওষুধ খেলে নাকি রুগী মরে যেতে পারে। চামড়ার কঠিন রোগ হতে পারে। এসব শুনে ভয় পেয়ে সব ওষুধ বন্ধ করে দিয়েছি।
শুনে এক মুহূর্ত স্থাণুবৎ হয়ে হাঁ করে গোল গোল চোখে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম আমি। একজন মাষ্টার ডিগ্রি করা চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন দেখে একজন ভুঁইফোড় চিকিৎসক গুগুল উলটে ভুল ধরছেন! হা হতোস্মি!
বৃদ্ধার কর্নিয়াল রিফ্লেক্স নরমাল, ডানদিকের মুখমন্ডলে চেপেচুপে পরীক্ষা করলাম কিছুক্ষণ। সবই ঠিক আছে।
বেশি কথা না বাড়িয়ে প্রেসক্রিপশন টেনে কারবামাজেপিন গ্রুপের ওষুধ লিখে বললাম, এই ওষুধটা চলতে থাকুক।গায়ে কোথাও কালো ছোপ পড়লে, বা কোনো র্যাশ বেরোলে ওষুধটা বন্ধ করে জানাবেন। একমাস পর আবার একবার দেখবো।
বৃদ্ধা ফিরলেন নির্ধারিত সময় পেরিয়ে। যতদিন ওষুধ খাচ্ছিলেন ততদিন ভালো। একমাস পর যেই ওষুধ বন্ধ করেছেন, আবার যেই কে সেই।
নাতিকে বুঝিয়ে বললাম, তোমার ঠাকুমা, ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়া-তে ভুগছেন। মুখমন্ডলের ছবি এঁকে এ নার্ভের তিনটি বিভাগ ও তার সরবরাহকৃত অংশের বর্ণনা দিয়ে বললাম, এ রোগের কোনো কারণ সেভাবে পাওয়া যায় না। সহজলভ্য কোনো টেষ্টে এর উপস্থিতি টের পাওয়া মুস্কিল। চিকিৎসকের অভিজ্ঞতায় এ রোগের নির্ণয় সম্ভব। সাইকিয়াট্রিস্ট রোগটিকে সঠিক ভাবেই ডায়াগনোসিস করে কারবামাজেপিন গ্রুপের ওষুধ লিখেছিলেন। কিন্তু পাড়ার ভুঁইফোড় চিকিৎসকের গুগুলসেবি বদান্যতায় মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ হয়ে এই অবস্থা। দীর্ঘদিন ওষুধ খেতে হবে। কারুর কারুর এ ওষুধে এস.জে সিন্ড্রোম বা টি.ই.এনের মত স্কিনের রোগ হতে পারে বৈকি। কিন্তু সেক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে ও সাথে সাথে চিকিৎসকের পরামর্শ নিলেই চটজলদি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। তবে মাস খানেক ওষুধ খাওয়ার পরেও যখন বিশেষ কিছু হয়নি, সেখানে ওসব ভয় না পেয়ে ওষুধটা চালিয়ে যাও। নির্দিষ্ট সময়ে ওষুধ বন্ধ করবো।
এবার বেশ প্রত্যয়ের সাথে চেম্বার ছাড়লেন ঠাকুমা।
ফিরে এলেন পরের শীতে। পান চেবানো, ফোকলা মুখে একরাশ হাসি মেখে। চিবুক টেনে চুমা খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে মনে মনে কি সব বিড়বিড় করে হাতে ধরিয়ে দিলেন প্রসাদী জবা। মা কালীর থানে পূজা দিয়েছি বাবু। আমার আয়ু যেন তোকে দেয় মা।