আমার ইতিহাস জ্ঞান মারাত্মক। মাধ্যমিক দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। তরাইনের প্রথম, দ্বিতীয় যুদ্ধের সাল মনে রাখতে হবে না। বাবর, শের শাহের রাজ্য বিস্তার নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে হবে না। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তকে মাঝরাতে স্বপ্নে দেখে চমকে উঠতে হবে না।
ভাগ্যের পরিহাসে ডাক্তারি পাশ করে চাকরির প্রথম পোস্টিং পেলাম মুর্শিদাবাদ জেলায়। এই জেলা ইতিহাসের খনি। খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক যে রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন সেটি মুর্শিদাবাদেরই কর্ণসুবর্নে অবস্থিত। তারপরে ভাগীরথী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে, এসেছে নবাবী আমল। অনেক যুদ্ধ, অনেক বিদ্রোহ, অনেক বিশ্বাসঘাতকতা। মুর্শিদাবাদের গ্রামে গ্রামে ইতিহাস। লোকগানে ইতিহাস। পুকুর বা রাস্তার জন্য মাটি খুড়লেই দুচারটে পুরোনোযুগের মুদ্রা বা মূর্তি উঠে আসে।
আমি অবশ্য সেই সব নিয়ে মাথা ঘামাইনি। বরঞ্চ অনেক বেশী মাথা ঘামিয়েছি ব্লকের সব বাচ্চাদের পোলিও খাওয়ানো নিয়ে। দুটো বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পর মায়েদের লাইগেশন করা নিয়ে। আউটডোরের পরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাব সেন্টার পরিদর্শনে গেছি। ধূ ধূ মাঠের মধ্যে ভাঙাচোরা টেরাকোটার মন্দির দেখেছি। পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ি, পুরোনো মসজিদ চোখে পড়েছে। কোনওদিন বিন্দুমাত্র উৎসাহ পাইনি। বরঞ্চ সাপখোপের ভয়ে পালিয়ে এসেছি।
তবে পীযূষদা যখন বলল, “ঐন্দ্রিল, চাঁদ সদাগরের মেলা দেখতে যাবি?” এক কথায় রাজি হলাম। গ্রামের মেলায় যাওয়া আমার কাছে প্রায় নেশা হয়ে উঠেছিল। খড়গ্রামে গ্রামীণ হাসপাতালে চাকরির সময় আশেপাশে যত মেলা হয় সব মেলায় গেছি। নগরের পীরের মেলা, কাপাসডাঙ্গার বৈশাখী মেলা, কান্দীর রাসের মেলা, রথের মেলা।
আউটডোরের পর সঞ্জীবদাকে ডিউটি ধরিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কালুদার ভ্যান এবড়ো খেবড়ো মাটির রাস্তা দিয়ে চলেছে। দুপাশে মারকাটারি সবুজ ধানক্ষেত। ছইয়ের মধ্যে বসে পীযূষদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “মেলার নামটা চাঁদ সদাগরের মেলা হল কেন?”
“এখানে একটা অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ আছে। আগে দ্বারকা নদী ঐ খাতে বইত। কথিত আছে এখানে চাঁদ সওদাগরের ডিঙ্গা মা মনসার অভিশাপে ডুবে গেছিল। ঐ বিশাল বিলটিকে সকলে চাঁদ সদাগরের বিল বলে।”
আমি বললাম, “দেখো, আমি ইতিহাসে পাতিহাঁস। তবে যেটুকু মনে হচ্ছে, চাঁদ সদাগর পূর্ব্বঙ্গের বাসিন্দা ছিলেন। সম্ভবত চট্টগ্রাম অঞ্চলের। তাঁর নৌকা এতদূরে এসে ডুববে কি করে?”
পীযূষদা বলল, “অতসব আমি জানি না। ভ্যান থেকে নাম। এবার হাঁটতে হবে।”
উঁচু মাটির রাস্তা থেকে মাঠের আলপথে নামলাম। পীযূষদা বলল, “বুঝলি ঐন্দ্রিল, এতক্ষণ বাঁধের উপরে ছিলাম। এখন হাওরের উপর দিয়ে যাচ্ছি।”
“হাওর কি বস্তু?”
“তুই খড়গ্রামে চাকরি করতে এসেছিস। হাওর আর বিলের দেশে। আর হাওর কাকে বলে জানিসনা!”
“মেডিকেল অফিসারের ইন্টারভিউ এর সময় আমায় কুকুরে কামড়ানোর আর সাপে কামড়ানোর চিকিৎসা পদ্ধতি জিজ্ঞাসা করেছিল। আর জিজ্ঞাসা করেছিল ডেলিভারির সময় আটকে গেলে ফরসেপ দিতে পারব কিনা। একবারও কেউ বলেনি হাওর কি না জানলে খড়গ্রাম হাসপাতালে চিকিৎসা করা যাবে না।”
“শোন, হাওর হল গরীবের সমুদ্র। সাধারণত নদীর ধারে বিস্তীর্ণ নীচু জমি বন্যা প্রতিরোধ করার জন্য বাঁধ দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়। বর্ষায় সেটা ভেসে গিয়ে সমুদ্রের রূপ নেয়। বর্ষা শেষে হাওরের জল নেমে যায়। কিছু স্থায়ী বিল জেগে উঠে। গ্রীষ্মকালে হাওরকে সাধারণত বিশাল মাঠের মতো মনে হয়। তখন এখানে চাষবাসও হয়। প্রতি বছর বন্যা হওয়ার জন্য হাওরের মাটি খুব উর্বর হয়।”
ঘণ্টা দেড়েক হেঁটে পৌছালাম মেলা প্রঙ্গনে। বেশী বড় মেলা নয়। আলপথ দিয়ে অনেকটা হেঁটে আসতে হয় বলে মেলায় লোকের ভিড় কম। একপাশে বিলের ঠিক ধারে বাঁধানো মন্দির। মন্দিরের দেওয়ালে কাদার আস্তরণ। বছরের অনেকটা সময় মন্দির জলের তলায় থাকে।
মন্দিরে মনসা আর শিব ঠাকুরের মাটির মূর্তি। একটু আগে পুজো শেষ হয়েছে। পুরোহিতমশাই স্থানীয় একটি জুনিয়র হাই স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক।
তাকেই জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন এখানে চাঁদ সদাগরের নৌকা ডুবেছিল?”
উনি বললেন, “তাহলে আপনাকে পদ্মপুরানের থেকে কিছুটা অংশ শোনাই।
‘নবদুর্গা গোলহাট বামেতে রাখিয়া
চলিল সাধুর ডিঙা পাটন বহিয়া
দক্ষিন পাটনে যবে গেইলা সদাগর
শঙ্খ -মুক্তা-চুনি আইনা বোঝায় কৈলা ঘর।’
এটাই সম্ভবত সেই পাটনের বিল। সরকারী হিসাব অনুযায়ী এককালে তিন হাজার বিঘার জলা ছিল। কায়্স্থ কারিকাতেও লেখা আছে যে নবদূর্গা গোলহাটকে বাদিকে রেখে চাঁদ সওদাগরের নৌকা পাটনের বিল দিয়ে যাতায়ত করত।
এখনও নবদুর্গা, গোলহাট, কল্লা, জজান প্রভৃতি গ্রামগুলি চাঁদ সওদাগরের চিহ্ন বহন করে চলেছে। চাঁদ সওদাগর পূর্ববঙ্গের বাসিন্দা ছিলেন না রাঢ়ের তা নিয়ে কেউ কোনদিন গবেষনাও করেননি। কারন বেশিরভাগ ঐতিহাসিক মনে করতেন চাঁদ সওদাগরের কোন বাস্তব ভিত্তি নেই। তিনি মঙ্গল কাব্যের একটি কাল্পনিক চরিত্র। আর আমাদের মুর্শিদাবাদ জেলা তো চিরকালই অবহেলিত।”
আমি গম্ভীর মুখে বললাম, “বুঝলুম।”
পুরোহিত মশাই, আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বললেন, “চলুন, আপনাদের একজনের সাথে আলাপ করিয়ে দি। ও আপনাদের আরও ইন্টারেস্টিং গল্প শোনাতে পারবে।”
সেই ব্যক্তি একটি ইমিটেশনের দোকানের মালিক। সুব্রত পাত্র। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। এই বয়সেও পেটানো চেহারা। গল্প করতে ওস্তাদ।
দোকানের ভার কর্মচারীর উপর দিয়ে তিনি আমাদের সাথে এলেন। আমরা চারজন মুড়ি আর চপ নিয়ে বিলের ধারে ফাঁকায় গিয়ে বসলাম।
সুব্রত বাবু বললেন, “আমার বাড়ি বীরভূমে, চিনপাইতে। আমি সারা বছর বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ঘুরে ঘুরে মেলা করে বেড়াই। এই চাঁদ সদাগরের মেলায় আমি পঁয়ত্রিশ বছর ধরে আসছি। একবারও মিস করিনি।”
আমি বললাম, “প্রত্যেকবার এসেছেন?”
“হ্যাঁ, প্রত্যেকবার। আসলে চাঁদ সদাগর মানুষটার প্রতি আমার ভয়ংকর দূর্বলতা আছে। সেই অন্ধকার মধ্যযুগে একা মানুষটি মাথা উঁচু করে দেবী মনসার অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। মা মনসা তার বন্ধু ধন্বন্তরীকে ছলনার আশ্রয় নিয়ে হত্যা করেন। সর্পাঘাতে তাঁর ছয় পুত্রের প্রাণনাশ করেন। তবু চাঁদ সওদাগর মাথা নত করেন নি। মা মনসাকে পুজো দিতে রাজি হন নি। আজকালকার নেতারা যারা সামান্য লাভের জন্য বারবার দল বদলায়, আজ এই দিদির কাল ঐ দাদার পুজো চড়ায় তাদের একজনও যদি চাঁদ সদাগরের মত হত।
শত দুঃখকষ্টের মধ্যেও তিনি আবার বাণিজ্যে বের হন। সফল বাণিজ্যের পর তিনি যখন ধনসম্পদে জাহাজ পূর্ণ করে গৃহে প্রত্যাবর্তন করছেন, তখনই মনসা প্রচণ্ড ঝড় তুলে তাঁর বাণিজ্যতরী ডুবিয়ে দেন। তাঁকে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করতে হয়। কিন্তু তিনি তাঁর আদর্শে অবিচল ছিলেন।
তাঁর অন্তিম পুত্র লক্ষ্মীন্দর মনসার ষড়যন্ত্রে বাসর ঘরেই সাপের কামড়ে মারা যান। এত শোকেও তিনি মনসার সাথে কোনও রকম সমঝোতায় আসেন না।
যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি মনসাকে পুজোর ফুল দিতে রাজি হন। তিনি বাম হাতে, মুখ ঘুরিয়ে বসে ফুলটিকে ছুঁড়ে দেন।
এটা কি তাহলে চাঁদ সওদাগরের পরাজয়। পরাজয় তো বটেই। কিন্তু তিনি মা মনসার শক্তি আর ছলনার কাছে পরাজিত হননি। তিনি পরাজিত হয়েছিলেন একরত্তি একটা মেয়ের ভালোবাসার আবদারের কাছে। বেহুলা- তাঁর পুত্রবধূ। মনসামঙ্গলের আর এক আশচর্য চরিত্র।”
পীযূষদা বলল, “এতদিন ধরে এখানে আসছেন, আমাদের শোনানোর মত কোনও অভিজ্ঞতা নেই।”
“নেই আবার। অনেক আছে। তবে আপনারা বিশ্বাস করবেন কিনা সেটা আপনাদের ব্যপার।”
“বিশ্বাস করব না কেন?”
“যদি বলি আমি চাঁদ সওদাগরকে নিজের চোখে দেখেছি…”
পীযূষদা বিষম খেলো। আমি বলে ফেললাম, “ডিলা গ্রন্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক ইয়াক…”
সুব্রতবাবু অবাক হয়ে বললেন, “এর মানে?”
“আপনার কথা শুনে আমার আরেকজনের কথা হঠাৎ মনে পড়ল। যাহোক আপনি চালিয়ে যান।”
সুব্রত বাবু একমুঠো মুড়ি চেবাতে চেবাতে শুরু করলেন, “আশির দশক থেকে আমি এই মেলায় আসি। যেকোনো মেলায় আমরা দু একদিন আগে যাই। তাতে দোকান করার ভালো জায়গা পাওয়া যায়।
প্রায় বছর পঁয়ত্রিশ আগে মেলার দুদিন আগেই এখানে হাজির হলাম। সঙ্গে আমার কর্মচারী তারক। বাঁধের উপরের রাস্তাটা তখনও হয়নি। বাসথেকে নেমে আটমাইল হেঁটে আসতে হত।
মেলাপ্রাঙ্গণে পৌঁছে দেখলাম আমরা ছাড়া আর মাত্র দুজন দোকানদার এসেছে। তারা বাঁশ পুঁতে, ত্রিপল টানিয়ে দোকানের কাঠামো তৈরী করছে।
আমরাও কাজে লেগে পড়লাম। দুপুরে ওখানেই দুমুঠো ভাত ফুটিয়ে নিলাম। বিকেল নাগাদ কাজ শেষ হল। তারককে পাঠালাম গ্রাম থেকে চাল, ডাল, নুন, তেল, ডিম আনার জন্য।
তারক চলে গেলে আশপাশে নজর দিলাম। বিরাট প্রান্তরের মধ্যে দ্বিতীয় কোনও মানুষ দেখতে পেলাম না। বাকি দুজন দোকানদার সম্ভবত স্থানীয়। দোকান খাড়া করে তারা বাড়ি ফিরে গেছে।
এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালাম। বিলের পাশেই একটা শ্মশান। কালেভদ্রে দুচারজন এত দূরে মৃতদেহ নিয়ে আসে। তাছাড়া সারা বর্ষাকাল শ্মশান জলের তলায় থাকে।
আস্তে আস্তে সন্ধ্যে নামল। কিন্তু তারকের পাত্তা নেই। আজ রাত বারোটার পর চাঁদ উঠবে। তারক টর্চও নিয়ে যায়নি। অন্ধকারে বাঁধের উপর দিয়ে ফিরবে কি করে। এই অঞ্চল আবার সাপখোপের অন্য বিখ্যাত।
রাত গভীর হল। কত রাত তাও বুঝতে পারছি না। সাথে ঘড়িও নেই। এতো বেশ মুশকিলে পড়লাম। রাতে খাবো কি? একা একা এই জনমানব হীন ভুশুণ্ডির প্রান্তরে রাত কাটাবো কি করে। একেবারে আসার সময় দিন পাঁচেকের চাল ডাল বেঁধে আনলে হত।
সময় আর কাটে না। একটা হ্যারিকেন টিমটিম করে জ্বলছে। দুটো হ্যাজাক সঙ্গে আছে। কিন্তু একা মানুষ খামোকা হ্যাজাক জ্বেলে কি করব।
ঠিক করলাম টেনে ঘুম দিই। ভোরে উঠে যা হোক করা যাবে।
কিছুটা মুড়ি ছিল। তাই চিবাতে চিবাতে শোয়ার জন্য জায়গা খুঁজতে লাগলাম। শ্মশানের পাশে একটা উঁচু বেদী দেখলাম। দিব্যি শোয়া যাবে। বেদীটা পরিষ্কার করলাম। কারোর স্মৃতির উদ্দেশ্যে বানানো। মনে মনে তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম। তারপর হ্যারিকেনের পলতে নামিয়ে একটা চাদর মুড়ি দিয়ে শুলাম।
কিন্তু ঘুম আসে না। চারদিকে অদ্ভুত সব আওয়াজ। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে কে যেন গুণগুণ করে গান গাইছে। বাতাস ছোটো ছোটো গাছের ভেতর দিয়ে বওয়ার সময় ওরকম শব্দ হচ্ছে।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা। ঘুম ভাঙল একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজে। ঐ তো বাচ্চাটা আবার তীক্ষ্ণ স্বরে কাঁদছে। শরীর শিউরে উঠল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলাম যেটা আমি বাচ্চার কান্না বলে ভাবছিলাম, সেটা আসলে শকুনের ডাক।
হঠাৎ মনে হল কেউ যেন বেদীটার চারদিকে ঘুরছে। পায়ের কাছ থেকে আমার চাদর ধরে কে টানছে। চাদরে আমার আপাদমস্তক ঢাকা। সে কারণে বাইরের কিছু চোখে পড়ছে না।
আমার সারা গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল। কেউ কি আমার মুখের থেকে চাদরটা সরাতে চায়। কিছু দেখাতে চায়। কি সেই দৃশ্য? তবে যে দৃশ্যই হোক সেটা যে আমার পক্ষে খুব সুখকর হবে না, সেটা বলাই বাহূল্য।
আস্তে আস্তে কপালের উপর থেকে চাদর সরল। এখনও একইভাবে নীচ থেকে চাদর ধরে কেউ টেনে চলেছে। কিছু দেখতে পাচ্ছি না। আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে রেখেছি।
খুব বেশী ভয় পেলে মানুষ মরিয়া হয়ে যায়। আমারও তাই হল। যা থাক কপালে। চোখ খুললাম। এবং দেখলাম তিন চারটে শেয়াল আমার চাদর ধরে টানাটানি করছে।
শেয়াল দেখে ভয় একটু কমল। বললাম, ‘হেই… যা… যা।’ শিয়ালগুলো বড্ড ত্যাঁদড়। পালায়ও না। বরঞ্চ কাছে ঘেঁসে আসছে। কামড়ালেই চিত্তির।
হঠাৎ চারটে শেয়াল ভয়ংকর আতংকে লেজ গুটিয়ে পালাল। আমি বিস্ফারিত চোখে দেখলাম, একজন দীর্ঘদেহী ব্যক্তি শ্মশানের মধ্যে পদচারণা করছে আর মন্ত্র আবৃত্তি করছে…
‘ওঁ নমঃ শিবায় শান্তায় কারণত্রয় হে তবে
নিবেদয়ামি চাত্মানং ত্বং গতি পরমেশ্বর।
ওঁ ধ্যায়েন্নিত্যং মহেশং রজতগিরিনিভং চারুচন্দ্রাবতসং
রত্নাকল্লোজ্বলাঙ্গং পরশুমৃগবরাভীতিহস্তং প্রসন্নম্…’
আমার সাহস আর খুব বেশী অবশিষ্ট ছিলা না। এর পর কেমন একটা ঘোর লেগে যায়। সম্ভবত আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। হুঁশ ফেরার পর দেখি ভোর হয়ে এসেছে।”
এতক্ষণে পীযূষদা কথা বলল, “ওটা যে চাঁদ সদাগরের ভূত ছিল, বুঝলেন কি করে?”
সুব্রতবাবু প্রতিবাদ জানালেন। “ভূত নয়, আত্মা বলুন। চাঁদ সদাগর ছাড়া আর কোন মহাত্মা মৃত্যুর পরেও শিব স্ত্রোক পড়বেন।”
হয়ত গাঁজাখুরি গল্প। কিন্তু টর্চের আলোয় ধূ ধূ হাওরের মধ্যে দিয়ে ফেরার সময় রোমাঞ্চ লাগছিল। মনে মনে বলছিলাম,
“মধুকর ডিঙ্গা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে
এমনি হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ
দেখেছিলো , বেহুলাও একদিন গাঙ্গুরের জলে ভেলা নিয়ে-
কৃষ্ণা দ্বাদশীর জ্যোৎস্না যখন মরিয়া গেছে নদীর চরায়-
সোনালি ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বত্থ বট দেখেছিল, হায়…”