চেম্বার প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। স্যারের বন্ধু অবিনাশবাবুও এসে গেছেন। অবিনাশবাবু স্থানীয় স্কুলে কেমিস্ট্রির শিক্ষক। স্যার আর অবিনাশবাবু অভিন্নহৃদয় বন্ধু। রোজ আড্ডা না দিলে দুজনের কারোরই ভাত হজম হয় না। যদিও এখন করোনার জন্য আড্ডা বন্ধ। অবিনাশবাবু ছেলেকে দেখাবেন বলে এসেছেন। আমরা স্যারের জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে রাখছি। স্যার গ্লাভস, মাস্ক খুলতে যাবেন এমন সময় এক ভদ্রমহিলা মেয়েকে নিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে স্যারের চেম্বারে এলেন।
– দেখুন না স্যার, মেয়েটার আজ তিনদিন খুব জ্বর। গলাটা ব্যথা বলছে।
ডা. ঘোষ গলার ভেতরে টর্চ দিয়ে দেখলেন। তারপর গলার চারদিকে টিপেটুপে কীসব দেখে, বাচ্চার বুকে স্টেথো বসালেন। মায়ের দিকে ঘুরে বললেন..
– হুঁ.. গলাতে বেশ ইনফেকশন হয়েছে। গ্ল্যান্ডগুলোও বেশ ফুলেছে দেখছি। ওষুধগুলো ঠিকঠাক খাওয়ান। গরম জলে গার্গল করান। আর একটু গরম জলের ভাপ নাক-মুখ দিয়ে টানাবেন। মাঝে বাড়াবাড়ি না হলে সপ্তাহ দুয়েক বাদে একবার দেখিয়ে যাবেন।
– ঠিক হয়ে যাবে তো স্যার?
– হয়ে যাওয়া তো উচিত.. তারপর, দেখা যাক.. না কমলে আর একবার দেখিয়ে নেবেন, কেমন?
ভদ্রমহিলা চলে গেলেন। স্যার অবিনাশবাবুকে ডাকলেন..
– কই রে অবিনাশ, আয় বুবুনকে দেখি..
– দ্যাখ না, মাথার পেছন দিকে কেমন টিউমারের মতো হয়েছে। তুই তো বললে এক্ষুনি চেঁচামেচি করবি কিন্তু দ্যাখ, ওকে মাস ছয়েক আগে হোমিওপ্যাথি খাইয়েছিলাম। হোমিওপ্যাথি খাইয়ে টিউমারগুলো অনেক কমে গেছিল। তারপর এখন আবার বেড়েছে। তাই ভাবলাম..
– তাই ভাবলি এবার বিষাক্ত মডার্ন মেডিসিন খাওয়ানো যাক.. (দুজনেই একসাথে হেসে উঠলেন)
– তুই ভালো করে দ্যাখ তো.. সবসময় ইয়ার্কি করলে দেবো একখানা.. (অবিনাশবাবু ছদ্ম রাগে চোখ গোল গোল করলেন)
ডা. ঘোষ ভালো করে মাথার পেছনের গোল্লাগুলো টিপে দেখলেন। তারপর বুবুনের চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললেন..
– শেষ ছ’মাসে বাড়িতে কটা শ্যাম্পু কিনেছিস?
– মানে? দ্যাখ, আমি কিন্তু..
– ইয়ার্কি করছি না। সিরিয়াসলি বল।
– তা একটু বেশিই কিনতে হয়েছে। বুবুনের মাথায় খুব খুশকি হচ্ছে তো..
– দ্যাটস ইট ডিয়ার। দ্যাটস দ্য কজ..
– কী যে বলছিস, মাথামুণ্ডু কিচ্ছু বুঝলাম না।
– বুবুনের মাথায় যেগুলো হয়েছে ওগুলো টিউমার নয়, লিম্ফ নোড। লসিকা গ্রন্থি। ওই যে আগের ভদ্রমহিলার মেয়ের গলায় যেমন হয়েছে, বুবুনেরও তেমনি। শরীরে এরকম ৫০০-৬০০ মতো লিম্ফ নোড থাকে। মূলত গলা, বগল আর কুঁচকির কাছে। বিভিন্ন কারণে লিম্ফ নোডগুলো ফুলে যায়।
– ও.. তাই নাকি? কিন্তু তার সাথে শ্যাম্পুর কী সম্পর্ক?
– সম্পর্ক হ্যাজ ডিয়ার। সম্পর্ক হ্যাজ। বুবুনের মাথায় খুশকির মতো চামড়ার ইনফেকশন হয়েছে। চামড়ার ইনফেকশন থেকে মাথার পেছনের লিম্ফ নোডগুলো ফুলেছে। বারবার শ্যাম্পু করানোর ফলে চামড়ার ইনফেকশন একটু কমে যেতে লিম্ফ নোডগুলোও ছোট হয়ে গেছিল।
– ও। তাই নাকি? তাহলে হোমিওপ্যাথিতে কোনও কাজ হয়নি বলছিস? আসল জিনিস শ্যাম্পুটাই?
ডা. ঘোষ উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে মুচকি হাসলেন।
– তা বলে তুই যেভাবে বলিস হোমিওপ্যাথি ওরকম নয়। অনেকেরই কাজ হয়।
– বুবুনের ক্ষেত্রে তোর ভুল না ধরিয়ে দিলে তুইও তাই ভাবতিস। শোন, বিজ্ঞানে প্রমাণটাই বড় কথা। প্রমাণ ছাড়া..
– আজ বাদ কাল প্রমাণ হয়ে যায় যদি.. তখন তুই কী বলবি?
– মেনে নেবো। বিজ্ঞান তো কোনোকিছু অন্ধভাবে গ্রহণ না করতেই শেখায়। তবে তার আগে তো প্রমাণটা দরকার.. নইলে, আমি যদি বলি পাথর ধারণও অপ্রমাণিত বিজ্ঞান? আজ প্রমাণ হয়নি, কাল হয়ে যাবে?
– তুই কিন্তু এবার এঁড়ে তর্ক করছিস.. কোথায় পাথর আর কোথায়..
– আচ্ছা। তোকে উদাহরণটা সহজ করে দিই। ধর, করোনার ভ্যাক্সিন। সারা বিশ্বে বিভিন্নরকম ট্রায়াল চলছে। তাই তো?
– হ্যাঁ, সে তো বটেই..
– এবার ধর সম্পূর্ণ প্রমাণ না আসার আগেই যদি আমি সাধারণ জনগণকে ওই ভ্যাক্সিন দিতে শুরু করে দিই, তুই রাজি হবি?
– না। অবভিয়াসলি না। সে প্রশ্ন আসছে কেন?
– এবার তুই তোর নিজের প্রশ্নে ফিরে যা। প্রমাণ পাওয়া যায়নি এমন জিনিস বুবুনকে খাওয়াচ্ছিস কেন? যেখানে পৃথিবীর বহু উন্নত দেশে প্রমাণের অভাবে একে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছে?
– তোর সাথে কথায়..
– শোন, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে একটি রাসায়নিককে ‘ওষুধ’ হতে গেলে তার সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত ফার্মাকোলজি, কার্যপদ্ধতি, নিষ্ক্রমণ, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি জানতেই হবে। সে এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এর মধ্যে কোথাও সামান্যতম সন্দেহ এলে ওষুধ ‘বাতিল’ বলে গণ্য করা হয়। এমনকি বাজারজাত হওয়ার পরেও। কারণ, সব দীর্ঘকালীন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া প্রথমেই বোঝা যায় না। বুঝলি?
– হুঁ.. বুঝলাম।
– না। আসল কথাটা এখনও বলা হয়নি.. আমাদের চোখের দেখাই শেষ কথা নয়। কাক এলো আর বেল পড়লো- তার মানে এই নয় কাকটাই বেল পড়ার কারণ। এই কার্যকারণ প্রমাণের নির্দিষ্ট মাপকাঠি আছে। যে কোনও রাসায়নিককে ‘ওষুধ’ বলতে গেলে ওই মাপকাঠি দ্বারা প্রমাণ করতে হয়। ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি অনেক সময়েই আমাদের ভুল বোঝায়। সেই ভুল বোঝানোকে সম্বল করেই ‘ম্যাজিক’ দেখানো হয়। যা আপাতদৃষ্টিতে দেখলে সত্যি মনে হয় কিন্তু বিষয়ের গভীরে ঢুকলে দেখা যায় ব্যাপারটা অন্যরকম। তাই ‘আমি দেখেছি আমার উমুক রোগ উলুখাগড়া খেয়ে সেরে গেছিল’ বলে উলুখাগড়া ‘ওষুধ’ হয়ে যায় না। বিজ্ঞানের চোখে কারো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কোনও দাম নেই। সত্য সন্ধানের পথটা বরাবরই কঠোর।
– আচ্ছা ধর, কোনোদিন দেখা গেল আমাদের এসব বিজ্ঞান-টিজ্ঞান সব ভুল। হোমিওপ্যাথিই ঠিক। তখন?
– সেদিন আমিও হোমিওপ্যাথি পড়ে ওসব ওষুধই লিখবো। পরিবর্তনশীলতাই বিজ্ঞান। তবে তার আগে একটু অভিঘাতটা ভেবে নে.. অ্যাভোগাড্রো ভুল, অণুবিদ্যা ভুল, কম্পিউটার ভুল, স্যাটেলাইট ভুল, অ্যাটম বোম্ব ভুল, হিরোশিমা-নাগাসাকি ভুল, ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ..
– ওরে ভাই.. তুই একটু থাম রে বাবা। চ, চ ওঠ.. বুবুনের ওষুধ লিখে দে। দু’টো বাজে। স্নান করে মাথাটা ঠান্ডা কর..
দুজনে আবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন।
ডাক্তারবাবু, আপনার অনেক লেখা পড়েছি। এ লেখাটাও বেশ ভালো। হোমিওপ্যাথি নিয়ে ধারাবাহিক লেখা প্রয়োজন। ভারতের মতো পিছিয়ে পড়া দেশে হোমিওপ্যাথির জন্য বিশাল সংখ্যক মানুষ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সুফল পায়না। যদিও তার আসল কারণ এদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা। ভালো থাকবেন। শ্রদ্ধা জানিয়ে- জয়ন্ত নাথ নস্কর।