নয়ডা-র ‘টুইন টাওয়ার’ ভেঙে দেওয়া হলো। শীর্ষ আদালতের নির্দেশে। অনেকেই দেখলেন নিশ্চিত।
মস্ত বিল্ডিং এমন করে ভেঙে ফেলা, অনেকের অনেক পরিশ্রমে গড়ে তোলা অট্টালিকা ভেঙে ফেলা – অপচয় – দেখে হয়ত খারাপ লেগেছে অনেকের। নির্মাতার ক্ষতির পরিমাণ আন্দাজ করেও কেউ কেউ হয়তো বিষণ্ণ।
কিন্তু নিয়ম-কানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ‘যোগাযোগ’ রেখে, তৈরি হয়েছিল এই ‘অবৈধ নির্মাণ’। ভেঙে দেওয়াই উচিত, অন্তত দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ হিসেবে।
অবশ্য এদেশে এমন সুউচ্চ বিল্ডিং ভেঙে ফেলাটা ব্যতিক্রমী ঘটনা হলেও প্রশাসনের ‘সহযোগিতা’-য় এমন নির্মাণ কোনও ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়।
ধরুন, খাস কলকাতারই একটি প্রজেক্ট। কাগজের পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন মাঝেমধ্যেই দেখে থাকবেন হয়ত। এখনও। অভিদীপ্তা। বাইপাস মুকুন্দপুর মোড়ে।
একসময় অভিদীপ্তা নামে একটি হাউজিং তৈরির বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। ২০১৩-২০১৪ সাল নাগাদ। গোটাদশেক টাওয়ার। ষোল কি সতের তলা। বিভিন্ন মাপের ফ্ল্যাট থাকবে তাতে। পিয়ারলেস ও রাজ্য সরকারের যৌথ উদ্যোগ। ফ্ল্যাট তো থাকবেই, সঙ্গে থাকবে শপিং মল ইত্যাদি প্রভৃতি। হাউজিং-এর জন্য নির্দিষ্ট জমির লাগোয়া আরেকখানা জমি দেখানো রয়েছে – ভবিষ্যত উন্নয়নের জন্য রক্ষিত। অনুমান করা যায়, লাগোয়া জমিটিতেই গড়ে উঠবে সেই শপিং মল। পাশে খানিকটা জলা জমি।
ফ্ল্যাট হাতে পাওয়ার কিছু আগেই আবিষ্কৃত হয়, হাউজিং-এর নাম বদলে অভিদীপ্তা-১ হয়ে গিয়েছে। লাগোয়া জমিটির সংলগ্ন জলা জমি ততদিনে স্মৃতি। শোনা গেল, সেখানে গড়ে উঠবে মস্ত ইমারত, অভিদীপ্তা-২ – যার বিজ্ঞাপন আপনারা হয়ত কাগজে দেখে থাকবেন। তাহলে শপিং মল ইত্যাদি? নাহ্, নির্মাতা নিরুত্তর। এমনকি রাজ্য সরকারি হাউজিং বোর্ডও স্পষ্ট উত্তর দেন না।
কিছু ফ্ল্যাট-মালিক আদালতে যান। সুরাহা অবশ্য মেলে না। নির্মাতার পক্ষে হাজির হন কলকাতা হাইকোর্টের সবচাইতে খ্যাতিমান কয়েকজন আইনজীবী, সবচাইতে মহার্ঘ্যও বটেন। আদালত পাঠায় পুরসভায়। পুরসভায়ও সুরাহার সম্ভাবনা নেই। কেননা, পুরসভার মেয়র, রাজ্যের আবাসন মন্ত্রী, হাউজিং বোর্ডের চেয়ারম্যান, রাজ্যের পরিবেশ মন্ত্রী (যাঁর কিনা জলা-বোজানোর অভিযোগটি খতিয়ে দেখার কথা) – সবই সেই মুহূর্তে একজন – শোভন চট্টোপাধ্যায়। হ্যাঁ, বৈশাখী-খ্যাত শোভনই। তারপরও কিছুদিন মামলা এগোয়। আইন, সাধারণত, আইনের পথেই চলে – কিন্তু অভিযোগকারীর যোগাযোগ বা অর্থবল না থাকলে, সে পথ মূলত গরুর গাড়ির। অতএব, আস্তে আস্তে টাকায় টান পড়ে, হাল ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতাও মাথা চাড়া দেয়।
তীরবেগে মাথা তুলতে থাকে অভিদীপ্তা-২ – রীতিমতো দলিল-দস্তাবেজ করে হ্যান্ড-ওভার করে দেওয়া অভিদীপ্তা-১-এর জমিটিকেই দ্বিতীয়বার ফাঁকা জমি হিসেবে দেখিয়ে প্রাপ্ত অনুমতির ভিত্তিতে। তা হোক, বড় বড় কাজের ক্ষেত্রে এসব ছোটখাটো ভুল, আমাদের রাজ্যে, আদালতও দেখেন না। তদুপরি প্রজেক্টের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর স্বয়ং সৌরভ গাঙ্গুলি!! এরই মধ্যে নির্মাতার তরফে নিত্যনতুন উদ্যোগ জারি থাকে। ফ্ল্যাট-মালিকদের মধ্যে বিভাজনের রাজনীতি, কিছু বাসিন্দার নামে ফৌজদারি মামলা করে ভয় দেখানো ইত্যাদি প্রভৃতি। সেসবে অল্পবিস্তর সাফল্যও মেলে।
সব ভয়ভীতি-হতাশা-বিরক্তি-ক্লান্তি অগ্রাহ্য করে নাছোড় কিছু ফ্ল্যাট-মালিক শেষমেশ কেন্দ্রীয় ক্রেতা-আদালতেও যান। শোনা যায়, সেখানে নাকি মামলার তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি করার নিয়ম। কিন্তু, ওই, অর্থবল। বিপরীতে যখন কপিল সিব্বলের পুত্র, তখন এদিকে আনকোড়া উকিল, যে কিনা উল্টোদিকের আইনজীবীকে দেখে মন্ত্রমুগ্ধ প্রায়। তবু মামলা এগোয়। ফ্ল্যাট-মালিকদের মনে আশা জাগে। আর তখনই নির্মাতা মোক্ষম খেলা খেলতে থাকে। পাঁচ-ছয়মাস পরে পাওয়া তারিখে হাজির হয়ে কখনও আইনজীবী আগের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য পরে তারিখ চান, কখনও বা অসুস্থতার যুক্তিতে গরহাজির থাকেন।
এদিকে, এমনকি গভীর রাত্তিরেও সশব্দ কাজ চালু রেখে, অত্যন্ত দ্রুত গড়ে উঠতে থাকে বিয়াল্লিশ তলা ফ্ল্যাটবাড়ি।
তো এরকমই হয়। আইন আইনের পথেই চলে।
ও হ্যাঁ, কিছু ফ্ল্যাট-মালিক গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের দ্বারস্থও হয়েছিলেন বইকি। কেউই গুরুত্ব দেননি, কিন্তু অন্তত একটি সংবাদপত্র ছিল সৎ। সাংবাদিক স্পষ্ট বলেছিলেন, দেখুন, ফ্ল্যাটের সংখ্যা সাড়ে পাঁচশ, ক্ষুব্ধের সংখ্যা ম্যাক্সিমাম দুশো-আড়াইশো। মূলত উচ্চ-মধ্যবিত্ত। প্রোমোটর পয়সা নিয়ে ফ্ল্যাট দেয়নি, এমনও নয়। ইস্যুটা জটিল। ক’জন এটা পড়তে আগ্রহী হবে! উল্টোদিকে, বেঙ্গল পিয়ারলেস আমাদের বড় বিজ্ঞাপনদাতাদের অন্যতম। এই খবর করলে সেটা পাকাপাকি বন্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং, ট্রেড-অফ হিসেবে করলে….
সুতরাং…
যে কথা বলছিলাম, আইন আইনের পথে চলে। চলতে থাকে। পথের দুপাশে কান পাতলে বিচারকরা অনেক দীর্ঘশ্বাস – এমন অনেক অবৈধ নির্মাণের কাহিনি – শুনতে পেতে পারতেন। কিন্তু তাঁদের চলাফেরা হুটার-লাগানো এসি গাড়িতে। অতএব, বুক চাপড়ে উচ্চৈস্বরে রোদন কানে পৌঁছানোর সম্ভাবনা থাকলেও সম্মিলিত দীর্ঘশ্বাস গাড়ির কাচ পার হতে পারে না।
আর এ রাজ্যে তো…
অতএব, এক-দুখানা ‘টুইন টাওয়ার’ ভাঙার দৃশ্য দেখার পেছনে লুকিয়ে থাকে এমন আরও কয়েকশো কাহিনি – যা কেউ দেখে না, দেখতে চায় না – এমনকি চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেও কেউ দেখতে পায় না।