জবর দখল ভাবতে গেলেই জবর কথাটার মানে কী, এই প্রশ্নটা মাথার মধ্যে ঝিলিক মারে।
‘মা তোমার বুদ্ধি তো জবর’–মনীশ ঘটকের কুড়ানি কবিতাটার এই লাইন সকাল থেকে মাথায় ঘুরছে।
কেন? খুলে বলি। টিভিতে দেখলাম কারা যেন জবরদস্ত টক্কর দিয়েছে অন্য কাদের। আর তারপরই অন্য মাধ্যমে ব্যক্তিগত নির্দেশ এল, – জবরদস্তির পলিটিক্স নিয়ে একটা কথাও যেন না শুনি।
আচ্ছা, এই নির্দেশের জবরদস্তির মধ্যেও মাখানো আছে যে দুরন্ত ভালোবাসা, সেটা বুঝব না? আমি কি তত নির্বোধ এক অমানুষ? আমাকে কী ভাবেন আপনারা? এই সব নানান ভাবনার মধ্যে জবর কথাটা মাথায় ঢুকে পড়ল। আদতে বিদেশি এই শব্দটার মধ্যে কত যে শেড লুকিয়ে আছে।
একটু অন্য কথা বলে নিই আগে। নতুন ইহুদিদের কথা।
অতীতে বহুবার দুঃখ আর গর্বের সঙ্গে বলেছি আমি বাঙাল। না, আমার মা ও ওদেশ দেখেননি। তবু পাঠক বাবু-বিবিদের জানাই বহিরাগত এই আমরা, ‘পূর্ব’ লাঞ্ছনার ইতিহাস সমেত এই ‘পশ্চিম’বঙ্গের ভার বাড়িয়েছি। মজার কথা, আজ যে বা যাঁরাই বহিরাগতদের নিয়ে আপত্তি জানাচ্ছেন, তাঁরাও বহুলাংশে আমার মত, কী বলে ওই বহিরাগতই।
কচুরিপানার সঙ্গে অন্য বৃক্ষ-গুল্মের তফাত কী বলুন তো? বহু তফাতের মধ্যে সব চেয়ে বড় তফাতখানি হল, কচুরিপানার শেকড় আছে কিন্তু মাটি নেই। তাই সে সারাজীবন ভাসমান। আমাদের পরিবারেরও ইতিহাস তাইই।
কিন্তু বাঙালদের এক বড় অংশ, তার মধ্যে আমার নিকটাত্মীয়রাও আছে, যারা প্রাণভয়ে কিম্বা আক্ষরিক অর্থে বিতাড়িত হয়ে পালিয়ে এসেও কচুরিপানা হয়ে থাকতে চায়নি। তারা উৎপাটিত শেকড়ের জন্য মাটি খুঁজেছে।
অবধারিত ভাবে মরে যাওয়াই যে বহিরাগতদের উচিত ছিল অথবা বলা চলে ভবিতব্য ছিল, তারা জবরদস্ত এক বাঁচার প্রতিবর্তী ক্রিয়ায় জবরদস্তি করেছে। তাদের কুপার্স ক্যাম্পে, মানা ক্যাম্পে দণ্ডকারণ্যে, আন্দামানে আরও কোথায় কোথায় না পাঠানো হয়েছে। মেয়েরা আব্রু খুইয়েছে। ছেলেরা অসামাজিক কাজে জড়িয়েছে। তবু জবর খবর হল তারা পায়ের নীচে মাটি খুঁজেছে। আমার সেই বহিরাগত পূর্বপুরুষদের সাহসী একাংশ শান্তিময় এই বাংলার বহু আনাচে কানাচে তৈরি করেছে জবরদখল কলোনি।
আজ্ঞে হ্যাঁ, তথাকথিত বেআইনি জবরদখল। জমিদারের জমি, সরকারের খাস জমি। সবাই সাহসী ছিল না। সেই ভীতুরা পারেনি। যেমন আমাদের পরিবার। কিন্তু হাড়-হাতিয়ার কিছু মানুষ পেরেছিল। আজকের বাঘা যতীন, নেতাজিনগর, বেলঘরিয়া, বারাসত আরও কত জায়গায় রয়েছে সেই সব জেদ করে গায়ের জোরে দখল করা কলোনিগুলো। এদের কতকগুলি আভিজাত্য অর্জন করেছে ভৌগোলিক কারণে। নেতাজিনগর, বিজয়গড়, যাদবপুর, দমদম এমনকি বেলঘরিয়া খড়দার কিছু কলোনি বহুতলগ্রাসে, সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পে বাজার-হাট-মলে আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। পাল্লা দিচ্ছে সম্পত্তি এক্সচেঞ্জ করে এদেশে আসা বালিগঞ্জ, এলগিন রোড, আলিপুরের সম্পন্ন বাঙালদের সাথে।
এই দ্বিতীয়োক্ত সম্পন্ন বাঙালেরা স্পষ্টতই ‘বহিরাগত’ নন। তাঁরা আইনি অভিবাসী। তাঁদের রাত জেগে, কাদাতে পা গেঁথে জমিদারের লেঠেল আর রাষ্ট্রীয় ঠ্যাঙারেদের ঠেকাতে হয়নি। তাঁদের ছেলে মেয়েরা প্রথম থেকেই কনভেন্টে পড়েছে। সংস্কৃতির আলো ছিল তাঁদের চত্বরে। হাতে ছিল বিলেত যাবার টিকিটও।
আমি বলছিলাম জবরদখল কলোনি তৈরি করা বাঙালদের কথা। তাদের প্রথম প্রজন্ম জেদের বশে গোঁয়ার্তুমি করে দখল করা জমি পাহারা দিয়েছে, প্রাইমারি স্কুল বানিয়েছে, মদ চোলাই করেছে, বেশ্যা হয়েছে, ওয়াগনব্রেকার হয়ে গুলি খেয়েছে, স্কুলে কলেজে ভালো রেজাল্ট করে গেছে অফিস কাছারিতে ইস্কুলে কলেজে হাসপাতালে। কেউ তারা বিলেত আমেরিকাও গেছে। এখন তাদের চতুর্থ প্রজন্ম মিশে গেছে এই দেশের ইতিহাসে। তারা আর জবরদখলকারী নয়। ছড়িয়ে থাকা লেনিননগর, সুকান্ত কলোনি, আরও কত নামের মধ্যে লুকিয়ে আছে সেই জবরদখলের ঘাম রক্ত আর চোখের জলের ইতিহাস।
আমার পরিবার ওদেশ থেকে আসার পর মাটি খোঁজার এই জবরদখল অভিযানে সামিল হতে পারেনি সাহসের আর সুযোগের অভাবে।, বাবু-বিবিদের জানাই, অন্যতর জবরদখলও তো হয়। হয় না? সম্পর্কে, ভালোবাসায়, আর যাপনে।
সেই রকম জবরদখলে জড়িয়েছে এক বাঙাল। সে আপনারা আমাকে বাঙাল এমনকি বহিরাগত বলেও যত ঠাট্টা গালমন্দ করুন না কেন। আমার আত্মীয় সেই নির্লজ্জ বেআইনি জবরদখল কলোনি বানানো লোকগুলোর মত রাত জেগে আমিও পাহারা দিই রোজ।
আমার ব্যক্তিগত জবরদখল কলোনিটুকুকে।