আজ বুকে ধূপের গন্ধ ভরে দিল এক মহাধনী ভিখারী মানুষ৷ আজ পনের বছর ধরে তাঁকে দেখি আমি৷ দুপা কাটা গেছে কোন জন্মে৷ একটি মানুষ টানা পাটাতনে বসে ভিক্ষে করে বেড়ান৷ ভিক্ষে করতে করতে আর আধভরা কৌটো মনের গ্লানি কিংবা খুশিতে বাজাতে বাজাতে যেন চক্ষের নিমেষে পার করে দিয়েছেন টাটকা যৌবনখানি৷ দারিদ্র দ্রুত মানুষের তাজা ভাব কেড়ে নেয় — এ ভেবেই নিয়ত তাঁকে দেখে মন প্রশমিত করেছি৷ কখনো দু দশ গুঁজে দিয়েছি তাঁর কৌটোয়৷ কোনো কিছু না ভেবেই যে কোনো একটা কিছু করে গেছি মানুষটার জন্য৷
মহামারী চলাকালীন তাঁর সঙ্গে আর দেখা হয়নি৷ দীর্ঘ দুবছর পর আজ বিকেলে দেখলাম –একই পাটাতনে বসে চলেছেন গড়গড়িয়ে৷ খুব বুড়ো হয়ে গেছেন৷ শির বের করা দুহাত দিয়ে কোলের উপর বড় দুটি ফ্লাস্ক বুকে আঁকড়ে বসে আছেন৷ গাড়িটা ঠেলছে একটা বাচ্চা ছেলে৷ তার একহাতে প্ল্যাকার্ড৷ তাতে লেখা –দুরকম চা খান৷ লাল ও দুধ চা৷ সুন্দর করে দুরকম চায়ের দামও লেখা রয়েছে৷
দাঁড়িয়েই আছি৷ রাস্তার দোকানীরা চা কিনছে৷ বিক্রির উত্তেজনায় থরথর করে হাত কাঁপছে তবু কারোর সাহায্য না নিয়েই কাটা পায়ে প্লাস্টিকের কাপ বসিয়ে চা ঢালছেন৷ মাঝে মাঝে গরম চা ফস্কে যাচ্ছে তাঁর পায়ে৷
আমার দিকে চোখ গেল৷ মিষ্টি হেসে কাছে ডেকে বললেন –দিদি চা খাবেন? কাপগুলো গুছিয়ে দিতে গেলাম৷ বললেন –আমি পারব দিদি৷ অভ্যেস হয়ে গেছে৷ আপনি দাঁড়িয়ে দেখুন –আমার কোনো ভুল হবে না -পরপর ঠিক সবাইকে দিয়ে যাব৷ কিছু টাকা দিতে গেলাম৷ বলা ভালো –অধুনা বঙ্গের দানের সংস্কৃতির বদচর্চা করতে গিয়েছিলাম আর কি৷ ভাবতে পারেন বুড়ো পা-কাটা সেই মানুষটি কী বললেন আমায়?
— দিদি –আপনারা যতদিন পেরেছেন আমায় ভিক্ষে দিয়েছেন৷ মনের আনন্দে দিয়েছেন৷ ভালোবেসে দিয়েছেন৷ আপনাদের দেয়া ভিক্ষেতেই তো বেঁচে আছি আমি৷ কিন্তু কত মানুষ কাজ হারিয়েছে৷ দোকানে বিক্রি নেই৷ এখন আপনাদের থেকে ভিক্ষে নিতে লজ্জা লাগে দিদি৷ তাই মনে করলাম – যাঁরা এতদিন আমায় খাদ্য জোগালেন আমি তাঁদের গরম চা দিয়ে সেবা করি৷ আমারও পয়সা আসে দুটো৷ এই কাজটা করতে আমার ভালো লাগে খুব৷ আর এই ছেলেটাকেও জুটিয়ে নিয়েছি৷ দুজনের এই চা বিক্রির পয়সায় কোনোদিন চলে৷ কোনোদিন চলে না৷ তবু মানুষের কাজ হারাবার দিনে ভিক্ষে করলে মানুষকে খুব হেনস্থা করা হবে৷ এতদিনের অন্নদাতাদের ওপর জুলুম চালালে কেমন অকৃতজ্ঞ লাগবে যে নিজেকে৷ তাই না দিদি?”
ইচ্ছে করেই চুপ থেকে তাঁকে নাগাড়ে বকবক করতে দিচ্ছিলাম –যাতে তাঁর হৃদয়খানি দেখতে মুহূর্তের ভুলটুকুও আমার না হয়৷ কোথাও যেন তাঁর আবেগ প্রতিহত হয়ে চলে না যায় – তাই নিজের উচ্ছ্বাস যে কত কষ্টে ঢাকা দিয়ে রেখেছিলাম৷ আমি যে তাঁর নতুন মনটার মহিমা দেখতে চাইছিলাম –একদম শেষ বিন্দু অব্দি৷
গোটা দেশ যেখানে ভিখারী তৈরির আখড়া হয়েছে সেখানে হাতে গরম নোটগুলো ফেরত দিলেন এক ভিখারী৷ মান্যবর –আমি আপনাদের মতো দরিদ্রের জন্য লিখব৷ সব হারিয়ে সম্ভ্রম বজায় রাখেন যাঁরা তাঁদের জন্য লিখব৷ লেখকের কাছ থেকে কৌশলে টাকা নেয়া ফাজিল প্রকাশকের জন্যও নয় – পারস্পরিক ভাবে পিঠচাপড়ানো বুদ্ধিজীবীদের জন্যও নয়৷
আপনি আমার পৃথিবীর এক সেরা বাসিন্দা৷ চাকাওয়ালা পাটাতনে বসে শিক্ষায় ও মনে আপনি আমাদের থেকে অনেকখানি ওপরে উঠে গেছেন৷ লিখে যদি সিঁড়ি একটা বানাতে পারি৷ কাজ শেষ করে আমায় আশীর্বাদ দিয়ে কুটিরে ফিরবেন৷
ছবি : চন্দ্রা চ্যাটার্জি
এই দেখা এবং দেখানোগুলোই তো সেই সিঁড়ি।
আমারও শ্রদ্ধা রইল সেই দরদী ও আত্মসম্মানবোধের অধিকারী মানুষটির প্রতি।
অসাধারণ একটি চিত্রকল্প লেখা হলো। অসাধারন মানুষের অসাধারণ ছবি।
খুব সুন্দর
প্রণাম এমন দেবীকে, যাঁর কাজ সকলের বেঁচে থাকার প্রেরণা। এমন লেখা পড়লে মনে হয় মনুষ্যত্ব আজও আছে। শেষ লাইন টা বড়ো মন ছোঁয়া… “লিখে যদি সিঁড়ি একটা বানাতে পারি”…এমন কলম চলতেই থাকুক..
অসম্ভব সুন্দর একটি লেখা! মন ছোঁয়া, মন ভরানো! আর শিক্ষনীয় তো বটেই! ড: ময়ূরী মিত্রকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই। তিনি তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে যা দেখেন – সামান্যের মধ্যে অসামান্য – তা তাঁর শক্তিশালী কলমের মাধ্যমে আমাদের কাছে উপস্থাপনা করেন। তাতে যদি এই ক্ষয়িষ্ণু সমাজ একটুও জেগে ওঠে আর তাঁর বানানো সিঁড়ি দিয়ে এক ধাপও ওপরে ওঠে, সেই আশায় বুক বাঁধি!