কথাটা হলো, আমরা সংখ্যার প্রতি আবেগহীন ও নির্লিপ্ত থাকি, কিন্তু রক্তমাংসের মানুষের গল্প আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে।
অথচ, চাকরি না পেয়ে রোদে-বৃষ্টিতে বসে থাকতে থাকতে যে সন্তানসম্ভবার গর্ভপাত হয়ে গেল, তার গল্প আমাদের কেউ বলে না।
যে ছেলেটি অপেক্ষা করতে করতে চাকরির বয়স পার হয়ে যাবার হতাশায় গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ল, তার বাবা-মায়ের শূন্যতার গল্প কেউই শোনালো না।
দিনের পর দিন ধর্ণা আর অনশন করতে করতে যারা দেখল উৎসব-মেলা-পুরস্কারে ভরে আছে বঙ্গদেশ – এবং সেই হইহই আয়োজন-আপ্যায়নের ফাঁকে ফুরসত পেলে পুলিশ তাদের টেনেহিঁচড়ে চ্যাংদোলা করে তুলে দেবার বেশি করণীয় কিছু পেলো না – নেতা কথা বলতে ডাকলে আশায় আশায় আপিসের বাইরে হাজির হলে উদ্যোগী পুলিশ যাদের ‘পরে লাঠি চালিয়ে দিল – বাড়ি ফেরার পর সেই ক্লান্ত মুখগুলো ঠিক কী কথা বলে, কী খাবার খায়, সেসব কিছুই আমরা জানি না।
জানি না, কেননা গল্পগুলো কেউ বলে না।
এসব গল্প ছাপা হয় না বলেই বলে না, নাকি আদৌ কেউ লেখে না বলেই গল্পগুলো ছাপা হয় না – সে উত্তর আমার জানা নেই।
অতএব, বর্ষার সন্ধেয় জেলখানায় বসে যখন তেলেভাজার সুবাস ভেসে আসে, আকুল নেতা যখন তেলেভাজার জন্য আকুলিবিকুলি করেন – প্রাথমিক নিষেধ ক্ষণিকের জন্য শিকেয় তুলে রেখে যখন তাঁর সামনে এসে পড়ে আলুর চপ আর বেগুনি – আমরা যখন জানতে পারি, তিনি দুখানা আলুর চপ দুখানা বেগুনি খেয়েছেন, গতকাল সন্ধেতেই – অজ্ঞাতসারেই মন নরম হয়ে যায়। অজান্তে মুখে চলে আসে, আহা রে!!
মনে হয়, কেননা আমরা মানুষ।
মনে হয়, কেননা সহানুভূতি আর সহমর্মিতা আমাদের সহজাত।
যে সহমর্মিতা অনায়াসে পৌঁছাতে পারত সেই সব অশ্রু ঘাম আর রক্তের অধিকারী মানুষগুলোর প্রতিও, যাঁদের স্বেদবিন্দু রক্তবিন্দু তিলে তিলে মিশে তৈরি হয়েছে কোটি কোটি টাকা, স্বর্ণালঙ্কারের পাহাড় – যাঁদের অশ্রুর বিনিময়ে নেতামহোদয় অর্জন করেছিলেন তাঁর আশ্চর্য ঔদ্ধত্য।
পৌঁছাতে পারত।
আর তাহলেই আলুর চপ আর বেগুনির গল্প শুনে কোনও মায়া বা মমতা নয়, ঝরে পড়তে পারত ঘৃণা – আর বিবমিষা।
হলো না।
কেননা, আমরা ওপারের গল্পগুলো জানি না।
কেউ জানায় না।
আমরা শুধু দেখি টাকার পাহাড়। দেখি তাল তাল সোনা। তাল তাল নারীমাংস। নারীমাংসলোভী নেতা। হরিণীর নিজ মাংসকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে ছলচাতুরীর খেলা। দেখি, আর আমোদ পাই।
একসময়, সহানুভূতি আর সহমর্মিতা যদি নাও বা জাগে, অন্তত মেনে নেওয়া জেগে ওঠে।
আমরা তো অন্যদিকের গল্পগুলো শুনি না। শুনতে পাই না। কেউই শোনায় না।