তখন বোধহয় ক্লাস সেভেন বা এইট। একেবারে প্রাইমারি স্কুলেরও আগে থেকে আমার বন্ধু, শমী, তাদের বাড়ি গেছি। তার বাবা, মণিজ্যেঠু, একখানা ক্যাসেট হাতে ধরিয়ে বললেন – যা, বাড়ি গিয়ে শোন। ভালো ভালো গান শোনার অভ্যেস কর।
তার আগে অবধি আমি ক্লাসিকাল ভোকাল শুনেছি, ক্যাসেটে, মাত্র দুজনের। উস্তাদ আমীর খাঁ আর পণ্ডিত যশরাজ। মানে, আলাদা করে তাঁদেরই মনে ধরেছে, এমন নয় – ঘটনাচক্রে শুধু ওই দুজনের ক্যাসেটই শুধু হাতে এসেছে। বিষ্ণুপুরে রাগসঙ্গীতের গভীর চর্চা থাকলেও ক্যাসেট খুব বেশি মিলত না (তাছাড়া কোনও এক দুর্বোধ্য কারণে এইচএমভি বেছে বেছে রাগসঙ্গীতের ক্যাসেটের দাম রাখত দ্বিগুণ কি তিনগুণ)। এমনকি বড়ে গুলামের নাম শুনলেও হাতে ক্যাসেট পাইনি। বান্টিদার কাছে রেকর্ড শুনেছিলাম বোধহয়।
আমার ক্লাসিকাল গান শোনার সঙ্গী ছিল আমার মা। বাবা ক্লাসিকাল ভোকাল পছন্দ করত না। বাবা যদি কখনও ক্লাসিকাল শুনত, সে বড়জোর ইনস্ট্রুমেন্টাল। মূলত পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা। বা মাঝেমধ্যে উস্তাদ আমজাদ আলি। তার বেশি নয়। আমি আর মা-ই ক্লাসিকাল ভোকালের ভক্ত।
তো সেদিন দুপুরে – বিষ্ণুপুরের গরমের দুপুরে – স্কুলে গরমের ছুটি চলছিল নিশ্চিত, নাকি দিনটা ছিল রবিবার – মোটকথা, মায়ের কলেজ এবং আমার স্কুল, দুইই ছুটি ছিল – আমি আর মা, দুপুরবেলা খেয়ে উঠে ক্যাসেটপ্লেয়ার চালিয়ে একটি বিশেষ কণ্ঠের প্রেমে পড়ে গেলাম।
ভেনাস রেকর্ডস-এর সেই ক্যাসেটের একদিকে ছিল রাগ যোগ। আরেকদিকে রাগ সোহিনী। পরে ক্যাসেটটা খারাপ হয়ে গেছিল বলে আমি আবার খুঁজে খুঁজে সেই ক্যাসেট কিনেছিলাম। আরও পরে সেই রেকর্ডিং-এরই সিডি। (অবাক হয়ে দেখলাম, উইকিপিডিয়ার তালিকায় এই সিডি/ক্যাসেটের উল্লেখ নেই।)
উস্তাদ রশিদ খান। যখনকার কথা বলছি, তখন কতটুকুই বা বয়স তাঁর! কভারে একটি রোগাপাতলা শ্যামবর্ণ যুবকের মুখ। খুবই আন-ইম্প্রেসিভ। কিন্তু গলা!! গলা তো তখনও এত ভরাট দানাদার হয়নি, তবে কন্ঠস্বরের অদ্ভুত যে টান শ্রোতাদের আবিষ্ট করে রাখে – রেখে চলেছে তদবধি – যা একান্তই রশিদী ম্যাজিক – তা তখনই তাঁর করায়ত্ত।
তার পর যখন যেখানে তাঁর যা যা ক্যাসেট/সিডি পেয়েছি, কিনেছি। এককথায় যাকে ফ্যান বলা যায়, আমি তা-ই হয়ে উঠেছি। সামনাসামনি অনুষ্ঠান শুনতে যাওয়া খুব বেশি হয়ে ওঠেনি। মাত্র বারচারেক কি পাঁচেক।
আস্তে আস্তে, গান শোনার কান একটু পরিণত হওয়ার পর মুগ্ধতা অটুট থাকলেও, ফ্যান-সুলভ মুগ্ধতায় খানিক ভাটা পড়েছিল। মনে হতো, ১৯৯০-২০০০ যাঁরা রশিদ খান শুনেছেন, অর্থাৎ যখন তিনি মাত্র পঁচিশ-তিরিশ – তাঁরা হয়ত মানবেন, রশিদ ছিলেন এককথায় প্রডিজি, কিন্তু যে উচ্চতায় তাঁর উত্তরণ প্রত্যাশিত ছিল, ততখানি বিকশিত তিনি হতে পারেননি।
তবু, রশিদ আমার প্রায় নিত্যসঙ্গী ছিলেন। বুঁদ করে রাখতে পারেন, সবকিছুর মধ্যে অন্যমনস্ক করে দিতে পারেন। অলৌকিককে লোকায়তে বাঁধতে পারেন, হেলায়।
এখনও আমার মনে হয়, যিনি কখনোই রাগসঙ্গীত শোনেননি, তাঁকে রাগসঙ্গীতে আকর্ষিত করার জন্য – ক্লাসিকাল ভোকাল শোনার ব্যাপারে ইন্ট্রোডিউস করার পক্ষে – সেরা চয়েস উস্তাদ রশিদ খান-ই। তাঁর গান, তাঁর গলা শুনে নিস্পৃহ থাকা খুব মুশকিল।
তারপরও… রাগসঙ্গীত এমনই ব্যাপার, যা শিল্পীর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অন্য মাত্রা পায়। বাড়তি অনুভব এসে গানকে আরও স্তিতধী ও গভীর করে তোলে। ফৈয়াজ খাঁ-র শেষবয়সের টুকরো রেকর্ডিং শুনতে বসে মনে হয়, আচ্ছা, ভরা যৌবনের গলায় এঁকে শোনাটা কেমন অভিজ্ঞতা ছিল? আবার পালুসকার শুনতে বসে আক্ষেপ হয়, ইশশ, অন্তত পঞ্চাশ অবধি যদি থাকতেন! মল্লিকার্জুনের ওই আত্মমগ্ন সুর অল্পবয়সে ততখানি মানাত কি? ফর্মের শীর্ষে থেকে আচমকা গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা না গেলে পরের দশ বছর আর কোন শিখর ছুঁতেন আমীর খাঁ?
উস্তাদ রশিদ খান, যৌবনের আলোকদ্যুতিতে যতখানি চোখ ধাঁধিয়ে দিতে পেরেছিলেন, পরের বছরগুলোতে তাঁর উত্তরণ – তাঁর সূচনার তুলনায় – নিষ্প্রভ। কিন্তু তিনি তো ছিলেন অবিসংবাদিত জিনিয়াস। কোভিডের ঠিক আগেই, আইটিসি-এসআরএ-র বার্ষিক অনুষ্ঠানেও দেখেছি, কত অনায়াসে তিনি শ্রোতাদের হাতের তালুর মধ্যে নিয়ে আসতে পারেন। কী অলৌকিক তাঁর ওই কণ্ঠস্বরের মহিমা!! ষাটের কোঠায় পৌঁছে তিনি হয়ত আবার পারতেন রাগসঙ্গীতের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করতে।
কী হতে পারত, তিনি কী করতে পারতেন – এই সবই আজ থেকে অলস আলোচনার বিষয় হয়ে গেল।
হয়ত এমন হওয়াটাই ঠিক। আটপৌরে পরিণতি উস্তাদ রশিদ খান-কে মানাত না। আমাদের কাছে সেরা সময়ের রশিদ-ই রয়ে গেলেন। তরুণ। চিরতরুণ। উদীয়মান। চির-উদীয়মান। চির-উদীয়মান বলেই যাঁর উত্তরণের সীমা-পরিসীমা নেই।