১ জানুয়ারি, ২০২১, মানিকন্ট্রোল পত্রিকার একটি “সুসংবাদ” – “Drugmakers to hike prices for 2021 as pandemic, political pressure put revenues at risk”। অর্থ হল অতিমারির ফলে বিশ্ব যখন অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত তখনও মুনাফার কোন হেরফের নেই। সুবিখ্যাত গার্ডিয়ান সংবাদপত্রের সংবাদ হল (১৯ ডিসেম্বর, ২০২০) “Ten billionaires reap $400bn boost to wealth during pandemic” – অতিমারিকালে ১০ জন লক্ষকোটিপতি ৪০০ লক্ষ কোটি টাকা লাভ করেছে।
অতিমারি সৃষ্টিকারী যে ভাইরাসটিকে নিয়ে আমরা কথা বলছি সে ভাইরাস বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের চেনা ধ্রুপদি ডোজ-রেসপন্স সম্পর্ক (অর্থাৎ, যত কম ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করবে তত কম উপসর্গ দেখা দেবে – এই নিয়ম) মেনে চলেনা। স্বাভাবিক কথাবার্তা বলা প্রতি ১ মিনিটে ৩০০০ ১-মাইক্রন সাইজের ভাইরাস পার্টিকল বাতাসে ছড়িয়ে দিতে পারে। ফলে অতিমারি কালে এবং, খুব সম্ভবত, আগামীদিনেও আমাদের সুরক্ষার জন্য নাক-মুখ ঢাকা মাস্ক ব্যবহার করা সম্ভবত জীবনের অঙ্গ হতে যাচ্ছে, যার আদুরে নাম “নিউ নর্ম্যাল”। ফলে ভাইরাস এবং সামাজিক জীবন এক নতুন ঢং-এ জুড়ে গেল, যা এর আগে কখনো ঘটেনি। অর্থনীতিতেও এরকম সুদূরপ্রসারী প্রভাব অতীতে কখনো দেখা যায়নি। ভারতের জিডিপি প্রথম ত্রৈমাসিকে প্রায় ২৪% সংকুচিত হয়েছে। আবার এই ভাইরাস-জনিত কারণে দীর্ঘস্থায়ী লকডাউনের মতো ঘটনার মাঝে চুপিসারে, কার্যত সংসদের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে পাস কাটিয়ে নতুন কৃষি বিল, ২০২০ এবং সমধর্মী একগুচ্ছ আইন ভারত রাষ্ট্র পাস করিয়ে নিতে পারছে।
এসবকিছুর সম্মিলিত যোগফলে এ ভাইরাসকে শুধু বায়োলজির চোখ দিয়ে প্রাণী-অপ্রাণীর মাঝে অবস্থান করা একটি কণা হিসেবে দেখা যাবেনা। এর অভিঘাত বহুদূর বিস্তৃত। এমনকি এ ভাইরাসের ভ্যাক্সিনের প্রাথমিক প্রয়োগের সাথে সাথে ঊনবিংশ শতাব্দীর মতো একবিংশ শতাব্দীর অ্যান্টি-ভ্যাক্সিনেশন আন্দোলনও শুরু হয়েছে আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোর বহু অংশে। এ ঘটনা কি একধরনের জাতীয়তাবাদের প্রকাশ? উত্তর জানা নেই। ল্যান্সেট-এ খবর প্রকাশিত হচ্ছে “The online antivaccine movement in the age of COVID-19” (অক্টোবর, ২০২০) শিরোনামে। অ্যান্টি-ভ্যাক্সারদের অনুগামী সংখ্যা ৭৮ লক্ষের ওপরে। এরকম সময়েই মানব ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য ফাইজারের ভ্যাক্সিন বাজারে এলো ১১ মাস সময়ে – যেখানে গড়ে একটি ভ্যাক্সিন বাজারে আসতে সময় নেয় ১০.৭ বছর। এরকম সব অদ্ভুত ঘটনার জন্মদাত্রী বা দাতা (ভাইরাসের লিঙ্গ নিয়ে নিশ্চিত নই) সার্স-কোভ-২ বা করোনাভাইরাস।
ল্যান্সেট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে (৫.০৯.২০২০) “Is India missing COVID-19 deaths?” শিরোনামে। এই প্রতিবেদনে সরকারের তরফে দেওয়া মৃত্যুর সংখ্যার তথ্য নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সংশয় প্রকাশ করেছেন। বলা হয়েছে – “জনতার তরফে চাপ এবং মিডিয়ার রিপোর্ট বিভিন্ন রাজ্যকে “কম করে দেখানো” মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে আবার ভাবতে বাধ্য করছে।” মৃত্যু ভারতবাসী এবং বিশ্ববাসীর কাছেও অজানা কোন বিষয় নয়, বরঞ্চ গা সহা হয়ে গেছে, বিশেষত সুযোগ-সুবিধে বঞ্চিত প্রান্তিক মানুষদের কাছে। কিন্তু মৃত্যুরও তো রকমফের থাকে! সেরকমই এক ইতিহাস জানবো আমরা। এরকম অসহায় পরিস্থিতিতে ভ্যাক্সিন সাধারণ মানুষের কাছে বাঁচার অমৃত কুম্ভ এবং রাষ্ট্রের কাছে নতুন জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা সৃষ্টি করার হাতিয়ার হিসেবে বাজারে এসেছে।
নেচার-এর মতো পত্রিকায় একটি প্রবন্ধের শিরোনাম “Why a pioneering plan to distribute COVID vaccines equitably must succeed” (১৩ জানুয়ারি, ২০২১)। ভ্যাক্সিন বাজারে আসার পরে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে পৃথিবীর দরিদ্র দেশগুলো অব্দি ভ্যাক্সিন পৌঁছবে কিভাবে? করোনার আক্রমণে এরাও বিপর্যস্ত। ধনী এবং মাঝারি আয়ের দেশগুলো নিজেদের জন্য অর্থ দিয়ে ভ্যাক্সিন কিনে নিতে পারবে। কিন্তু এ দেশগুলো? প্রবন্ধটিতে বলা হয়েছে – “এটা নিম্নতম আয়ের দেশের ক্ষেত্রে আবশ্যিক। এ দেশগুলোর কেনার অর্থনৈতিক ক্ষমতা নেই। একটি অতিমারিকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক স্তরে মোকাবিলা করতে হবে। যতক্ষণ না ভাইরাস সর্বত্র নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসছে ততক্ষণ পুনঃসংক্রমণের রিস্ক থেকেই যায়।” নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ (“One Vaccine Side Effect: Global Economic Inequality” ডিসেম্বর ২৫, ২০২০) লেখা হয়েছিল – “কিন্তু ভ্যাক্সিনের সুফল সমবন্টন থেকে অনেক দূরে থাকবে। ধনী দেশেরা ভ্যাক্সিনের সীমিত উৎপাদনের বেশিরভাগটাই কিনে নিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো যেখানে বিশ্বের বেশীরভাগ মানুষ বাস করে তাদের নিজেদের অর্থ ব্যয় করে কিনতে হবে।” ফলে এখন যেটা বিনে পয়সার ভ্যাক্সিন বলে মনে হচ্ছে একটা সময়ের পরে সেটা আমাদের কাছে উচ্চমূল্যের হয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল।
এই মুহূর্তে ভ্যাক্সিনের ধাপগুলো যে অবস্থায় আছে – প্রি-ক্লিনিক্যাল – ১৯০+ ভ্যাক্সিন রয়েছে এই ধাপে, যেখানে স্বল্পসংখ্যক ভলান্টিয়ার এবং পরীক্ষাগারে প্রাণীদের ওপরে পরীক্ষার স্তরে আছে। ফেজ ১ – ৪৩টি ভ্যাক্সিন জনা ত্রিশেক (১০০-র কম) স্বাস্থ্যবান যুবকদের ওপরে পরীক্ষার স্তরে আছে ভ্যাক্সিনের সেফটি (নিরাপত্তা) এবং সঠিক ডোজ নির্ধারণের জন্য। ফেজ ২ – ২০টি ভ্যাক্সিন দ্বিতীয় স্তরে আরও বেশি সংখ্যক মানুষের ওপরে (১০০০ জনও হতে পারে) প্রয়োগ করে ফলাফল দেখা হচ্ছে, যাদের মধ্যে অসুস্থতার রিস্ক বেশি এমন গ্রুপের মানুষদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফেজ ৩ – ২০টি ভ্যাক্সিনকে আরও বেশি সংখ্যক মানুষের (কয়েক হাজার) ওপরে প্রয়োগ করে এর কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তাকে পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে। সীমায়ত – অর্থাৎ সীমায়ত স্তরে (অনুমোদিত হবার আগের ধাপ) রয়েছে ৭টি ভ্যাক্সিন। অনুমোদিত – আমেরিকা এবং ইংল্যান্ড মিলে অনুমোদিত ভ্যাক্সিনের সংখ্যা ৩টি। এগুলো হল (১) ফাইজার এবং বায়োএনটেক কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে তৈরি mRNA ভ্যাক্সিন, মডার্নার তৈরি mRNA-1273 ভ্যাক্সিন এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকা কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে তৈরি ভাইরাল ভেক্টর ভ্যাক্সিন। এছাড়াও চিনে তৈরি Sinopharm এবং Sinovac ভ্যাক্সিন চিন, সংযুক্ত আরব আমীর শাহি, বাহারাইন, ইন্দোনেশিয়া এবং আর্জেনটিনায় ব্যবহারের ছাড়পত্র পেয়েছে। পরিত্যক্ত – ভ্যাক্সিন তৈরির মাঝপথে পরিত্যক্ত হয়েছে ১টি ভ্যাক্সিন। অস্ট্রেলিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয় এই ভ্যাক্সিন তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল। (“Coronavirus Vaccine Tracker”, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ৫.০১.২১)
৮ মাস আগে বিশ্ববন্দিত জার্নাল সায়ান্স-এর একটি খবর ছিল “Unveiling ‘Warp Speed,’ the White House’s America-first push for a coronavirus vaccine” (১২.০৫.২০২০)। অর্থাৎ, ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে হোয়াইট হাউজ যে বিকারগ্রস্ত গতি (Warp Speed) দেখাচ্ছে তা আমেরিকা-প্রথম (America-First) এই মন্ত্র নিয়ে করোনা ভাইরাসের ভ্যাক্সিন তৈরি হবে। এ লেখাতে পরে আরও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে – “আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পরিত্যাগ করে – এবং চিনের যে কোন ধরনের ভ্যাক্সিন পরিহার করে – আমেরিকা আশা করছে জানুয়ারি ২০২১-এর মধ্যে ৩ কোটি প্রমাণিত ভ্যাক্সিন তৈরি করে ফেলতে পারবে যেগুলো সবই আমেরিকানদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।” সহজ কথা, ভ্যাক্সিনের সুফল ভোগ করবে কেবলমাত্র আমেরিকা। আরও বলা হয়েছে – “Operation Warp Speed” এর মধ্যেই ১৪টি ভ্যাক্সিন ক্যান্ডিডেটের মধ্যে এর কার্যক্রমকে সীমায়িত করেছে এবং পরিকল্পনা রয়েছে ৮টি ভ্যাক্সিনকে নিয়ে জোর কদমে এগোবে।” রয়টার্স সংবাদ সংস্থার খবর ছিল (১৪.০৭.২০২০) – “Warp Speed initiative aims for COVID-19 vaccine production within 6 weeks”। এই Operation Warp Speed (OWS)-এর সুবাদেই অক্সফোর্ড ভ্যাক্সিনের ভারতের সিরাম ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়া-র সাথে ১০ কোটি ভ্যাক্সিনের ডোজের ব্যবস্থা হয়েছে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ একটি প্রতিবেদন (২৬.১১.২০২০) – “Politics, Science and the Remarkable Race for a Coronavirus Vaccine”। রাজনীতি ও বিজ্ঞানের পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝার জন্য শিরোনামটিই যথেষ্ট। এ প্রতিবেদনে Operation Warp Speed-এর সাফল্যের জন্য তিনটি প্রধান কারণের কথা বলা হয়েছে – (১) ভ্যাক্সিন তৈরির নতুন পদ্ধতি বিজ্ঞানীদের হাতে সার্স-কোভ-১ মহামারির সময় থেকে বাস্তবে পরীক্ষিত হবার অপেক্ষায় ছিল, (২) আকাশ-ছোঁয়া সংক্রমণ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের গতি বহুগুণ বাড়িয়ে দিল, এবং (৩) সরকার প্রস্তুত ছিল প্রয়োজনীয় অর্থ নিয়ে এবং আমলাতন্ত্রের লাল ফিতের বাঁধন আলগা করার জন্য। এর ফলে এমনকি ভ্যাক্সিনের ট্রায়াল শেষ হবার আগেই বিপুলহারে উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ রইলোনা।
কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেল – (১) আমেরিকার ক্ষেত্রে সাদা শুধু নয়, কালো ও হিস্পানিকদের ক্ষেত্রেও কি একইরকম কার্যকরী হবে? (২) অনেক বড়ো আকারে বিভিন্ন দেশের ভিন্ন বয়সের ও ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে উপযুক্ত ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল না দিলে কিভাবে একটি ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে? (৩) ভ্যাক্সিন নেবার পরে যে ভ্যাক্সিন নিয়েছে সে আবার সংক্রমিত হবেনা এরকম গ্যারান্টি দেওয়া যাবে? এবং (৪) উপযুক্ত সংরক্ষণ ব্যবস্থা রক্ষা করে পৃথিবীর অন্তত এক বড়ো অংশের মানুষের কাছে এই ভ্যাক্সিন পৌঁছে দেওয়া যাবে তো? এখানে একটি সাম্প্রতিক তথ্য বলছে “Covid-19 vaccine to help cold chain market jump 17% to Rs 1.7 trn in CY21” (বিজনেস ট্যান্ডার্ড, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২০)। অর্থাৎ, ভ্যাক্সিনের কল্যাণে কোল্ড চেনের বাজার ১৭% বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকার অংক ছোঁবে।
কোটি কোটি মানুষের জীবনের প্রশ্ন যেখানে জড়িয়ে আছে সেখানে “শর্টকাট”-এর কোন প্রসঙ্গ আসতে পারেনা। মেডিক্যাল-ইন্ডাস্ট্রিয়াল-স্টেট-পলিটিক্স কমপ্লেক্সের একটি ভালো উদাহরণ পাওয়া যায় এই প্রতিবেদনে। “Operation Warp Speed”-এর প্রধান দায়িত্বে দুজন – বিজ্ঞানের অংশে রয়েছেন একজন বিজ্ঞানী এবং লজিস্টিকের দায়িত্বে মিলিটারির চার-তারা জেনারেল গুস্তাভ এফ পার্না। আলোচিত মেডিক্যাল-ইন্ডাস্ট্রিয়াল-স্টেট-পলিটিক্স কমপ্লেক্সের বৃত্তটি সম্পূর্ণ হল।
Operation Warp Speed (OWS)-এর মূল বিষয়টি কি? এদের বয়ানে – “যেভাবে ট্র্যাডিশন অনুযায়ী বিভিন্ন ধাপে ভ্যাক্সিন তৈরির পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে, সে পদ্ধতিগুলোকে বাতিল করার বদলে বিভিন্ন ধাপ সমান্তরালভাবে চলবে – যেমন, বাণিজ্যিকভাবে ভ্যাক্সিনের উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে এর কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তা নির্দিষ্টভাবে প্রমাণের বেশ আগেই। এতে আর্থিক ঝুঁকি বাড়ে, উৎপাদনের ঝুঁকি বাড়েনা।” অর্থাৎ, যে যে ধাপে সাধারণভাবে ভ্যাক্সিন তৈরি হয় এখানে সেগুলো বাতিল করা হচ্ছেনা। একইসাথে একাধিক ধাপের কাজ সমান্তরালভাবে চালিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু তৈরি ভ্যাক্সিনের নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্নের নিরসন হলনা।
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল-এ ভ্যাক্সিনে তৈরির নতুন পথ-পদ্ধতির ব্যাখ্যা দিয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে – “The Covid-19 Vaccine-Development Multiverse” শিরোনামে (১৪.০৭.২০২০)। এই সম্পাদকীয়তে বলা হল – “কোভিড-১৯-কে প্রতিরোধ করার জন্য একটি ভ্যাক্সিনের জরুরী প্রয়োজন এবং এর পরিণতিতে এই রোগের ছড়িয়ে পড়ার ফলে যত মৃত্যু ঘটছে এবং শারীরিক জটিলতা তৈরি হচ্ছে তাকে আটকানো যাবে।” বলা হল – “অনেক সংখ্যক ফেজ ৩ ট্রায়াল ব্যর্থ হয় কারণ নিরাপত্তা (safety) এবং কার্যকারিতা (efficacy)-র সবচেয়ে ভালোভাবে সুসামঞ্জস্য রক্ষা করতে যে ডোজের প্রয়োজন সেটা করতে ভুল হয়। mRNA vaccine নিয়ে সঠিক ডোজ নির্ধারণ করার কাজ এখনো চলছে।” তাহলে এখনো খুব নিশ্চিত অবস্থানে আমরা নেই। বৈপ্লবিক গতিতে করোনা ভ্যাক্সিনের প্রস্তুতি চলছে – ৬ বছরের সময় সীমাকে ৬ মাসে নামিয়ে আনার পরেও স্বস্তিদায়ক অবস্থায় আমরা নেই। সম্পাদকীয়তে আরও বলা হল – “পৃথিবী এখন দেখেছে ৬ বছরের কাজকে সঙ্কুচিত করে ৬ মাস করা হয়েছে। ভ্যাক্সিনের বহুস্তরীয় পদ্ধতি (vaccine multiverse) এটা আবার করতে পারবে, যাতে বাস্তবক্ষেত্রে নিরাপদ, কার্যকরী কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন আগামী ৬ মাসে এর লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারে?”
এই সম্পাদকীয়তেই জানানো হল “সার্স-কোভ-২-এর প্রথম জেনোমিক সিকোয়েন্স প্রকাশ করা থেকে ফেজ ১ পর্যন্ত আসতে ৬ মাস লেগেছে, যেখানে স্বাভাবিক নিয়মে লাগে ৩ থেকে ৯ বছর।” সহজ কথা হল, জানুয়ারি, ২০২০-তে সার্স-কোভ-২-এর জেনোমিক সিকোয়েন্স বিজ্ঞানীদের হাতে আসার পরে ফেজ ১ ট্রায়াল শুরু হয়েছে ৬ মাসের মধ্যে যেখানে প্রচলিত পথে এ সময় লাগার কথা ৩ থেকে ৯ বছর। অতিমারির জীবন-মরণ সমস্যার ক্ষণে সময়ের পরিমাপকে সংকুচিত ও জমাট বাঁধিয়ে দেওয়া হচ্ছে (condensed, coalesced and overlapped)। এতে সময় সংক্ষেপ হচ্ছে। এর ফলে রোগীর নিরাপত্তা, ভ্যাক্সিন নিরাপদ কিনা এগুলো যেমন বিবেচ্য তেমনই বিবেচ্য ভ্যাক্সিনটি নির্ভরযোগ্য নৈতিকতার এবং বৈজ্ঞানিক কঠোর শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে গেলো কিনা, এ পরীক্ষাগুলোয় পাস করলো কিনা এগুলোও বিশেষ বিবেচ্য বিষয়।
অবশ্য বৈজ্ঞানিকদের পুর্ব-লব্ধ জ্ঞান এক্ষেত্রে বিশেষ কাজে লেগেছে। সেগুলো হল – (১) করোনা ভাইরাসের দেহের স্পাইক প্রোটিনের ভূমিকা সম্বন্ধে আগাম ধারণা থাকা, (২) ইমিউনিটির ক্ষেত্রে স্পাইক প্রোটিন প্রতিরোধের ক্ষেত্রে “নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি”-র ভূমিকা, (৩) নিউক্লিক অ্যাসিড (যেমন আরএনএ বা ডিএনএ) ভ্যাক্সিন প্ল্যাটফর্মের উন্নত চেহারায় বিবর্তন এবং (৪) ভ্যাক্সিন তৈরির প্রক্রিয়াকে ধাপে ধাপে (sequentially) করার পরিবর্তে সমান্তরাল ভাবে (parallel) করা, কিন্তু যারা ভ্যাক্সিন স্টাডিতে অংশগ্রহণ করেছে তাদের ক্ষেত্রে কোন ঝুঁকি না নিয়ে। পূর্বোল্লেখিত সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে – “কার্যকারিতা কেবলমাত্র তখনই নির্ধারণ করা যাবে যখন যাদেরকে ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে এবং অতিমারির হটস্পটের মধ্যে তুল্যমূল্য বিচার (match) করা যায় … এজন্য প্রাথমিক এন্ড পয়েন্টগুলোকে সতর্কতার সাথে নির্বাচন করতে হবে, নির্বাচন করতে হবে স্টাডি-ডিজাইন এবং স্যাম্পেল সাইজের (অর্থাৎ কতজনের ওপরে ট্রায়াল দেওয়া হবে) সম্ভাব্যতার পুনর্মূল্যায়ন বিবেচনায় রাখতে হবে।”
কত ধরনের ভ্যাক্সিন?
নেচার-এ প্রকাশিত (৩.০৯.২০২০) বিশেষ নিবন্ধ “Evolution of the COVID-19 vaccine development landscape”-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২.০৯.২০২০ অবধি হিসেব বলছে ৩২১টি বিভিন্ন ধরনের ভ্যাক্সিন ক্যান্ডিডেট (আমাদের বিচারে ভ্যাক্সিন) গবেষণার বিভিন্ন স্তরে রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২১টি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মধ্যে আছে – ৩৪টি দেশে ৪৭০টি স্থানে ২৮০,০০০ জন মানুষকে রিক্রুট করা হবে ভ্যাক্সিনের ট্রায়ালের জন্য। নীচের ডায়াগ্রাম থেকে বিভিন্ন ধরনের ভ্যাক্সিন এবং কোনটি কোন স্তরে রয়েছে সে বিষয়টি স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে।
প্রসঙ্গত, যে যে ধাপে ভ্যাক্সিন তৈরি হয়েছে সেগুলো হল – (১) প্রি-ক্লিনিক্যাল টেস্টিং (বিজ্ঞানীরা ভ্যাক্সিনটি প্রাণীদের দেহে পরীক্ষা করেন), (২) ফেজ ১ সেফটি ট্রায়াল (বিজ্ঞানীরা ভ্যাক্সিনটি স্বল্পসংখ্যক মানুষের দেহে প্রয়োগ করে নিরাপদ কিনা এবং কি ডোজে দেওয়া যেতে পারে তা দেখে নেন), (৩) ফেজ ২ এক্সপান্ডেড ট্রায়াল (এখানে ট্রায়াল চালানো হয় কয়েক’শ মানুষের ওপরে – ট্রায়ালটি আরও প্রসারিত হল। জুন, ২০২০-তে আমেরিকার মান্য সংস্থা এফডিএ নির্দেশ দিয়েছে যাদেরকে ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে তাদের অন্তত ৫০%-এর ক্ষেত্রে সুরক্ষা থাকতে হবে), (৪) ফেজ ৩ এফিকেসি ট্রায়াল (এখানে বিজ্ঞানীরা ভ্যাক্সিনটি কয়েক হাজার মানুষের ওপরে প্রয়োগ করেন এবং এবং একইসাথে প্ল্যাসেবোর সাথে তুলনা করে দেখে নিতে চান ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা কেমন), (৫) এর পরের ধাপ অ্যাপ্রুভাল বা অনুমোদন, (৬) WARP SPEED – The U.S. government’s Operation Warp Speed program is expected to name five or more vaccine projects to receive billions of dollars in federal funding before there’s proof that the vaccines work. এটা এবারের অতিমারির বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ সংযোজন, (৭) CMOBINED PHASES – এটাও বর্তমান পরিস্থিতির বিশেষ অবদান। একইসাথে একাধিক ফেজকে চালানো হবে সমান্তরালভাবে, পরপর ধাপে ধাপে নয়।
ভ্যাক্সিন নিয়ে পরীক্ষা শুরুর একেবারে গোড়ার দিকে নেচার পত্রিকায় (১৮.০৩.২০২০) “Coronavirus vaccines: five key questions as trials begin” প্রবন্ধে মৌলিক কতগুলো প্রশ্ন রাখা হয়েছিল ভ্যাক্সিন ট্রায়াল নিয়ে – (১) মানুষের কি ইমিউনিটি তৈরি হয়? (এখানে বলার যে WHO পরিষ্কারভাবে জানিয়েছে কোন “ইমিউনিটি পাসপোর্ট” নেই। একবার আক্রান্ত হলে একজন ব্যক্তি যে আবার আক্রান্ত হবেনা এরকম কোন নিশ্চয়তা নেই।) (২) যদি ইমিউনিটি তৈরি হয় তাহলে সেটা কতদিন অব্দি থাকবে? (৩) যারা ভ্যাক্সিন তৈরি করছে তারা কি ধরনের ইমিউন প্রতিক্রিয়া আশা করে? (৪) আমরা কি করে জানবো যে একটি ভ্যাক্সিন ঠিকভাবে কাজ করবে? (৫) ভ্যাক্সিনটি কি নিরাপদ হবে? আমেরিকায় খুব সামান্য সংখ্যক হলেও গুরুতর ইমিউনোলজিক্যাল পার্শ্বপ্রতক্রিয়া দেখা গেছে – ১,০০,০০০ জন মানুষের ক্ষেত্রে ১৩ জনের। ফলে এ প্রশ্নগুলো এখনও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক এবং এগুলো মাথায় রেখে ভ্যাক্সিন তৈরি কাজ চলছে।
COVAX নামে একটি যৌথ উদ্যোগ জন্ম নিয়েছে। এতে রয়েছে বিল এবং মেলিন্দা গেটস-এর সংগঠন GAVI (Global Alliance for Vaccines and Immunization), Coalition for Epidemic Preparedness Innovations (CEPI) এবং WHO। এদের লক্ষ্য হল ৯২টি low-income and middle-income দেশে সমান স্বচ্ছভাবে এবং ন্যায্যতা রক্ষা করে যাতে ভ্যাক্সিন পৌঁছে দেওয়া যায়। সবমিলিয়ে কয়েক’শ কোটি ভ্যাক্সিন তৈরির লক্ষ্যে বিজ্ঞানীরা জীবন বাজি রেখে লড়াই করে যাচ্ছেন। এখানে মনে রাখতে হবে “The race for a vaccine moves fast, as the need for a solution is evident, but we cannot forget that safety is of the highest importance.” তার সাথে এটাও মনে রাখতে হবে শুধু নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি নয়, আমাদের শরীরের T-cell-কে ভ্যাক্সিন কতটা সক্রিয় করে তুলতে পারছে সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধের ক্ষেত্রে T-cell-এর ভূমিকা (CD4 and CD8) অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। নেচার-এর একটি প্রতিবেদনে (“Coronavirus vaccines leap through safety trials — but which will work is anybody’s guess” – ২১.০৭.২০২০) বলা হয়েছে – “যদি একটি ভ্যাক্সিন একইসাথে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে এবং দু’ধরনের টি সেলকে উদ্দীপিত করতে পারে তাহলে রোগের বিরুদ্ধে এর লড়াই অনেক শক্তিশালী হবে … যখন efficacy trials (কার্যকারিতার পরীক্ষা) এদের প্রথম ফলাফল জানাবে তখন বোঝা যাবে ভ্যাক্সিনে তৈরি ইমিউন প্রতিক্রিয়ার প্রকৃত চরিত্র – কোভিড-১৯এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে কি পারছে না।” বিজ্ঞানীদের এখনো অজানা ঠিক কত পরিমাণ (what levels) অ্যান্টিবডি প্রয়োজন দেহে ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলার জন্য।
আমাদের একমাত্র আশা ভ্যাক্সিনের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকার পাশাপাশি এ সতর্কবাণীগুলোও মাথায় রাখতে হবে আমাদের। এর সাথে মনে রাখা দরকার ভ্যাক্সিন হল জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে একধরনের ইন্টারভেনশন, কোন পণ্য নয়। ভ্যাক্সিন তৈরির জন্য বিভিন্ন দেশ মিলিয়ে অভাবিতপূর্ব ৫ বিলিয়ন ডলার পাব্লিক ফান্ড বিভিন্ন সরকারের তরফে বিনিয়োগ করা হয়েছে। মডার্না, ফাইজার এবং অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা প্রাথমিকভাবে এদের ফেজ ৩ ট্রায়ালের রিপোর্ট প্রকাশ করতে চায়নি। গণদাবীতে এ রিপোর্ট প্রকাশ করে (Els Torreele, “Business-as-Usual will not Deliver the COVID-19 Vaccines We Need”, Development, ৯.১১.২০২০)। ভ্যাক্সিন নিয়ে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আরেকটি অসুবিধে আছে। বিভিন্ন টেকনোলজি বা ওষুধের ক্ষেত্রে যে আকাশ ছোঁয়া মুনাফা করা যায় ভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রে বহুজাতিক দৈত্যরা সে পরিমাণ মুনাফা করতে পারেনা। এজন্য ভ্যাক্সিন তৈরির ক্ষেত্রে এদের আগ্রহ কম থাকে। কিন্তু কোভিড অতিমারি একেবারে অভূতপূর্ব এক ঐতিহাসিক পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। এজন্য এক্ষেত্রে ভ্যাক্সিন তৈরির ক্ষেত্রে যে ঘাড়-ভাঙ্গা দৌড় ও প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে সে ঘটনাও মানব ইতিহাসে প্রথমবার ঘটলো।
এখানে ভাবতে হবে ভারতে অনুমোদিত দুটি ভ্যাক্সিন নিয়ে – (১) সিরাম ইন্সটিটিউট-এ তৈরি অক্সফোর্ড ভ্যাক্সিন কোভিশিল্ড, এবং (২) ভারত বায়োটেক-এর তৈরি কোভ্যাক্সিন। প্রথমটির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ট্রায়াল এবং বিভিন্ন ধাপে কঠোরভাবে পরীক্ষিত হলেও ভারতে আলাদা করে ট্রায়াল হয়নি। দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে না হয়েছে কোন যথোপযুক্ত ধাপেধাপে ট্রায়াল, না প্রকাশিত হয়েছে ট্রায়াল রিপোর্ট কোন মান্য আন্তর্জাতিক জার্নালে, না হয়েছে এর peer review। রোগীদের ওপরে এর প্রয়োগ শুরু হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে গেছে ভ্যাক্সিন এ মাস থেকেই টীকা দেবার জন্য। সর্বভারতীয় স্তরে ভারতবাসীর ওপরে প্রয়োগের প্রস্তুতি। এক অদ্ভুত শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয়েছে এই ভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রে – “clinical trial mode”। বিজ্ঞানী, চিকিৎসক এবং গবেষকদের কাছে অজানা এই “clinical trial mode” বলতে সঠিক কি বোঝায়। সায়ান্স জার্নালে প্রকাশিত হচ্ছে (জানুয়ারি ৫, ২০২১) “Scientists criticize ‘rushed’ approval of Indian COVID-19 vaccine without efficacy data”। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার প্রতিবেদন (৪.০১.২০২১) “India Approves Oxford-AsraZeneca Covid-19 Vaccine and 1 Other”। এ প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে – “Criticism about the lack of clarity on the data that the regulator examined came swiftly after the two vaccines were authorized for emergency use. All India Drug Action Network, a public health watchdog, immediately issued a statement requesting more information about the scope of clinical trials and dosing regimens for both vaccines. On the Bharat Biotech vaccine, called Covaxin, the group said it was “baffled to understand what scientific logic has motivated the top experts” to authorize a vaccine still in clinical trials.” প্রকট হয়ে উঠছে সরকারের তরফে স্বচ্ছতার এবং জনসমাজের তরফে রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাসের অভাব। যে দেশগুলো সাফল্য অর্জন করেছে (বিশেষ করে নিউজিল্যান্ড) সেসব দেশে এই পারস্পরিক স্বচ্ছতা ও বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে কাজ করেছে।
ওপরের ছবিটি দেখুন। কোভিশিল্ডের এক্সপায়ারি ডেট লেখা আছে ২৬.০৪.২০২১। এজন্যই কি টীকা দেবার জন্য এত তাড়াহুড়ো? ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস’ ফোরাম এবং অন্যান্য ডাক্তারি সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে তৈরি মঞ্চ থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে নির্দিষ্টভাবে তথ্য জানানোর জন্য স্মারক লিপি দেওয়া হয়েছে।
ইতিমধ্যে ভারত সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্যাক্সিনের প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে – কোথাও সুস্থ করে তোলার জন্য, কোথাও পরীক্ষামূলকভাবে। ইউরোপ এবং আমেরিকায় নাগরিকদের একাংশের জোরালো ভ্যাক্সিন-বিরোধী মানসিকতার জন্য আমেরিকার এফডিএ (ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) ফাইজার-বায়োএনটেক ভ্যাক্সিনের উপাদান কি সেটা তাদের ওয়েব সাইটে প্রকাশ করেছে। সেখান থেকে জানা যাচ্ছে এর উপাদান হল – (১) সক্রিয় উপাদান – nucleoside-modified messenger RNA (modRNA) encoding the viral spike glycoprotein (S) of SARS-CoV-2, (২) লিপিড জাতীয় পদার্থ – কোলেস্টেরল এবং অন্যান্য জটিল উপাদান।
ভ্যাক্সিনের মূল্য কত?
আন্তর্জাতিক মানে কয়েকটি ভ্যাক্সিনের দাম এরকম – মডার্নার ভ্যাক্সিনের প্রতিটি ডোজের দাম (দুটি ডোজ লাগবে) ৩২ থেকে ৩৭ ডলার; ফাইজার ভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রে (দুটি ডোজ লাগবে) প্রতিটি ডোজের মূল্য ১৯.৫ ডলার; অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার (দুটি ডোজ লাগবে) প্রতিটি ডোজের মূল্য (ভ্যাক্সিনগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন) ৩ থেকে ৪ ডলার, এবং নোভাভ্যাক্সের প্রতিটি ডোজ (দুটি ডোজ) ১৬ ডলার মূল্যের। ভারতে ভ্যাক্সিন প্রাথমিকভাবে বিনে পয়সায় দেবার কথা বলা হয়েছে। অন্য দেশেও প্রথমসারিতে যারা করোনার মোকাবিলায় রয়েছে (সমস্ত স্তরের চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, বর্জ্য পরিষ্কার যারা করে, অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার, বাস ড্রাইভার, পেনশনভোগী বৃদ্ধরা প্রভৃতি) তাদের জন্য ভ্যাক্সিন বিনামূল্যে দেওয়া হবে। জনসমাজের বাকী অংশকে মূল্য দিয়ে ভ্যাক্সিন নিতে হবে।
পূর্বোক্ত প্রবন্ধে মন্তব্য করা হয়েছে – “বিশ্বের নেতৃত্বের জন্য সে সময় এসেছে যখন এদের বিবেচনা করতে হবে ভ্যাক্সিন এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য প্রযুক্তি হল বিশ্বস্বাস্থ্যের জগতে সবার সম্পত্তি (as global health commoms) যা অবশ্যই সবার কাছে লভ্য হবে এবং মেডিক্যাল ও আর অ্যান্ড ডি (R & D)-কে নিয়ে যে বাস্তুতন্ত্র তাকে নতুন চেহারা দেবে এগুলোকে সবার কাছে পৌঁছে দেবার জন্য।”
নেচার-এ (১৩.০৮.২০২০) বিশেষ প্রবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে “এইডস, ম্যালেরিয়া অ্যন্ড টিউবারকিউলোসিস আর সার্জিং”, অর্থাৎ এইডস, ম্যালেরিয়া এবং টিউবারকিউলোসিস প্রবল গতিতে বাড়ছে। শক্ত ও সজীব প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছাড়া এ মানুষগুলোকে কে বাঁচাবে? আমরা বর্তমান মুহূর্তে কেবল করোনা-প্রতিরোধী ভ্যাক্সিন নিয়ে ব্যস্ত । কিন্তু শুধু ভ্যাক্সিন আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র উত্তর নয়। বিপরীতে, ভ্যাক্সিন কুহকী আত্মসন্তোষের জন্ম দিতে পারে – মাস্কের ব্যবহার, ব্যক্তিগত/সামাজিক দূরত্ব বিধি, হাঁচি-কাশির ক্ষেত্রে সতর্কতা শিকেয় উঠে যেতে পারে। তখন সামাজিকভাবে আরেক দুর্দৈবের সম্মুখীন হবো আমরা। মনে রাখা দরকার, এই ভাইরাস চলে যাবার জন্য আসেনি। এর জ্ঞাতিগুষ্টিরা অপেক্ষা করে আছে মানুষের শরীরে প্রবেশের জন্য, এবং সমস্ত মানুষ সম্ভাব্য সংক্রমণের শিকার হয়ে আছে। নেচার-এর আলোচিত প্রবন্ধের পর্যবেক্ষণে – “তিন মাসের বেশি সময় ধরে লকডাউন অসংখ্য মানুষকে নন-কোভিড বা কোভিড নয় এমন রোগীরা সাধারণ চিকিৎসার কাছে পৌঁছুতে পারেনি, চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। একইসাথে নতুন রোগীদের উপসর্গ চিহ্নিতই হয়নি। ফলে চিকিৎসার প্রসঙ্গ আসেনা।” এদের হিসেবে চিন, ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়ে ২০২০ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে ২০০,০০০ অতিরিক্ত মৃত্যু ঘটবে, সাব-সাহারা আফ্রিকায় ২০২০-তে ৭৭৯,০০০ জন মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে।” ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত “Has COVID-19 subverted global health” প্রবন্ধে (৩০.০৫.২০২০) রিচার্ড হর্টন বলছেন – “দীর্ঘকালীন এবং সর্বব্যাপী লকডাউনের পলিসি এবং উচ্চ-প্রযুক্তির স্বাস্থ্য পরিষেবার উপরে জোর অনিচ্ছাকৃতভাবে আরও বেশি অসুস্থতা এবং মৃত্যুর জন্ম দিতে পারে, বিষমভাবে দরিদ্রদের ক্ষতিগ্রস্ত করে।”
হ্যাঁ, পৃথিবী জুড়ে কোটি কোটি মানুষের বেঁচে থাকার প্রশ্ন যেখানে জড়িয়ে আছে সেখানে নিরাপত্তা, গুণমান এবং কার্যকারিতার প্রসঙ্গে কোন আপোষ চলতে পারেনা। চলতে পারেনা তথ্যের ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা, অসম্পূর্ণতা এবং মিথ্যাচার। তেমনি চলতে পারেনা প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে জলাঞ্জলি দেবার প্রচেষ্টা।
ভ্যাকসিন বিতরণের ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার জন্য লেখকের প্রশংসা প্রাপ্য, জনসমক্ষে এটি জানানোর প্রয়োজন আছে।
তবে এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে বাজারে আপাতত দুই ধরণের ভ্যাকসিন আসছে – একটি mRNA নির্ভর ভ্যাকসিন যেটি ভাইরাসের একটি বিশেষ প্রোটিনের বিরুদ্ধে তৈরী করা হয়েছে, এতে করে ভাইরাস আক্রান্ত হলে পরে স্পাইক প্রোটিন চিহ্নিত করে ভ্যাকসিন জনিত antibody তাকে আক্রমণ করবে এবং তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। দ্বিতীয়টি ভারতের কোভ্যাকসিন গোছের ভ্যাকসিন, যেখানে নির্জীব ভাইরাস শরীরে দেওয়া হচ্ছে, এতে করে সাবেকী ধাঁচের ইমিউনিটি গড়ে উঠবে |
তা, এবারে মুশকিল হচ্ছে, ২০২১ এ যে ভাইরাসটি সংক্রমণের দিক থেকে বিবেচনা করলে প্রধান হয়ে উঠবে বলে মনে করা হচ্ছে, তাতে এমন একটি মিউটেশন হয়েছে E484K, যার ফলে সে ভাইরাস দেখা যাচ্ছে antibody response evade বা এড়াতে সক্ষম হচ্ছে | এবং এটি স্পাইক প্রোটিনের মিউটেশন, যার জন্য ভ্যাকসিন কোম্পানীরা নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন।
এবার কেঁচে গণ্ডুষ করতে হলে পুরনো স্টক কারা পাবেন, আর কারা নতুন ভ্যাকসিন পাবেন, কালক্রমে এইটে নিয়ে বিবাদ শুরু হবে, সম্ভবত এপ্রিল মাসের পরে। দেখা যাক।
Excellent one sir
ভয়ঙ্কর সত্য সামনে আনলেন, ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য।
দু’দিন আগে আমার আশাবাদী বন্ধু বলেছিলেন, এই প্রতিষেধক যেটা আজ থেকে দেওয়া হবে তাকে তৃতীয় দফার পরীক্ষা বলা যেতে পারে।
আমারও মনে হয়েছে, রোগের প্রকোপ যে হারে কমছে তাতে প্রতিষেধক এখন না চালু করতে পারলে পরে আর বিক্রী হবে না।
যাক মনের শান্তির জন্য প্রতিষেধক কেনা তো আর বন্ধ হবে না। অতএব কিছু বিক্রী তো হবেই।
Khoo b bhalo laglo Jayanta da.Bhabte bhoi lagche je amader ke diye clinical trials hobe.puro sadistic.Paliye jabo bhabchi.
খুব ভালো লাগল। বিভিন্ন দিক থেকে দেখে প্রাঞ্জল ভাষায় সুলিখিত।