পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশনে পড়তাম। ১৫ ই আগষ্ট বিশেষ প্যারেড হতো। সামনে মহীরুহ ব্যক্তি। পতাকা উত্তোলন সমাগত। সাদা ড্রিল ড্রেসে আমরা কচিকাঁচারা প্ল্যাটুন বিশেষে দন্ডায়মান। হঠাৎ ছন্দপতন। পেছন থেকে কেউ হঠাৎ পপাতধরনীতল। অ-জ্ঞান। মহীরুহের চোখ এড়িয়ে পেছনের সারদা মন্দিরে টেনে নিয়ে যাওয়া হত তাদের। চোখে মুখে জলের ছিটে। অবশেষে ইহ জগতে চক্ষু উন্মীলন। পুনরায় চোখ এড়িয়ে প্ল্যাটুনে ফিরে আসা। কুচকাওয়াজ শেষে তাকে নিয়ে বন্ধুদের চোখ টিপে মজা। অবশেষে মূল স্রোতে অবগাহন।
এ ছিলো প্রতি কুচকাওয়াজের জমায়েতকালীন রোজনামচা। কচি মনে ভবিষ্যৎ দেশসেবকের এহেন ধরণী নেওয়া নিছকই মজার বিষয় ছিলো।
পরবর্তীতে জয়েন্টের ফর্ম ফিল আপের লাইনেও দেখেছি এভাবে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতে। এম বি বি এসের প্রথম বর্ষে মৃতদেহ ডিসেকসনের সময় বা নিজের রক্ত দিয়ে পরীক্ষা করাে-কালীন এই আপদে পড়েছে অনেকই কুঁড়ি-চিকিৎসক। আরও পরে চিকিৎসক জীবনে দেখেছি এস এস সি-র লম্বা লাইনে হঠাৎ জ্ঞান হারানো পোলাপানকে নিয়ে উদবিগ্ন বন্ধুদের।
অর্থাৎ কিনা পেট রোগা বাঙ্গালীর চর্মচক্ষে এ দৃশ্য মোটেও অনভিপ্রেত নয়। আর অজ্ঞান হয়ে যাওয়া নিয়ে বাঙ্গালীর অতিরঞ্জিত বর্ণনা অনেকক্ষেত্রেই রজ্জুতে সর্পভ্রমের সামিল।
কিন্তু কেনই বা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে মানুষ? পড়ে গিয়েই বা কিছুক্ষেত্রে কেন সাথে সাথেই জ্ঞান ফিরে আসে তাদের ?
দন্ডায়মান অবস্থায় মস্তিষ্কে রক্ত পাঠানোর জন্য হৃৎযন্ত্রকে মাধ্যাকর্ষণের বিপরীতে রক্ত ঠেলতে হয়। আর আমাদের ব্রেন, রক্তবাহিত অক্সিজেনের স্বল্প বিরতিও সহ্য করতে নারাজ। অর্থাৎ কোনও কারণে হৃৎযন্ত্রের ক্ষমতা হ্রাস পেয়ে মাধ্যাকর্ষণের বিপরীতে মস্তিষ্কে রক্ত পৌঁছাতে ব্যাঘাত ঘটলেই চিত্তির। কিন্তু হৃদয়বান বাঙ্গালীর হঠাৎ কেন হৃদয়ের ক্ষমতার হ্রাস হবে?
এ ব্যাখ্যার সরলীকরণে ধরে নিন, রাম বাবু আর শ্যাম বাবুর মধ্যে রাজনৈতিক বাদানুবাদ চলছে। হঠাৎ রাম বাবুর কিছু শব্দ শ্যামবাবুর কর্ণের ভিতর দিয়া মরমে পশিল। অর্থাৎ ভেগাস নার্ভ উদ্দীপিত হলো। সেই উদ্দীপনা হৃৎযন্ত্রের ক্ষমতা সাময়িক কমিয়ে দিল। মস্তিষ্কে রক্ত পৌঁছাল কম। শ্যাম বাবু ধরণী লইলেন। চিকিৎসার পরিভাষায় ‘ভেসোভেগাল অ্যাটাক’।
আবার দীর্ঘক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে শরীরের অধিকাংশ রক্ত মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে পায়ে এসে জমা হওয়ায় মস্তিষ্কে রক্ত পৌঁছাতে ব্যাঘাত ঘটলো। সেক্ষেত্রেও শ্যামবাবুর জ্ঞান হারিয়ে ধরণী নেওয়া অস্বাভাবিক নয়।
এছাড়াও অনেক অনেক কারণ থাকলেও দুধে ভাতে বাঙ্গালীর জন্য অতি সরলীকৃত ব্যাখ্যা আপাততঃ এই পর্যন্তই।
এবার বলি শ্যামবাবুকে ধরণী নিতে দেখে রামবাবুর কি করণীয় সে ব্যাখ্যায়।
শ্যামবাবুর মস্তিষ্কে পুনরায় রক্ত পৌঁছে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। সেজন্যে শ্যামবাবুকে চিৎ করে শুইয়ে দিন। পা দুটি ওপরের দিকে তুলে কিছুক্ষণ ধরে রাখুন। সহজ ব্যাখ্যায় পায়ের রক্ত হৃদয়ের সাহায্যে মস্তিষ্কে পৌঁছাবে তৎক্ষণাৎ। শ্যামবাবু আবার ঝগড়া শুরু করতে পারবেন।
এসময় চোখে মুখে জল দিয়ে সম্ভ্রম আদায় হবে বৈকি, কিন্তু সুস্থতার লক্ষ্যে বিশেষ কিছু হবার নয়। বরং পা দুটি তুলে ধরাই বিজ্ঞানসম্মত।
কিন্তু এত বছরের চোখে মুখে জল দেওয়া সহজে কি মুছে দেওয়া যায়? এই তো সেদিন দেখলাম পল্টুর উল্টে যাওয়ায় বল্টুর জল অব্যর্থ কাজ করলো। তার বেলা?
আসলে পল্টু উল্টে গিয়ে যেই না মেঝেতে পড়েছে অমনি পায়ের রক্ত, হৃৎপিন্ড আর মস্তিষ্ক ধরণীর সমান্তরালে আসায় সহজ হয়েছে মস্তিষ্কে রক্তের পুনঃ সঞ্চালন। মস্তিষ্কে পৌঁছেছে রক্তবাহিত অক্সিজেন। পল্টুর জ্ঞান ফিরেছে।
তাহলে কি জল দেব না? দেব না আমরা জল?
দিতে অবশ্যই পারেন। কিন্তু এ জ্ঞান হারানো যদি খিঁচুনির কারণে হয়? ভেসোভেগাল অ্যাটাক ছাড়া অন্য কোনও কঠিন কারণে, দীর্ঘ মেয়াদি জ্ঞানলোপের কার্ণে হয়? সেক্ষেত্রে ঐ জলই রোগীর শ্বাসপথে ঢুকে শ্বাসরোধ করতে পারে। তাই ই সাবধান হওয়া ভালো।
এবার প্রশ্ন হলো, কি করে আমরা বুঝবো কোন জ্ঞান হারানো কি কারণে হয়েছে?
এইখানেই প্রাথমিক চিকিৎসার ইতি। পা দুখান তুলে ধরে যদি না ফেরে জ্ঞান তাহলে তড়িঘড়ি চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন। বাকিটা চিকিৎসকেদেরই বুঝে নিতে দিন। জ্ঞান ফেরার পর না হয় চিকিৎসকের সাথেই বাকি ঝগড়াটা সেরে নেবেন।