বিল্টুর কাঁধে বসে হলুদ ঠোঁট দিয়ে পোষা কালো বুনো -ময়না কানের লতিতে ঠোকর দিচ্ছে। আর গুরগুর করে গলার ভিতরে একটা আওয়াজ করে চলেছে। বোধহয় কিছু বলার চেষ্টা করছে। বিল্টু ঈশারা করে তাকে চুপ থাকতে বলেছে। ও বিল্টুকে খুব ভয় পায়।
গুনগুন-এর পিঠে লম্বা দুটো বিনুনি দুলছে আর তার হাতে একটা কঞ্চির ছড়ি। পায়ে চটি, গায়ে ছাপ ছাপ সিফন কাপড়ে বানানো ফ্রক। তার চোখে চশমা। সে বিল্টুর বোন দু বছরের ছোট।
তৃতীয়জন এদের থেকে একটু বড়। অন্ততঃ বিল্টুর থেকে দু’ বছরের বড়। সে একটু লম্বা চওড়া। ভয় ডর তার শরীরে যথেষ্ট কম। ক্লাস নাইনে পড়ে তাই তার জ্ঞানগম্মিও অনেকটা বেশি সব বিষয়ে। সে কবি। কবিতা লেখে না, এমনিই কবি তার ডাক নাম। তার কাছে আছে একটা গলায় রঙীন সুতুলির দড়ি বাঁধা বাঁদর ছানা , সর্বক্ষণের সঙ্গী।
এরা সবাই সম্পর্কের ভাই বোন। আপাততঃ পূজোর ছুটিতে দেশের বাড়িতে একসাথে হয়েছে।
এদের ঠাকুরদা বিজয়কৃষ্ণ দত্ত মহকুমা কোর্টের বড় উকিল। সখের যাত্রা থিয়েটার করেন। আবার স্থানীয় রাজনীতিতে তিনি সক্রিয়। তিনি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের মেম্বার। এক কথায় মান্যগন্য।
বিজয়া দশমী উপলক্ষেতে এই নাতি- নাতনির দঙ্গল তাঁকে প্রণাম করতে এলে তিনি বললেন, – তোমরা আমাকে একটা উপকার করবে ?
বিল্টু ও গুনগুন কথাটা শুনল কিন্তু এখানে কথাটার মানে কি বুঝতে পারল না।
কবি অনুধাবন করার চেষ্টা করল। সে তো বড়। বলল, – বল, তুমি কি এমন বিপদে পড়েছ যে আমাদের কাছে উপকার চাও?
– সে বড় বিপদ! মহা বিপদ। আমার সিন্দুকের চাবি খুঁজে পাচ্ছি না। আমার সব দলিল দস্তাবেজ টাকা পয়সা ঐ সিন্দুকে আছে। আর আছে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার বাসন কোসন। সবগুলো না পেলে পূজো কি করে হবে ?
এবার বিপদ আর উপকার কথাটার মানে বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে অনুধাবন করতে পারল বিল্টু আর গুনগুনও। তারা তো সব ইংরাজি স্কুলে পড়ে তাই বাংলাটা ঠিক সড়গড় নয়।
– বাবা যে বলে তুমি সবাইকে বিপদে আপদে সাহায্য কর। এটা কি সেই ধরনের বিপদ?
– না দিদি, এটা তেমন বিপদ নয়। আরো গুরুতর বিপদ।
-বুঝেছি, তা বলে পূজো হবে না। তা কি হয়? ঠাম্মা যে বলল কাল থেকে মাজা ঘষা শুরু করতে হবে।
– তাই তো বলি কবি দাদা, আমার ঘোর বিপদ। সিন্দুকের একটাই চাবি। গত সপ্তাহে কোর্টে একটা কেস ছিল। জটিল কেস। সেরে এসে চাবিটার দরকার পড়ে। টাকা পয়সা তো ওখানেই রাখি। চাবিটা বালিশের নীচে যেমন থাকে রেখেছি। পরে তন্নতন্ন করে খুঁজে আর পাই না।
এমন সময় এক গিন্নিবান্নী মহিলা ঢুকলেন ঘরে। ভারী চেহারার পরিচ্ছন্ন মহিলা।
– কি গো টাকা দাও, নারকেল পাড়তে রসুল আজ আসবে। দশটা গাছে উঠবে। অন্ততঃ দশটা টাকা তাকে দিতে হবে।
– রসুলকে বল,পাঁচ টাকা নিতে। এই নাও।
– একি মগের মুলুক নাকি? দশ টাকাই লাগবে। গতবার আট টাকা নিয়েছিল। বলেছে কাকিমা এবার কিন্তু দশ টাকা। আমি ওতেই রাজি হয়েছি। এখন কম করলে হবে?
– না মানে। এত কি দাম বেড়েছে?
– গত বছর কোর্টে তোমার ফি ছিল পঞ্চাশ টাকা। এবার সেটা ষাট টাকা হল কেন? মহিলাও উকিলের বউ, এতদিন তার সাথে ঘর করছেন। তিনি যুক্তিতর্কে কম দড় নন।
– তা ঠিক। আচ্ছা এখন এই পাঁচটা টাকা রাখ ।
– সে হবে না। আমার পুরো টাকাটা চাই, একসাথে। যত বুড়ো হচ্ছ তত তুমি হাড় কেপ্পন হচ্ছ।
দুম দুম আওয়াজ করে ভদ্রমহিলা ঘর ছাড়লেন।
কবি, বিল্টু এমনকি গুনগুনও এখন বুঝল দাদুর বিপদ। ঠাকুমা রেগে গেলে বাবা-কাকা অবধি তাঁকে ভয় পায়। তারা সব গুণীমান্যি শিক্ষিত লোক। দুজনে বড় চাকরি করে। একজন কলেজে পড়ায়। আর একজন বড় সরকারি অফিসার। তারা সদর শহরে আলাদা আলাদা বাসস্থানে থাকে। দাদুর দুই সুযোগ্য সন্তান ।
বিল্টু বলল, – ও দাদু তোমার শুনেছি অনেক টাকা।
– হ্যাঁ বাপি তো বলে, উকিলবাবুর অনেক টাকা।
– আছে আছে, অনেক না হলেও আছে। কিন্তু দিদি সে সব তো সিন্দুকে রাখা। তার চাবিটাই তো খুঁজে পাচ্ছি না। আর এখন তো কোর্টের ছুটি। তাই রোজগার বন্ধ। কাঁচা টাকা যা হাতে ছিল পূজোর সময় তা প্রায় শেষ।
– আমি বাবাকে বলব। তোমার টাকার ব্যবস্থা করে দেবে।
– সেটা কর না দাদা। আমি ছেলেদের টাকা কখনও নিই না । এখন নিলে সন্দেহ হবে।
– দাদু তুমি তো তাহলে ঘোর বিপদে পড়েছ?
– বড় চিন্তায় আছি। কি যে হবে, ব্যাঙ্কও বন্ধ।
দাদুর ঘর থেকে বেরিয়ে তারা এই বাগান ঘেরা বড় বাড়িটার পশ্চিমের দিকে একটা খোলা বারান্দায় এসে বসল। শাল কাঠের খুঁটির ওপরে টিনের চালা আর সিমেন্টের মেঝে। লাগোয়া একটা বড় ঘর, একটু পুরোন অনেকটা অন্ধকার ওখানে হাবি জাবি মালপত্র গচ্ছিত।পুরোন কাঠ, ভাঙা আসবাবপত্র, ঘুঁটের বস্তা, নারকেল পাতার কাঠি সব সেখানে জমা থাকে। এদের সবার পছন্দ এই ঘরটার সান্নিধ্য। ঠাম্মা ভয় দেখায় ওখানে বিছে আছে,চ্যালা আছে, সাপও থাকতে পারে। ওরা শোনে না। ওর কাছেই ওরা গুলতানি করে।
এখন একটা মিটিং করতে হবে। কি কর্তব্য? তা ঠিক করতে হবে।
কবি এই দলের সর্দার। সে যা বলবে সবাইকে তাই মানতে হবে। সে ক্লাস নাইন-এ পড়ে। স্কুলের ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন। মাথায় সব ক্লাসমেটদের থেকে উঁচু। আর তার আছে ঐ এক আজব সঙ্গী। বাড়িতে সে থাকলে তার সর্বক্ষণের সঙ্গী তার কাছ ছাড়া হয় না । সে একটা পোষা বাঁদরের বাচ্চা। তার বাবা গত বর্ষায় কলেজ থেকে সাইকেলে বাড়ি ফেরার পথে দেখতে পায় কোন এক গাড়ির চালক ওর মাকে পিষে মেরে ফেলে চলে গেছে আর বেচারী তখনও মাকে আঁকড়ে বসে ছিল। সেই দুধের শিশু অবস্থা থেকে তাকে বড় করা হচ্ছে দুুধ সাগু ফল পাকুড় খাইয়ে খাইয়ে। এখনও তেমন বড় হয়নি। প্রথম প্রথম কবির বাবাকে পাউডার দুধের ডিব্বাও কিনে আনতে হয়েছিল বাজারের ওষুধের দোকান থেকে।
দোকানদারও সুযোগ বুঝে জ্ঞান দিয়েছিল। – স্যার, ডাক্তাররা যাই বলুক এই পাউডার দুধ খেতে বাচ্চারা ভারি মজা পায়।
কবির বাবা রসিক মানুষ। হেসে বলেছিল, হয়তো ঠিক। তবে এ তো এমনি সেমনি বাচ্চা না। বাঁদরের বাচ্চা।
সেই থেকে আজ অবধি সে কবির সাথে সর্বক্ষণ জুড়ে আছে।
গভীর চিন্তায় তিনজন, সঙ্গে আরো দুজন যারা তাদের পোষ্য। তাদের চিন্তা- ভারাক্রান্ত মুখ দেখে ময়না অনেক কষ্টে এতক্ষণ চেপে রাখা তার বকবকানির অভ্যাসের ঢাকনা খুলে দিল।
ঘস ঘসে গলায় বলল, – বিপদ, বিপদ। বিপদ বড় বিপদ।
বিল্টু তাকে এক ধমক দেয়। – তুই থাম। না হলে ঐ গাছে ছেড়ে দেব।
ময়না কুঁকড়ে বিল্টুর কাঁধে বসে রইল। বিল্টুকে তোষণ আর আদর জানাতে সে ওর কানের লতিতে মৃদু ঠোকর দিতে থাকল।
এসময় গুনগুনের খুব খিদে তেষ্টা পায়। সে দুধ খেতে খুব ভালোবাসে। ঘন দুধের সুঘ্রাণে তার ভীষণ খিদে পায়।তবে এবার এসে এখনও অবধি যা পেয়েছে তা গুঁড়ো দুধের গোলা।
ঠাম্মাও বলে, – মেয়েটা আমার বড্ড দুধ খেতে ভালোবাসে। তা এমন কপাল। কমলার দিশি গাইটা এখনও ছাড়া পায়নি। খোঁয়াড়ে আছে।
গুনগুনের মাঝে মাঝেই মনে হয়। লোকে কি দুধ খায়, না পান করে? পান করাটাই তো সঠিক।
গুনগুন জানে কমলা মাসি ঠাম্মার বাড়িতে সবসময়ের জন্য থাকে। সব রকমের কাজ করে। বাসন মাজা ঘর ঝাঁট দেয়া,বিছানা তোলা। কি না করে? ঠাম্মার পছন্দের লোক। তার বাড়ি কাছে। রাতে বাড়ি যায়, সারাদিন এখানে থাকে। তার গরু দুগ্ধবতী নাম লালমনি । সে এ বাড়িতেই সব দুধ জোগান দেয়। কিন্তু এই পূূজোতে সব ওলোট পালোট হয়ে গেছে।
যেদিন মহালয়ার পরে সবাই তারা এসে মাদারিহাটে নামল সেদিন এসেই একগ্লাস দুধ ঠাম্মা তুলে দিয়েছিল। তার পছন্দের জিনিস। মুখে দিয়ে কেমন বিস্বাদ হয়ে গেল জিব। পাইডার দুধ গোলা।
– ও ঠাম্মা এ কি দুধ গো? কেমন গন্ধ!
– আর দুঃখের কথা বল না দিদি।
কমলা কি কাজ করছিল। হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে এসে বলল, – আমার লালমুনিকে পুলিশে ধরেছে গো। খোঁয়াড়ে চালান করে দিয়েছে।
ঠাম্মা ঘটনাটা সবিস্তারে বলে বোঝাল। কোন প্রতিবেশীর সব্জি বাগানে ঢুকে সব শাক সব্জি মুড়িয়ে খেয়েছে। তারা ঝগড়া ঝাঁটি করেনি। শুধু তার দুধেল গাই লালমনিকে ধরে নিয়ে সরকারি খোঁয়াড়ে চালান করে দিয়েছে। কোন টুঁ শব্দ করেনি। সেদিন বাড়ি গিয়ে চতুর্দিকে গরুখোঁজা করেও তার ‘লালমুনি’-কে খুঁজে পায়নি কমলা। শেষমেষ গিয়ে পৌঁছয় খড়েরডাঙির বটতলায়। যেখানে শিবু ঠাকুর সবে ধুনি জ্বালিয়ে গঞ্জিকার ছিলিমে পেত্থম একটা হালকা টান দিয়েছে।
কমলা লোকটাকে ভয় পায়। তার গায়ে বড্ড কটু গন্ধ। তবুও দম বন্ধ করে কাঁদতে কাঁদতে গড় হয়ে পেন্নাম করে বলল, – ও বাবা, আমার লালমুনি কোথায় গেল গো? তোমারে কত দুধ দিয়েছি গো আমার লালমুনির।
বক্তব্যের কিছু সারবত্তা আছে। উৎসবে উপলক্ষ্যে কমলা এক আধ পোয়া দুধ উৎসর্গ করে তো অবশ্যই। গাঁজার নেশার মুখে সে দুধের যে উপকারিতা তার ঋণ তো অস্বীকার করা যায় না। সেই লালমনি হারিয়ে গেছে । ব্যাপারটার মধ্যে বেশ হা-হুতাশ আছে। শুধু কেন কমলা একা এত দুঃখ পাবে? লালমনি হারিয়ে গেলে শিবু ঠাকুরের পালাপার্বণে প্রাপ্য দুধেও তো টান পড়বে। কালে কষ্মিনে যা হোক কিছু তো আসে।
– তুই চুপ কর মা। আমি এট্টু গুণে দেখি সে কমনে যেতি পারে? উড়ি তো আর যাবে না।
কিছুক্ষণ হিং টিং ছট আওয়াজ আর অঙ্গভঙ্গির ভড়ং করে সে থিতু হল। তবে বাবাজিটি বুদ্ধিমান। আজ দুপুরে একচোট ঘুম দিয়ে সে যখন এই আখড়ার ঝাঁপ তুলছিল তখন নবীন কাপালি এসে ঝুড়ি ভরে খানিক আধ খাওয়া আধভাঙা বেগুন মূলো কাঁচকলা, লাউ ইত্যাদি সব্জি হতচ্ছেদ্দা করে ফেলে দিয়ে গজ গজ করতে করতে চলে গেল।
চোখ কচলে কিছু বলার আগে নিমাই ঘেরা বেড়া পেরিয়ে গেল।
তবে কানে এল সে বলছে,
– ভগবতী দুগ্ধবতী লালমনি কমলার পোষ্য,
সব্জি খেল শাক খেল মাড়িয়ে দিল শষ্য।
নিমাই কাপালি একটু শখের যাত্রা করে, লোকগান লেখে। তার কথার যে কোন সিরিয়াস ব্যাপার আছে এটা শিব ঠাকুর বাবা ভাবেনি। শিবু সর্বক্ষণ গাঁজার ঘোরে থাকে। তবে তার স্মৃতিশক্তি ইদানিং খুব তীক্ষ্ণ হয়েছে। দুর্জনে বলে এ নাকি গাঁজার ক্রিয়া।
তবে কি এ লালমনির দুষ্কর্ম। ছাড়া পেয়ে নিমাইয়ের সব্জিবাগানে দক্ষযজ্ঞ করেছে। তাই বুঝি লালমনি নামক গাভী গায়েব হয়েছে।
একথা ভবিষ্যৎ বাণী হিসেবে কমলাকে জানানই যায়। মিলে যেতেও পারে আবার নাও যেতে পারে। লাগে তাক, না লাগে তুক।
– ও ঠাকুর ঝেড়ে কাশো।
ব্যোম ভোলা’ বলে এক পিলে চমকানে চিৎকার করে পরক্ষনেই গলার স্কেল অনেকটা নামিয়ে প্রায় ফিস ফিস করে বলল, –
ঈশাণ কোণে এগোও সোজা, ডিঙোও ফাঁকা মাঠ, বাগান পেরোও ধীরে, ডাইনে দেখ শান বাঁধানো ঘাট।
কপাল মন্দ চাষীর বেটার, লালমুনি যায় ক্ষেতে ।
দুধ দুয়ে নেয় খোঁয়াড় মালিক, দেয়না দুটো খেতে।
গুনগুন ছড়ি হাতে রান্নাঘর থেকে এসে বসতেই কবি একটা ফরমান জারি করল। আর তা শুনে বিল্টু হ্যা হ্যা করে হাসতে লাগল।
– তুই যদি এত ছোট তো আমাদের সাথে আছিস কেন? যা ঠাকমার কোলে গিয়ে শুয়ে থাক ।
– হোয়াই? আয়ম থার্টিন নাও। আ টিন এজার।
– ব্যস ব্যস আর ইংরিজি কপচাস নি।
কবি তাকে থামতে বলল। বিল্টু সমর্থন করল। কিন্তু গুনগুন কাঁদো কাঁদো হলো। আর তা দেখে দুটো অবলা প্রাণীর একটি তার কাঁধে চড়ে আর একটা মাথায় বসে গুনগুনকে সান্ত্বনা দিতে লাগল।
– ঠিক আছে এবার দুগ্ধপোষ্যকে ছেড়ে দিলাম।
ছেড়ে দিলেও সে তো নাছোড়বান্দা পিন পিন করে বলতে থাকল। – ইস যদি লালমনি থাকত। তো কি ভাল যে হত।
– কেন কি হয়েছে?
– জান না। কমলা মাসির গরু লালমনি কতদিন হলো নিখোঁজ।
কবি চোখ বুজে ভাবতে লাগল। একগোছা চাবি আর গরুর মধ্যে কি বা মিল ? অস্ফুটে বলল, – হুঁ হুঁ কোন মিল নাই।
– কিসের মিল দাদা ভাই? গুনগুন জিজ্ঞেস করল।
– দাদুর সিন্দুকের চাবি হারিয়েছে আর কমলার হারিয়েছে গরু। তাহলে কঠিন অঙ্ক। বিজয়কৃষ্ণের চাবি আর কমলার গাভি লালমনির মধ্যে কি মিল?
তবে আলোচনা আর বেশি দূর এগোল না। কারণ কবির বাবা মা এবং বিল্টু-গুনগুনের বাবা-মা কোথায় বেড়াতে গিয়েছিল এইমাত্র ফিরল। তাদের সঙ্গের ব্যাগপত্র বেশ ভারি। সেগুলোতে কি কি আছে সেই নিয়ে তারা উৎসুক হয়ে পড়ল।
গুনগুনের প্রিয় শোওয়ার স্থান দাদু- ঠাম্মার খাট। জ্ঞান হওয়া অবধি সে যখন এই বাড়িতে এসেছে এভাবেই থেকেছে। বিল্টু এবং কবি যখন ছোট ছিল তখন সবাই শীতের সময় এক লেপের নীচে দাদু ঠাকুমার সাথে হৈ হৈ করতে করতে শুয়ে পড়ত।
গুনগুনের মনে হল ঠাম্মা আজ বেশ রেগে আছে। পান চিবোতে চিবোতে দাদুকে বলছে, – তুমি কি উকিল গো? কমলার লালমনি-কে এখনও ছাড়াতে পারলে না?
– আমি মানুষের উকিল তোমার কথা শুনে দিলাম একখানা গরু পাচারের কেস নবীন কাপালির এগেনস্টে। এজলাসে সবাই হাসাহাসি করছিল, বিজয় উকিল গরু হারানোর কেস লড়ছে। তোমার কথায় করলাম।
– গরু বলে কি প্রাণী নয়। গরুটার জামিন করাতে পারলে না, মানুষ কি ভরসায় যাবে গো তোমার কাছে ?
– কেন? কমলার তো সেই মহালয়ার আগের দিনই সব বন্দোবস্ত হয়েছে।
– ঘোড়ার ডিম হয়েছে! কাঁচকলা হয়েছে। জানোনা মহালয়া থেকে কোর্টের ছুটি পড়ে যায়। ফি বছর ইয়ার বন্ধু নিয়ে তাস পেটো।
– সত্যি তো কেসটা তো জটিল হয়ে গেল।
-আর জটিল বলে জটিল। খোঁয়াড়ের মালিক আনারুলের নাতি হয়েছে। দিব্যি লালমনির দুধ দুয়ে নাতির পেট ভরাচ্ছে। আর আমার গুনগুন সোনা একটু দুধ খেতে ভালোবাসে। সে পাচ্ছে না। পাউডার দুধ গুলে খাওয়াতে হচ্ছে।
এবার গুনগুন একটু লজ্জা পেল। সে চোখ কান নাক বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করল।
আজ দ্বাদশী। হাতে মাত্র তিনটি দিন। কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে জোর তোড় জোড় চলছে বাড়িতে । চারিদিকে খুব উৎসব উৎসব ভাব। সকালে এক টেবিলে সবাই বসে প্রাতরাশ খাচ্ছে। দুই ছেলে বাবা নাতি নাতনিরা। দুই বৌমা জলখাবার তৈরিতে সাহায্য করছে।
গুনগুনের চোখে দাদুকে আজ কেমন নিস্তেজ মনে হল। সে তার জ্যেঠুর কাছে দৌড়ে গিয়ে কানে কানে কিছু বলে এল ।
বিজয়বাবুর বড়ছেলে বিভাস রায়গঞ্জ কলেজে ভূগোলের অধ্যাপক। সে সরাসরি বাবাকে জিজ্ঞেস করল, – বাবা তোমাকে কতবার বলেছি এবার কোর্ট কাছারি ছাড়। নতুন ছেলেরা এসেছে। তারা কত শত বইপত্র পড়াশুনা করে কেস লড়ছে। এখন কি আর বৃদ্ধদের কাছে কেউ কেস দেয়। খেলার মাঠে কে ইয়ার্কি মেরে বলল বিজয় কাকা গরু হারানোর কেস লড়ছে। আচ্ছা তোমার কি সত্যি এত টাকার দরকার?
– না মানে গরুর কেসটা….. ঠিক নয়। না না ঠিকই তো!
ছোটছেলে সঞ্জয় বিল্টু ও গুনগুনের বাবা, তারা শিলিগুড়িতে থাকে বললে, – তুমি রসুলকে পাঁচ টাকা দিতে চেয়েছ? সে গজ গজ করতে করতে বেরোচ্ছিল। বলছিল, এ বাড়িতে আর কাজ করতে আসবে না। তুমি এ তল্লাটের নাম করা উকিল ছিলে। সবাই তোমাকে দরাজ হাতের মানুষ বলে জানত।
লুচির থালা নিয়ে কখন ওদের মা শান্তিময়ী এসে হাজির, – সে দিন আর নেই রে খোকা। তোদের বাবা এখন কেস পায় না। গরু হারানোর কেস-এ লড়ে আবার হেরেও যায়।
– না না খোকা, কেসটা আমিই জিতেছি।
– ও মা, ও বাবা, কেসটা কি তা তো বলবে?
গুনগুন শুনতে শুনতে দেখতে দেখতে কিছুটা বুঝতে পেরেছে । আর সমস্যাটা তো তাকেও ঘিরে রেখেছে।
– আই নো, আই নো। আমি জানি, আমি বলব ?
কবি একমনে লুচি তরকারি খাচ্ছিল। তার প্রিয় খাদ্য লুচি। আর সঙ্গে আলুর তরকারি, বেগুন ভাজা। গুনগুনের দিকে তাকিয়ে মুখে লুচি নিয়ে প্রায় ধমকে বলল, – তুই বোস গুনগুনি। মাথায় মারব চাট্টি।
– না, মা গুনগুন। তুমি যদি পার তবে অল্প করে গুছিয়ে বল। তোমার কথা বুঝতে আমার কোন অসুবিধা হবে না।
বাবার আশ্বাস পেয়ে গুনগুন ঘটনাটা বলল। স্কুলে যেমন মিস জিজ্ঞেস করলে তার উত্তর দিতে হয়। সাম্প্রতিক ঘটনার বিক্ষিপ্ত টুকরো টুকরো অংশগুলো যতটা শুনেছে বুঝেছে সে ততটাই বলল। সবাই শুনল।
– কমলা দিদির গরু লালমনির দুধ ঠাম্মার বাড়িতে রোজ আসে। একদিন সেই দুষ্টু লালমনি পাশের পাড়ার এক চাষির ক্ষেতে ঢুকে সব্জি শাক সব খেয়ে ফেলে আর নষ্ট করে। তারা লালমনিকে খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে দেয় । তখন দাদু কমলা দিদির হয়ে ঐ লোকটার নামে কোর্টে কেস করে। দাদু জিতে যায় কিন্তু কোর্ট মহালয়া থেকে ছুটি পড়ে যাওয়ার কারণে লালমনিকে ছাড়াতে পারেনি। সে এখনও খোঁয়াড়ে। আর খোঁয়াড়ের মালিক আনারুল লালমনির দুধ দুয়ে নিয়ে তার নাতিকে খাওয়াচ্ছে। আর আমরা পাউডার মিল্ক খাচ্ছি।
– মি লর্ড, আমার কিছু বক্তব্য আছে। বিজয়বাবু হাত তুলে অনুমতি চাইলেন।
গুনগুনের বাবা সঞ্জয় চেয়ারে আসীন জজের মত বলল, – বলুন মিঃ বিজয়কৃষ্ণ। আপনার বক্তব্য।
– শোন বাবা। আমার এখনও কোর্টে নামডাক কিছু কমেনি।বিজয় উকিলের খোঁজে এখনও দূরদূরান্ত থেকে কাছারিতে আসে। এ তোমার মায়ের উস্কানিতে হয়েছে ।
– অবজেকশন, মি লর্ড। ‘ উস্কানি ‘কথাটা ইনঅ্যাপ্রোপিয়েট। একজন সম্ভ্রান্ত মহিলা সম্পর্কে এটা বলা যায় না।
– সরি মি লর্ড। এর থেকে ভালো শব্দ আর হয় না এই ব্যাপারটা বোঝাতে। তবু আমি অন্য ভাবে চেষ্টা করছি। উনি বললেন নবীনের ক্ষেতের সব্জি শাক সব নষ্ট করেছে, খেয়েছে। তাই বলে নবীন কাপালি লালমনির দুধ দুয়ে নেবে, আবার খোঁয়াড়েও দেবে? তুমি কি উকিল, এর বিহিত করতে পারো না? দিস ইজ প্রোভোকেশন।
-তারপর কি হল?
– আমি একটা মামলা রুজু করলাম কমলার হয়ে। কেস উঠলে জজের ঘরে বললাম, লালমনির কি দোষ মি লর্ড? কারো ক্ষেতে যদি বড় বড় বেগুন লাউ কলার কাঁধি এমন লোভনীয় ভাবে ঝুলে থাকে সেখানে অবলা জীবের কি করার আছে ? জজ বুজলেন। আমি কেস ভারি করার জন্য আন্দাজ করে একটা অ্যালিগেশন আনলাম, নবীন লালমনির দুধ দুয়ে নিয়েছে। এটা অন্যায় লালমনি তো চুরি করেনি বরং নবীন করেছে চুরি ।
-তারপর?
– নবীন কাপালি কাঠ গড়ায় উঠে কাঁপতে কাঁপতে বলল, হুঁজুর ক্ষমা করবেন। আমি বোষ্টুম মানুষ কৃষ্ণ সেবা করি। কেষ্টর জীবের কুকর্মে কি অন্যায় হয়? তবে আমি ঐ গরুটাকে দড়ি ধরে আনারুলের কাছে জমা দিতে যাচ্ছিলাম, এই ভেবে যে যার গরু হারিয়েছে ওখানে খুঁজতে গেলে সহজে পেয়ে যাবে।
– এ তো ঠিকই, বৈষ্ণবীয় কথা।
– না মি লর্ড, ঘর থেকে হাঁক পেড়ে বোষ্টুমী বললে, আমার বোষ্টুমী আবার একটু রগচটা মুখরা কথায় কথায় আমাকে বাপ তুলে গাল দেয়, বললে চা প্রসাদ হবে, ঘরে এক ফোঁটা দুধ নেই। এক ঘটি দুধ দুয়ে নাও। কেউ বুঝতে পারবে না। অন্যায় করে ফেলেছি স্যার। এক পোয়া দুধ দুয়ে নিয়েছিলাম। এই নাকে খৎ দিচ্ছি।
জজ ব্যাপারটায় কোন অন্যায় খুঁজে পাননি। দুধ না হলে বোষ্টুমীর চা হবেই কি করে?
চায়ের কথা উঠতে জজ সাহেবে খুব চা তেষ্টা পেয়ে গেল। সকালে ঘুম থেকে দেরি করে ওঠাতে গিন্নী খুব মুখ করল, বললে, – কোর্টে গিয়ে চা খেয়ে নিও। আজ বাড়িতে চা হবে না।
কোর্টে এসে এখনও অবধি চা খাওয়া হয় নি। তবু যদি গিন্নী জানতে পারত কি কারণে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হল। ফিক ফিক করে সাহেব হেসে ফেললেন। কেউ দেখে ফেললে আবার পাগল ভাববে।
কাল রাতে এক গোছা পুরোনো শুকতারা খুঁজে পেয়ে মহানন্দে বাঁটুল দা গ্রেট, নন্টে ফন্টে, টারজান আর ভূতের গল্প শেষ রাত অবধি পড়েছেন। এখন তাঁর একটু ঝিমুনি আসছে।
জজ নবীনকে দুধের দাম মিটিয়ে দিতে বললেন। আর আনারুলকে অর্ডার করলেন , লালমুনিকে ছেড়ে দেবার জন্য। কোর্টের লিখিত অর্ডার দিলেন। কমলা তো ছিল কোর্টে। ওর হাতে তো অর্ডার দিয়ে দিল।
বাজখাঁই গলায় পারিবারিক এজলাসে এসে শান্তিময়ী যেন বিপক্ষের উকিলের থেকেও বেশি জেরা করতে লাগলে। – না না অর্ডার হলেও, উনি আটকে রাখলেন। পেস্কার, কেরানি এদেরকে বলে দেরী করে অর্ডার হাতে দিলেন।
– এ তো ভারি অন্যায়, উকিলবাবু কোর্টে ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়েছে?
– কেন খাটিয়েছে সেটা জানলে তোদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাবে।
– কেন মিসেস শান্তিময়ী, আপনি নির্ভয়ে বলুন।
শান্তিময়ী আবার চিৎকার করে বললেন, – আমি আবার কাকে ভয় করব? কমলি এদিকে আয় তো, কি হয়েছিল সেদিন, বল ?
কমলা মায়ের বলে বলিয়ান হয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল। হাতের বাটিতে নারকেলের কুচি দেয়া ঘন ছোলার ডাল।
কবির থালায় আধ হাতা নামিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, – বল কমলা। যা সত্যি তাই বল।
কমলা বলল,- কোর্টে খুব হাসাহাসি হচ্ছিল। গরু অপহরণের কেস বলে। আর কেস ফয়সালা হয়ে গেলে, একটু সাইডে ডেকে নিয়ে বাবু বললে, ‘ দেখ কমলা অন্য উকিল ধরলেও তো তোর টাকা লাগত। আমার অর্ধেক ফিজ তুই দে, তালেই হবে। ডাক্তার উকিলের ফিজ মারতে নেই ‘।
– তখন আমি বাড়ি ফিরে এসে নক্ষ্মীর ভান্ডার ভেঙে টাকা নিয়ে তাড়াতাড়ি গিয়ে বাবুকে টাকা দিতে গিয়ে দেখি কোর্টের লেখা জোকা করার লোকজন সব উঠে পড়েছে। কোর্টের কাজ আবার সেই নক্ষ্মী পূজোর পর।
এতটা বলে কমলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল,- সেই থেকে আমার লালমুনি সেই খোঁয়াড়েই রয়েছে।
– মিঃ বিজয়কৃষ্ণ বাবু আপনি সামান্য কয়েকটা টাকা ফিজের জন্য একটা অবলার ছাড়পত্র আটকে দিলেন। এ ব্যাপারে আপনার কিছু বলার আছে?
– মি লর্ড। এটা আমার অজান্তেই হয়েছে? হ্যাঁ আমি ফিজটা চেয়েছিলাম বটে। আমার গুরুর দিব্যি। গুরু বলতেন , বিজয় দু’ পয়সা হলেও নিবি। কখনও বিনে পয়সার কেস লড়বি না। ‘
– নাও,এবার পাউডার দুধের চা খাও। আবার বলে কিনা চায়ের টেষ্ট ভালো হচ্ছে না। কমলি তুই কি দুধে চা বানাচ্ছিস?
কমলা, তার লালমুনি,কোর্ট কেস শান্তিময়ীর উস্কানি এবং বিজয়কৃষ্ণ উকিলের গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা, পেশার প্রতি সম্মান সব মিলিয়ে একটা ঘোরতর জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
আরো একখানা ডাল মেশানো লুচি মুখে পুরে কবি বলল, – দাদুর বড় বিপদ, কঠিন সমস্যা। বলে সে চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগ দিল।
– গুনগুনি, আপনি কি জানেন? কবি শেখর কি বলছেন? সমস্যাটা কি উকিল সাহেবের?
– দাদুর সিন্দুকে অনেক টাকা, লক্ষ্মী পূজোর সব ইউটেনসিলস্
ও সেখানে । বাট চাবি লষ্ট। দাদুর নো পাইস ইন হ্যান্ডস। সো হি ইজ পুওর নাউ।
সন্তানদ্বয় এতক্ষণে বুঝল বাবার সমস্যা। তারা তো এটাই জেনে এসেছে পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে। বিজয় বাবুর তো পসার কমার কথা নয় ।
সঞ্জয় বলল,- মিঃ বিজয় কৃষ্ণ, আপনার আর কি কিছু বলার আছে?
– আমার চাবি তো আমার ঘরে বালিশের নীচে থাকে। সেখানেই এযাবৎ কাল থেকে এসেছে। বাইরের লোক বলতে শুধু কমলি সে ঘরে ঢোকে বিছানা পরিপাটি করার জন্য। আর তো কেউ আমার ঘরে ঢোকে না।
– মুখ সামলে কথা বল। সে বাইরের মেয়ে। তা বলে চোর নয়। এমনিতেই তার মনটা বড্ড খারাপ লালমনির কারণে।
জজ ভয়ে কোন উচ্চ বাচ্চ করতে পারল না। সবাই চুপচাপ। এর মধ্যে লঙ্কাকান্ড করে বসল বিল্টু আর কবির পোষ্যরা। ক্যাঁচোর ম্যাচোর করতে করতে বানরছানা আর ময়না একটা কিছু কাড়াকাড়ি করতে করতে টেবিলের ওপর দুটোই আছড়ে পড়ল। আর টেবিলের ওপরে একগোছা ভারি কিছু পড়লে যেমন শব্দ হয় তেমনি শব্দ হল।
শান্তময়ী মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে নিয়ে বিড় বিড় করতে লাগলেন, – অলপ্পেয়ে দুটো গুদোম ঘরের কাছে ঘুর ঘুর করছিল। কি করে যে এরা নজর করে?
মাল সরিয়ে তিনি যে এই গুদাম মত ঘরটাতে লুকিয়ে চাবি গোছাখানা পেরেকে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। এই বাঁদর আর ময়না মিলে সেটাকে এখানে নিয়ে এসেছে।
বিজয় কৃষ্ণের মুখে হাসি ফুটল। পরম যত্নে চাবির গোছাখানা নিয়ে আদর করতে লাগলেন। – পেয়েছি, পেয়েছি এই যে আমার চাবির গোছা।
শান্তিময়ী গট গট করে রান্নাঘরের দিকে বেরিয়ে গেলেন।
হেঁকে বললেন বিজয়বাবু, – এই দেখ গিন্নী আমার চাবি পেয়েছি। তোমার বাসন কোসন সব বার করে দিচ্ছি । এই নাও রসুলের বাকি পাঁচ টাকা।
আবার শান্তিময়ী ঘুরে এলেন।
– বোস এখানে। এই নাও কমলা ঘিয়ে ভাজা লুচি করেছে। লালমনির দুধের থেকে তৈরি ঘি। তোমার প্রিয় খাবার। তবে দশটার বেশি খাবে না। এই নাও।
– ঠিক আছে, ঠিক আছে। আগে সব বাকি পত্র মিটিয়ে দিই। তারপর জমিয়ে খাব।
বিজয় কৃষ্ণ উকিল আসলে গেলেন সিন্দুকখানা চেক করে নিতে। সব ঠিক আছে কিনা।
– কমলার টাকাটা নিয়ে এস। ফেরৎ দাও। না হলে এ থালা নিয়ে আমি চললাম।
– আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। খিদেও পেয়েছে খুব। খোকা তোরাও শুরু কর।
– বাবা এই কমলার বদলে তোমার একটা মেয়ে যদি এই সমস্যায় পড়ত । তুমি কি তার কাছে পয়সা নিতে?
ইনি গুনগুন ও বিল্টুর মা। কলেজে পড়া মেয়ে। তাকে সায় দিল বড় বৌমা।- ও তো ঠিকই বলেছে বাবা।
মনটা খুশিতে ভরে গেল বিজয় বাবুর। দলিল দস্তাবেজ টাকা পয়সা পূজোর বাসন সব ঠিক আছে। হাত ধূয়ে জম্পেশ করে টেবিলে লুচি ভর্তি কাঁসার থালার সামনে বসলেন। তিনি ভোজন রসিক। একখানা লুচি মুখে দিয়ে বললেন, – আঃ কি সুগন্ধ গাওয়া ঘি। মাত্র দশটা? আমি তো এক দিস্তে খেতাম এক সময়। এই নাও কমলার টাকা ,এখনই দিয়ে দাও গিন্নি। বড় ভালো মেয়ে গো কমলি ।
সবাই প্রায় টেবিল ঘিরে কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে। ছোটরা ঠাকমা দাদুর আশে পাশে। তৃপ্তির একটা ঢেকুর তুলে উকিল বাবু বললেন, – একটা গল্প বলি শোন।
– দাদু গল্প, দারুণ গল্প বল।
– গল্প হলেও সত্যি। শোন তবে। শহরের বড় ডাক্তার দেবেন সেন। সে আমলের বিলেত ফেরৎ। চরম ব্যস্ত মানুষ। নিজের চেম্বার, সরকারি হাসপাতালের আউটডোরের রুগী, ওয়ার্ডে ভর্তি রুগী এসব নিয়ে তার দিন কাটে । শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার ফুরসৎ নেই। একবার শালাবাবু এসে তার দিদিকে নিয়ে গেছে বাপের বাড়িতে। সে কয়েকদিন থাকবে। তা সেখানে গিয়ে ডাক্তার গিন্নির প্রবল জ্বর। স্থানীয় ডাক্তার বদ্যি এলোপ্যাথি হোমিওপ্যাথি কবিরাজি সব ফেল। মেয়ের বাবা জামাইকে যমের মত ভয় পায়। তাই খবরাখবর কিছু দেন নি। রুগী যখন রোগভোগে বেশ ক্লান্ত। তখন শালাবাবু গিয়ে ডাক্তার দেবেন সেনকে সব বলল।
তার সরকারি হাসপাতালের কোয়ার্টারের চারপাশে তখন রুগীর ছড়াছড়ি। বসতে বললেন। তারপর সব রুগী দেখা হয়ে গেলে বললেন, – চল। দেখেই আসি। ড্রাইভারকে ডাক। ঐ গাছতলায় দাঁড়িয়ে।
রুগীর বাড়িতে গিয়ে রুগী দেখলেন সব কথা শুনলেন। শাশুড়ি মা বললেন, – বাবা একটু চা করি? আর রাতের খাওয়া খেয়ে যাও।
– আমাকে এখন গিয়ে হাসপাতালে রাউন্ড দিতে হবে। আর আমি রুগী দেখতে গিয়ে কোথাও চা বিস্কুট খাই না আমার একটু তাড়া আছে।
গাড়িতে উঠে আরো একটু অপেক্ষা করে বললেন, – এখন আমি একাই ফেরৎ যেতে পারব। কারো আর যাওয়ার দরকার নেই।
কেউ যখন তার ফিজ-এর কথা তুলছে না তখন ডাঃ সেন নিজেই বললেন, – চেম্বারে আমার ফিজ তিরিশ টাকা। আর বাড়িতে কল্- এ গেলে একশ টাকা।
শান্তিময়ী শুনছিলেন এবং প্রথমে তিনি হৈ হৈ করে বললেন,
– এসব গল্প কথা, রাখো। তুমি কমলার টাকা ফেরৎ দাও। এবার সমস্বরে সবাই বলল, দাও এখনই ফেরৎ দাও। দিলেন তিনি ফেরৎ।
দ্বিপ্রাহরিক আহারদি মন্দ হল না। নারকেল গাছ থেকে ফল পেড়েছিল রসুল, সে এল। তাকে পুরো পয়সা মিটিয়ে দেয়া হলে সে খুশি হয়ে পুকুরে নেমে জাল টেনে দিল। গোটা কয়েক পাকা রুই কাৎলা তোলা হল।
রসুল দুপুরে ভরপেট খেয়ে একটু গড়িয়ে নিল। যাওয়ার সময় পেন্নাম করে বলল, – বাবু আমাদের ভগমান তুল্য লোক।
ছুটি না থাকলে বিজয় বাবু দুপুরে শোন না। আজ খাওয়াটাও খাসা হয়েছে। এবার একটা ছোট্ট নিদ্রা। উঁচু পালঙ্কে বিছানা গোছাচ্ছিলেন শোওয়ার তোড়জোড় হিসাবে। এমন সময় দলবল নিয়ে তাঁর দু সন্তান এসে হাজির।সে দলে কেউ বাদ নেই। এমনকি গিন্নী শান্তিময়ী ও হাজির।
– বাবা তুমি কি এখন শোবে ?
– তা একটু গড়িয়ে নেব।
– না তা হবে না। তোমার সমস্যার সমাধান হল। এবার আমাদের দিকটায় নজর দাও। কমলা কাঁদছে, গুনগুন দুধ পান করে তৃপ্ত হচ্ছে না, তোমার চায়ের টেষ্ট অন্য রকম লাগছে, মায়ের মাথা গরম। সব তো সেই লালমনির জন্য। চল একবার থানার বড়বাবুর কাছে। কিছু একটা করি।
– বড়বাবু লোকটা সুবিধার নয়। আমার সাথে এজলাসে মাঝে মাঝে কথা কাটাকাটি হয়। কোন রিপোর্ট ঠিক মত জমা করে না। জজ ওকে ধমক লাগায়। আর ও উল্টে আমাকে মুখ করে।
– তবুও চল। তুমি লালমনির হয়ে লড়েছ। তার নথি নিয়ে চল।
বেশি দূর নয় একটা গ্রাম পেরিয়ে থানার মোড়। চেয়ারে বসে বিকেলে বড়বাবু সুকান্ত কুন্ডু ঝিমোচ্ছিলেন। অনেক স্টাফ ছুটিতে আছে। চুরি চামারি খুন রাহাজানি বিশেষ হয় না। তাই থানা চত্বর একটু শান্তশিষ্ট। টেবিলে একটা পূজাবার্ষিকী আধখোলা অবস্থায় পড়ে আছে। দলবল গেট দিয়ে থানা চত্বরে ঢুকছে দেখে বড়বাবু একটু সতর্ক হলেন। কোমরের মোটা বেল্টটা টাইট দিলেন। আর টেবিলে রাখা ক্রিং ক্রিং ঘন্টিটা বাজালেন। দপ্তরির ডিউটিতে যে আছে সে বোধ হয় কোয়ার্টারে গেছে।
এই দলটির মধ্যে কালো কোট পরা লোটকাকে চেনা চেনা লাগছে। ত্যাঁদোড় লোক। কোর্টে হেভি কুটকচালি করে। নামটা মনে পড়েছে, বিজয়কৃষ্ণ দত্ত। মহকুমা কোর্টের উকিল। কে না জান উকিল আর পুলিশের সম্পর্ক সবসময় আদা-য় আর কাঁচ-কলায় হয়।
– মে আই কাম ইন স্যার ?
– আরে! বিভাস তুই এখানে, কি ব্যাপার ?
– আমি তো আগে থেকে জানি তুই এখানে পোষ্টেড । সেই শিলিগুড়ি কলেজ ছাড়ার পর আর দেখা হয় নি।
– সদলবলে কেন? এনাকে কোথায় পেলি? উকিল মোক্তার জজ টাইপের লোকগুলো আমার দু’ চক্ষের বিষ। কোন কাজ করতে দেয় না, শুধু ভ্যাজোর ভ্যাজোর করে।
– উনি আমার বাবা।
– আগে বলবি তো। বসুন বসুন মেসোমশাই। না সবাই খারাপ তেমন নয়।
গোল হয়ে টেবিলের চারপাশে সবাই বসে ও দাঁড়িয়ে। উকিলের প্রতি অ্যালার্জি আছে বলে, দাদুর হয়ে গুনগুন কেসটা প্রেজেন্ট করল। জলের মত পরিষ্কার। শান্তিময়ীর হাঁটুতে ব্যথা।
বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লেন।
– এ আর এমন কি কাজ? ওসব কাগজ-ফাগজ লাগবে না। চল আনারুলের খোঁয়াড়ে।
– বাবা একটা কিছু বিহিত কর। ঠিকই বলেছ। উকিল মোক্তাররা লোক ভালো হয় না। সারা জীবন বয়ে বেড়াচ্ছি।
বৌমারা সমস্বরে বলে উঠল, – মা,আপনি থামুন।
এতক্ষণে দপ্তরি এসে হাজির।
– বাগ বাবু দেখুন তো ড্রাইভার সামসুল কোথায়? ডেকে নিয়ে আসুন ।
কাঁঠাল তলায় খাটিয়া পেতে সামসুল ঘুমিয়ে ছিল। তাকে ঠেলে তুলে বাগবাবু রেডি হতে বলল, গাড়ি বেরোবে।
গাড়ি বেরোল একসঙ্গে। বিজয় উকিল বাহিনীর গাড়ি আর থানার গাড়ি। পাকা রাস্তা থেকে নেমে তাও আধ মাইলটাক যেতে হবে। রাস্তার দু’ ধারে বড় বড় গাছ,ঝোপঝাড়, জঙ্গল। সেখানেই আনারুলের বাড়ি আর তার সাথে খোঁয়াড়। টিনের চাল দেয়া চারচালা বাড়ি। আর টিন দিয়ে ঘেরা খোঁয়াড়ের জায়গা।
গাড়ির শব্দে আনারুল ঘেরা বেড়ার বাইরে এসে বড়বাবুকে দেখে চমকে গেল। তার কি করণীয় সেটাই ভুলে গেল। সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করার উদ্দেশ্যে হাতের বালতিটা মাটিতে রেখে লুঙ্গি নামিয়ে নিল। বালতিতে ফেনা ওঠা দুধ।
শান্তিময়ী বাজখাঁই গলায় বলল, – দেখ দারোগা বাবু। লালমনির দুধ দুয়ে নিচ্ছে।
ভয়ে কুঁকড়ে সে আগে শান্তিময়ীর পায়ে সাষ্টাঙ্গ হল।
– ভুল হয়ে গেছে গো, এ আপনাদের চা বানানর লগে দুইছি।
– ব্যাটা মিথ্যেবাদি। দেখছিস লালমনির মালিক কমলা চলে এসেছে। নিয়ে আয় এদের হাতে তুলে দে।
বেড়ার ভিতরে হাম্বা হাম্বা ডাকে কমলা বুঝল লালমনি কিছু বলছে। সে এক ছুটে সেদিকে চলে গেল।
– বড়বাবু এই যে কোর্টের অর্ডার।
– রাখুন মেশোমশাই। এখানে আমার কথাই কোর্টের অর্ডার।
পছন্দ হল না কথাটা বিজয়বাবুর। তবে হজম করে নিলেন। বেশিক্ষণ লাগল না। চোখের জলে আনারুল লালমনিকে তুলে দিল কমলার হাতে। আনারুল স্বীকার করল সে রোজ দুধ দুয়ে নাতিকে খাওয়াচ্ছিল। তাছাড়া লালমনি বড় লক্ষ্মী গরু। এতদিনে মাত্র দু’টো ঠুঁসো তাকে দিয়েছে। চুরি করা অন্যায় তবু লোভ সামলাতে পারেনি।
আনারুলের বউ সবাইকে ঘন দুধের চা খাওয়াল।
জোর চুমুক দিয়ে বিজয় কৃষ্ণ একটা তৃপ্তির আওয়াজ করলেন মুখে। – আঃ! বেশ চা হয়েছে।
লালমনি অনেকদিন পর কমলাকে পেয়ে তার গায়ে গিয়ে মুখ ঘসতে লাগল। যেন সে তার হারনো মাকে অনেকদিন পর কাছে পেয়েছে।
মিছিলের সামনে কমলা আর লালমনি। লালমনির দড়িটা ধরে রেখেছে আনারুল। তাকে অনুসরণ করে চলেছে সবাই। বড়বাবু অবধি গাড়িতে না উঠে কিছুটা হেঁটে এগিয়ে এলেন।
শান্তিময়ী এখন শান্ত হয়েছেন। বড়বাবু বিদায় নেওয়ার সময় সৌজন্য বোধে বললেন,- আমি একটু এগিয়ে যাই মাসিমা?
– যাও বাবা। তবে একটা কথা যদি রাখো ?
– বলুন।
-রাতে যদি সময় করতে পারো এসো,তোমার মেসোমশাই আজ পুকুর থেকে অনেকগুলো পাকা রুই কাতলা তুলেছে। কি করে যে শেষ হবে?
হাসতে হাসতে বড়বাবু বললেন, – চেষ্টা করব। চলি বিভাস।
(শেষ)