১.
বাংলার সবচেয়ে নামী সাহিত্য পত্রিকার চারটি গল্প পরপর পড়ে রামতনু বাবুর মনে হল বাংলা সাহিত্য উচ্ছন্নে যাচ্ছে। চারটি গল্পের প্রথমটির বিষয় বস্তু দুই বুড়ো- বুড়ির পরকীয়া। দ্বিতীয়টির বিষয় বস্তু সমকাম। সেই গল্পটি বটতলার যে কোনও রগরগে গল্পকে পেছনে ফেলে দেবে। তৃতীয় গল্পটি এক আধপাগলা বড়োলোকের আঁতলামো পরিপূর্ণ আত্মচরিত। সে গল্পটি রামতনু বাবুর মাথার উপর দিয়ে গেছে। শেষ গল্পটি ফেসবুকের মিথ্যে প্রোফাইল খোলা এক বিকৃত মস্তিষ্ক ব্যক্তিকে নিয়ে।
রামতনু বাবুর বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে অগাধ জ্ঞান। বিশেষ করে তিনি ছোটো গল্পের পোকা। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সকলের লেখাই তিনি পড়েছেন। তাঁদের গল্পে মানবিক আবেদন ছিল। গ্রাম গঞ্জের বাস্তব চিত্র উঠে আসত। মানুষের অনেক কাছাকাছি থেকে সেসব লেখায় সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখের কথা থাকত। রামতনু বাবু নিজেও গল্প লেখেন। দু একটা পত্র পত্রিকায় সেই গল্প ছাপাও হয়। তিনি দরদি মন দিয়ে পিছিয়ে পরা, সর্বহারা মানুষদের কথা তাঁর লেখায় তুলে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু বুঝতে পারেন কোথাও একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। জন্ম থেকেই শহরের মানুষ তিনি। বাড়ির কাছাকাছি একটা হাই স্কুলের ইংরাজির শিক্ষক। কলেজে পড়ার সময় দু- একবার কলকাতার কাছাকাছি কোনও গ্রামে পিকনিক করতে গেছেন। অথবা দূরে কোথাও যাওয়ার সময় ট্রেনের জানলা দিয়ে গ্রামের দৃশ্য দেখেছেন। গ্রাম দেখার অভিজ্ঞতা বলতে এটুকুই সম্বল। বাদবাকি গ্রাম অথবা গ্রামের দরিদ্র মানুষ সম্বন্ধে তাঁর ধারণা সবই বই পড়ে।
রামতনু বাবু পত্রিকাটি বন্ধ করে ফোন করলেন তাঁর এক সাহিত্যিক বন্ধুকে। – তরুণ, তুই কি খেয়াল করেছিস বাংলা সাহিত্যের অন্তিম দশা উপস্থিত।
-সাতসকালে হঠ্যাৎ করে তোর এই বোধোদয়ের কারণ কি?
-তুই ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকার এই সংখ্যার গল্প গুলি পড়েছিস। একটাও গল্প হয়নি। যত সব রাবিশ। জোড় করে বানিয়ে বানিয়ে লেখা। আঁতলামো আর যৌনতা ছাড়া আর কিছু নেই। যে সব বিষয় বস্তু নিয়ে লেখা সেগুলো প্রায় ক্লিশে হয়ে গেছে। যে কোনও পত্র পত্রিকা খুললে এই বিষয়গুলি নিয়ে একাধিক গল্প চোখে পড়বে। এরকম চলতে থাকলে তো পাঠকেরা বাংলা সাহিত্য পড়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে।
-তুই ঠিকই বলেছিস। তাই এবার আমি একটা সম্পূর্ণ নতুন বিষয় নিয়ে লেখা লিখি করার চিন্তা করছি।
-কি বিষয়?
-ট্রান্স জেন্ডার, অর্থাৎ রূপান্তর কামী মানুষ। এই নিয়ে এখোনো বিশেষ কেউ লেখালিখি করেননি। দেখবি এবারের পুজো সংখ্যায় এমন একটা সাহসী উপন্যাস নামাবো, যে চারদিকে হইচই পড়ে যাবে।
ফোন কেটে দিলেন রামতনু বাবু। তিনি বুঝতে পারছেন কেউ তাঁর মতো করে ভাবছে না। সবাই সহজে বিখ্যাত হওয়ার রাস্তা খুঁজছে। আর ছোটো গল্প কি সার্কাস নাকি, যে এত সাহস, এত নতুনত্ব তার মধ্যে ঠেসে দিতে হবে? বিভূতিভূষণ গল্পের পর গল্পে শুনিয়ে গেছেন গ্রাম বাংলার আটপৌরে জীবনের কথা। কই, কখনও তো একঘেঁয়ে লাগেনি।
তিনি ঠিক করলেন, আর কেউ না লিখুন, তিনিই লিখবেন সাধারণ মানুষের গল্প। খেটে খাওয়া মানুষের গল্প। বাংলার সবুজ গ্রামগুলির গল্প।
কিন্তু তার আগে গ্রামকে জানতে হবে। গ্রামের মানুষের সাথে মিশতে হবে। তাদের প্রাচুর্য হীন, অনাড়ম্বর জীবনযাত্রার সাথে একাত্ম হতে হবে।
২.
বাসটা যেখানে নামিয়ে দিয়ে গেল, তার ধারে কাছে একটা চায়ের দোকানও চোখে পড়ল না রামতনুবাবুর। রাস্তার দু পাশে ধু ধু ধান ক্ষেত। এমন সত্যিকারের গ্রাম এখনও বাংলায় আছে!
মনটা খুশি হয়ে উঠল রামতনু বাবুর। ভালো গল্প উপন্যাস লিখতে হলে পরিশ্রম করতে হয়। ”তিতাস একটি নদীর নাম” লেখার জন্য মাঝিদের সাথে দিনের পর দিন কাটাতে হয়। বিবেকানন্দ সেই কবে বলে গেছেন ফাঁকি দিয়ে কোনও মহৎ কাজ হয়না। ফ্ল্যাটের খুপরিতে বসে এসির হাওয়ায় আর যাই হোক কালজয়ী সাহিত্য সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।
মাঠে একটি লোক কাজ করছিল। রামতনু বাবু এগিয়ে গেলেন, এই যে দাদা শুনুন।
লোকটি উঠে দাঁড়াল। রামতনু বাবুর দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, বলেন।
-এই গ্রামটার নাম কি?
-কাপাসগঞ্জ। তারপর একটু থেমে লোকটি জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি কাগজের লোক?
রামতনু বাবু একটু হাসলেন। হ্যাঁ না কিছুই বললেন না। তাঁর গলায় ঝোলানো ক্যমেরা আর ঝোলা ব্যাগ দেখে লোকটি তাঁকে রিপোর্টার ভেবেছে। তিনি বললেন, আমি তোমাদের গ্রামটা একটু দেখতে এসেছি।
-কিন্তু এখনতো ওদের কাউকে পাবেন নি। ওর বাবা, মা, দাদা বর্ধমানের কোথায় গিয়ে রইছে।
-কার বাবা মা? রামতনু বাবু অবাক হলেন।
-ঐ যে, যে মেয়েডারে রেপ করে খুন করে ফেলালো, তার কথা কইছি। বাড়িটা বন্ধ পড়ি আছে। সোজা ও করে হেঁটে যান, দেখা পাবেন।
রামতনুবাবু অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। এতো গ্রামে পা দিতে না দিতেই গল্পের প্লট এসে হাজির।
৩.
তিনি মোরামের রাস্তা ধরে হাটছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে চারিদিকের দৃশ্য, গাছপালা, পাখি সব মনের গভীরে গেঁথে নিচ্ছিলেন। গল্প লেখার সময় তিনি শুধু সত্যিটাই লিখবেন।
ভট ভট করতে করতে একটা সাইলেন্সর খোলা মোটর সাইকেল রামতনুবাবুর পাশে এসে দাঁড়াল। দুটি যুবক মোটর সাইকেল থেকে নামল। একজন বলল- কোন কাগজ?
-মানে?
-আপনি কোন কাগজের রিপোর্টার?
-ইয়ে, আমি সাংবাদিক নই, আমি একজন লেখক মানে রাইটার।
-কাগজে লেখা লিখি করেন তো, ঐ একই হল। যাকে বাংলায় রিপোর্টার বলে তাকেই ইংরাজীতে রাইটার বলে। নিন, বাইকে উঠুন।
-বাইকে কেন উঠব?
-আপনি বাইরের মানুষ। একা একা গ্রামে ঘুরে বেড়ালে বিপদ আপদ হতে পারে। গ্রামের ছেলে হিসাবে আমাদের কর্তব্য আপনি যাতে বিপদে না পড়েন সেটা দেখা।
-ইয়ে আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। বেশ হেঁটে হেঁটে…
-ভ্যানতাড়া না করে শিগগিরি বাইকে উঠুন। না হলে জোর করে ওঠাতে হবে।
ছেলেদুটির চোখের দিকে তাকিয়ে তাদের কথা অমান্য করতে পারলেন না রামতনু বাবু। তিনি ছাগলের তৃতীয় সন্তান হয়ে কোনোমতে বাইকে উঠলেন।
৪.
পার্টি অফিসের ভেতর রামতনুবাবুকে ঘিরে আটজন যুবক। রামতনু বাবু ঘেমে উঠেছেন। বুকটাও ধড়ফড় করছে। সকালে প্রেশারের ওষুধটা খেয়েছেন কিনা সেটাও মনে পড়ছে না।
একজন নেতা গোছের ছেলে এগিয়ে এল। বলল, আপনি কোন কাগজের?
রামতনুবাবুর বললেন, ইয়ে আমি গল্প লিখি, রিপোর্টার নই।
-ওখানে কি করছিলেন? অতসী মাহাতোর বাড়ি খুঁজছিলেন কেন?
আমি কারো বাড়ি খুঁজিনি বাবা। মা কালীর দিব্যি বলছি। বুদ্ধিজীবীদের আলোচনা সভায় নিজেকে নাস্তিক দাবী করা রামতনু বাবু বিপদ থেকে বাঁচতে মা কালীর আশ্রয় নিলেন। বললেন, আমি এসেছিলাম গ্রাম দেখতে, গ্রামের সমাজ ব্যবস্থা সম্বন্ধে কিছু তথ্য জোগার করতে। সেটা আমার পরবর্তী গল্পের কাজে লাগত।
ছেলেটি কালো দাঁত বের করে হাসল। বলল, গ্রাম সম্বন্ধে তথ্য কি আপনি গ্রামে ঘুরে ঘুরে পাবেন। এর জন্য পার্টি অফিসে আসতে হবে। নিন লিখুন, উন্নয়নের জোয়ারে গ্রাম একে্বারে ভেসে যাচ্ছে। একশো দিনের কাজ, রাস্তা তৈরী, দরিদ্রদের বাড়ি তৈরী, সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল…উন্নয়ন একেবারে রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি হল, নোট বই বার করছেন না যে? আমার কথাগুলি কি পছন্দ হচ্ছে না?
-না…না… পছন্দ হবে না কেন। বিলক্ষণ পছন্দ হচ্ছে। আমার স্মৃতিশক্তি ভাল। এ সব কথা আমার স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে থেকে যাবে।
-এবার দুটো নতুন পাঁচশর নোট বার করুন। আমাদের পার্টি ফান্ডে সামান্য সাহায্য। তারপর কেটে পড়ুন। গুলু, এনাকে বাইক করে সসম্মানে বাসস্টান্ডে পৌঁছে একেবারে বর্ধমানের বাসে তুলে দিস। দাদা, একটু ঠান্ডা খাবেন নাকি?
৫.
রামতনু বাবু লিখছেন। পারিপার্শ্বিক জগত থেকে এই মুহূর্তে একেবারে বিচ্ছিন্ন। হঠাৎ ফোনের শব্দে তাঁর ঘোর কাটল।
-হ্যালো, কে তরুণ? নতুন গল্প লিখছি। অত্যন্ত সাহসী বিষয়। কাজ দেওয়ার নাম করে বিদেশে বাঙালী মেয়েদের নিয়ে গিয়ে তাদের উপর কি রকম অত্যাচার করা হয়, তাই নিয়ে। অনেকের মুখোস খুলে দেব এই গল্পে। গল্পটা লেখার জন্য অনেক পড়াশুনোও করতে হয়েছে।
ফোন রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন রামতনুবাবু। প্রবাসী বাঙালীরা অথবা যাদের মেয়ে হারিয়ে গেছে সেইসব হতভাগ্য মানুষেরা নিশ্চয়ই এইসব সাহিত্য পত্রিকা খুলেও দেখেন না।
(ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।)