বইপড়ার যুগে মানুষ হয়েছে বলেই বোধহয় আমার বন্ধুরা নিয়মিত বইমেলায় যায়। বই-টই কেনেও, এবং, সেলিব্রিটি আঁতেলদের দুশ্চিন্তায় ছাই দিয়ে, পড়েও বটে। হ্যাঁ, সব কাফকা নয়, দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির নভেল, গল্প — ভূত, ডিটেকটিভ, রহস্য, রম্যরচনার বই-ই বেশি — এমনকি প্রবন্ধ বা কবিতাও হয়ত নয়। দয়াপরবশ হয়ে কেউ কেউ আমার লেখা বইও কিনেছে দেখেছি, বিশেষত আমি উপস্থিত থাকলে।
তবে এ লেখা বিষয় তারা নয়। এটা আমার তিনজন বিশিষ্ট এবং বিশেষ বন্ধুকে নিয়ে, যাঁরা বইমেলায় যে যে কারণে যান, আমার বদ্ধমূল ধারণা তার মধ্যে প্রধান হল আমার বই যে বইমেলায় পাওয়া যায় না, তা প্রমাণ করা।
প্রতি বছর, বইমেলার আগে-পরে বা বছরের অন্য সময়েও, ফেসবুক বা অন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় সুযোগ পেলেই তাঁরা আমাকে জানাতে ভোলেন না, যে আমার বই যে যে স্টলে থাকে সেই স্টলগুলো তাঁরা কোনও সময়েই খোলা পান না — সে যখনই হোক না কেন। আমি ভাবি তাঁরা আমার বই আসলে কিনতে চান না, তাই এ সব বলছেন, এক এক বার ভাবি, উপহার দেব? তারপর ভাবি, হয়ত কেবল কিনতে চান না নয়, (এমনিতে তো কিছু কম কেনেন বলে মনে হয় না, কারণ বইমেলা শেষ হলেই দুজন তিনকুড়ি বইয়ের ছবি পোস্টান মুখবইয়ে — সবই নাকি কিনেছেন, আর তৃতীয় জন সেদিন আলিগড়ী তোরঙ্গ কিনলেন, “বাড়িতে আর জায়গা হচ্ছে না, বুঝলে, এবার গ্যারেজে বই রাখব। গাড়িটা ফুটপাথেই থাকবে।)
এ বছরে দুজন অভ্যাসমতো খুব জোরদারভাবে সে নালিশ জানাতে গিয়ে কেন বইমেলায় আমার স্টল খোলা পান না, তা-ও বুঝিয়ে দিলেন।
প্রথম জন ফোন করলেন দুপুর সাড়ে বারোটায়। “অ্যাই, তোমার পাবলিশারের স্টল খোলা নেই।”
আমি তখন নিজে চেম্বারে। রুগি দেখছি। বললাম, “এরকম ক্র্যাকফ্ডনে গেলে কোন সেলফ রেসপেক্টিং প্রকাশক দোকান খুলে বসে থাকবেন, শুনি?”
তা তিনি শোনার পাত্তর নন। নিজে ভোর পাঁচটায় উঠে ব্রেকফাস্ট খাওয়া শেষ করে আটটার মধ্যে হাসপাতালে এবং নটার মধ্যে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকেন, তাই, “বারোটার সময় বইমেলা খোলার সময়, পোস্টারে লেখা আছে, সাড়ে বারোটাতেও কেন দোকান খুলবে না!” বলে চেঁচামেচি করতে শুরু করলেন। আমি যত বোঝানোর চেষ্টা করছি কেন খুলবে না, তিনি শোনেনই না। তারপর শেষে যখন আমাকে, “এক মিনিট, এক মিনিট…” বলে অন্য কাউকে বললেন, “একটা ওয়ালনাট ভ্যানিলা কোন, আর একটা বেলজিয়ান চকলেট…” তখন বুঝলাম তিনি কেন সক্কাল সক্কাল, ক্র্যাকফ্ডনে বইমেলা ঢোকেন।
খেতে।
সকালে সব ফুড স্টলেই ফেরেশ খাদ্যসামগ্রী ঢোকে, আইসক্রিমও। আইসক্রিম থাকে ঠাণ্ডায় বেশি শক্ত, সারাদিনের গরমে, আইসবক্স বার বার খোলা-বন্ধ করতে করতে নরম হয়ে যায় না।
এইজন্যই তিনি ভোর থেকে বইমেলায় ঘোরেন, বেলা বাড়ার আগে, দোকান টোকান খোলার আগে, ফ্রেশ খাবার-টাবার খেয়ে ভিড় বাড়ার আগেই কেটে পড়েন।
দ্বিতীয় জন, নিজের দাবির বোনা ফাইডিটি প্রমাণ করতে দুপুর দুটো আট মিনিটে স্টলের ছবি পাঠালেন — কল্যাপসিব্ল্ গেট বন্ধ।
আমি রেগে লিখলাম, “তোরা দক্ষিণ কলকাতার লোক ভোর না হতে কেন মেলায় আসিস? সামনে ‘বই’ লেখা থাকলেও জিনিসটা মেলা। ক্র্যাকফ্ডন থেকে বইমেলায় ঘোরাঘুরি করিস কি মর্নিং ওয়াকের জন্য?”
সে বলে, “সব স্টল খোলা। আনন্দ, পত্রভারতী, দে-জ…”
বললাম, “আরে, ওগুলো বড়ো হাউস। চারশো মাইনে করা কর্মচারী আছে দোকান খোলার জন্য। যেখানে স্ব-চালিত ছোটো ব্যবসা, নিজেকেই জু-সে-চ-পা করতে হয়, তাঁরা কেউ আগের দিন রাত আটটায় দোকান বন্ধ করে পরদিন বিকেলের আগে আসতে পারেন না। নিজে যদি অমন বিজনেস করতি, তাহলে সেদিন দুটোয় কেন, পরদিন বিকেলের আগে আগে আসতে পারতি না। করিস তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাজ। সপ্তাহে চারটে ডে অফ, দুটো ছুটি, একদিন কোনও রকমে ক্লাস-না-নিতে যেতে হয়। চারটে অবধি অপেক্ষা কর, স্টল খুলে যাবে।”
সে বলে, “আমাকে অনেক দূর যেতে হবে। সে-এ-এ-ই গোপালনগর পেরিয়ে। অতক্ষণ অপেক্ষা করলে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যাবে।”
নিজের গাড়িতে চলেন তিনি! আমি চমৎকৃত। তারপর মনে হল, শীতের দিন, বেলা গড়ায় তাড়াতাড়ি। চারটেয় বইয়ের স্টল ঘুরে পাঁচটার কাছাকাছি বেরোলে গোপালনগর পৌঁছাতে সন্ধে গড়িয়ে যাবে বইকি। তাকেই তো রাত হওয়া বলে।
বুঝলাম, এই দ্বিতীয় বন্ধুটি গ্রামীণ, তাই গ্রামের লোকেরা যেমন বেলাবেলি হাট-বাজার সেরে নেন, তেমনি ইনিও বেলাবেলি মেলার পাট চুকিয়ে বাড়ি ঢোকেন।
এবারে অপেক্ষায় আছি, তৃতীয় জন যেই বলবে, চার দিন বইমেলায় গিয়ে একদিনও তোমার প্রকাশকের স্টল খোলা পাইনি — জানতে চাইব, কটায় ঢুকেছিস, কটায় বেরিয়েছিস? যেই বলবে, বারোটায় ঢুকে সাড়ে বারোটার বেরিয়েছি, ওমনি জানতে চাইব বিকেল অবধিও ছিলি না? কেন?
তাহলেই রহস্যোদ্ধার সম্পূর্ণ হবে।