মন ভাল নেই অনিন্দিতার।
এবারের সম্বন্ধটাও ভেস্তে গেল। একেবারে শেষ মুহূর্তে। সেই একই কারণ। আর বাবার সততা। জেদ। অসুখ লুকিয়ে মেয়ের বিয়ে দেব না।
অসুখ মানে একটা সাদা দাগ। ব্যাস আর কিছু না। ডান হাঁটুর নীচে, পেছনের দিকে, অনেকটা শ্রীলঙ্কার ম্যাপের মত দেখতে একটা দুধসাদা দাগ। আগে, মানে অনিন্দিতা যখন ক্লাস সিক্সে, তখন প্রথম ধরা পড়ে অসুখটা। পিঠে। তার পর তো ছড়িয়ে গিয়েছিল হাতে, গলায়, পেটে, পায়ে। ওদের হাউজফিজিশিয়ান ডাঃ বসুই বললেন, শ্বেতী। এও বললেন, চিকিৎসায় অবশ্যই নিরাময় সম্ভব এ অসুখ। ডাঃ বসুরই পরামর্শমত দেখনো হল ডাঃ রায়চৌধুরীকে। চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ। উনিই দেখেছিলেন এতদিন। ধীরে ধীরে সেরেও উঠেছিল অনিন্দিতা। সব দাগগুলোই মিলিয়ে গিয়েছিল। কোথাও কেটে-ছিঁড়ে গেলেও আর সাদা হয়ে যেতনা, আগের মত।
শুধু এই পায়ের দাগটা। ছোট হয়ে একটা জায়গায় এসে থমকে গেল যেন অসুখটা। আর না বাড়লেও, কমলোও না। এভাবেই চলছে গত বছর দুয়েক। আর এদিকে সময় তো থেমে নেই। পল সায়েন্সে মাস্টার ডিগ্রি করার পর একটা চাকরিও জুটে গেছে ওর। কিন্তু মা-বাবার চিরন্তন ব্যস্ততা। বিয়ে দিতে হবে। মেয়ে-দেখা নামের সেই প্রাগৈতিহাসিক, অমানবিক প্রথার সামনা সামনি হতেই হল অনিন্দিতাকে। ওর আপত্তি সত্বেও।
পছন্দ যে ওকে হয় না তা নয়, হয়। কিন্তু তারপর যেই ওর পায়ের ওই না-সারা-দাগটার কথা ওঠে, পিছিয়ে যায় সব উচ্চশিক্ষিত পাত্রপক্ষই। এ গল্পটারই পুনরাবৃত্তি চলছে আজ বেশ কিছুদিন।
ক্লান্ত লাগে অনিন্দিতার রাগ হয়। বিষন্নতায় ডুবে থাকে ও। বাতিল হবার জন্য নয়, বাতিল হবার কারণটার জন্য। কেমন ছোট মনে হয় নিজেকে। রোজ হেরে যেতে থাকে মেয়েটা।
ডাঃ মৈনাক গুপ্তের ঠিকানাটা ও পেয়েছিল অফিসের এক সহকর্মীর কাছ থেকে। যাবে না যাবে না করেও একদিন গেল ওঁর চেম্বারে। ডাঃ গুপ্তও ত্বক বিশেষজ্ঞ চিকিতসক এবং একজন বিশিষ্ট স্কিন সার্জেন। ভাল করে দেখলেন ভদ্রলোক অনিন্দিতার পায়ের দাগটা। ইতিহাস্ টা শুনলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তারপর, খুব সহজ ভাবে বললেন, অত চিন্তার কি আছে? এটা তো সেরে যাবে।
-সেরে যাবে। মিলিয়ে যাবে দাগটা? খুব বড় অপারেশন? ভর্তি হতে হবে নার্সিং হোমে? অনেক খরচ হবে কি? এক ঝাঁক প্রশ্ন ছুড়ে দিল অনিন্দিতা।
হাসলেন, ডাঃ গুপ্ত। বললেন প্রথম দুটো প্রশ্নের উত্তর হল হ্যাঁ। আর পরের তিনটে প্রশ্নেরই একই উত্তর। এক কথায় না।
তারপর সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন পুরো ব্যাপারটা। অনিন্দিতার ওই না-সারা সাদা দাগটার কারন, ওখানে কোন রঞ্জক কোষ (মেলানোসাইট) নেই। থাকলেও ইনঅ্যাকটিভ। ফলে তৈরী হচ্ছে না রং। পিগমেন্ট। এই মেলানিন কণার জন্যই আমাদের ত্বকের বর্ণ, কারো বেশী, সে শ্যামবর্ণ কারো বা কম, সে ফরসা, আর যার নেই, তার অসুখ। সারা শরীরে না থাকলে অ্যালবিনিজম। সেটা জন্মগত অসুখ। আর শরীরে কোনও অংশে রং না থাকলে ভিটিলিগো (VITILIGO) বা শ্বেতী।
-আর লিউকোডার্মা? জানতে চাইল অনিন্দিতা
-ওই কথাটার অর্থ হল সাদা চামড়ার। যে কোন কারনেই হতে পারে লিউকোডার্মা। পুড়ে গিয়ে, কেমিক্যাল থেকে, অথবা অন্য কোন কারনে। লিউকোডার্মা মানেই কিন্তু শ্বেতী নয়। শ্বেতী একটা নির্দিষ্ট অসুখ, যেখানে ত্বকের বর্ণহীনতার কোন কারণ সরাসরি পাওয়া যায় না।
-ওষুধে কমে না? অনিন্দিতার আগ্রহ বাড়ছিল।
-কমে তো। তোমার তো অনেকখানিই কমে গেছে ডাঃ রায়চৌধুরীর চিকিৎসায়। এভাবে সেরেও যায় ওষুধেই অনেকের।
-আর যাদের থেকে যায়? আমার মত।
-তাদেরও ব্যবস্থা আছে। তাকে বলে পান্চ গ্রাফটিং (PUNCH GRAFTING)।
শরীরের অন্য স্বাভবিক অংশ থেকে ছোট ছোট আকৃতির ত্বক কেটে বসিয়ে দেওয়া হয় সাদা অংশে, নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে। এই জায়গায় বদল করা। ত্বকগুলো আসলে রঙের কোষাগারের কাজ করে। রং ছড়াতে থাকে ওই গ্রাফটগুলি থেকে। ঢেকে যায় পুরো দাগটা।
-বাবাঃ সে তো অনেক ব্যাপার। ব্যাথা লাগবে না? অজ্ঞান করে নেবেন?
-না শুধু যেটুকু জায়গায় দরকার, সেটুকুকেই অবশ করে নেওয়া হয়। অপারেশনের পর হেঁটে ফিরেও যেতে পারবে।
লিখতে থাকেন ডাঃ গুপ্ত। কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা, যেগুলো অপারেশনের আগে লাগবে। বুঝিয়ে দেন সেগুলো।
চার মাস পরে।
ভাল আছে অনিন্দিতা। অনেক ভাল। অপারেশনের পর দিনপাঁচেক একটা ছোট ব্যান্ডেজ ছিল পায়ে। তারপর সেটাও খুলে দিয়েছিলেন ডাক্তারবাবু। বলেছিলেন, রোদ লাগাতে। অবাক লাগত প্রথম প্রথম। ওর চেনা, লুকিয়ে রাখা সাদা দাগটাতে ছোট ছোট গোল গোল ত্বক বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আশ্চর্য ডিজাইনের মত। যেন দিশাহীন সমুদ্রে ছোট ছোট আশার দ্বীপ।
তারপর মাসখানেকের মধ্যে রং ছড়াতে শুরু করল গ্রাফটগুলো থেকে। সে কি উত্তেজনা। ওর জেদী, সৎ, একগুঁইয়ে বাবার চোখেও সেদিন জল দেখেছিল অনিন্দিতা। আস্তে আস্তে ঢেকেও গেল দাগটা মাস তিন চারের মধ্যেই। আর কোনও চিহ্নিও রইল না।
এখন রং ফিরে এসেছে। ত্বকে। মনেও।
এখন ভালো আছে অনিন্দিতা। খুব ভালো আছে। কারও করুণা বা কৃপার্থী হয়ে নয়, নিজের শর্তেই মাথা উঁচু করে বাঁচবে সে। এবার নিজেই বেছে নেবে নিজের জীবন।
অনিন্দিতার গল্পটা এখানেই শেষ। ওর অসুখ সেরে গেলেও অন্য অসুখটা কিন্তু থেকেই গেল। যে অসুখে সামান্য একটা দাগের জন্য অপমানিত হতে হয় মেয়েদের। সেই অসুখটা সমাজের। সে অসুখ সারবে কোন সার্জারিতে?
আমার স্বেতী প্রায় সারা শরীরে।এ কোনো ওষুধেই সারে না।এমনকি রে নিয়েছি তাতে বিশেষ কাজ হয় নি।
আর এই দাগের ফল ভুগেছে আমার মেয়ে।
100 ভাগ সেরে যায়।