বীভৎস কোনও দৃশ্য দেখে বমি করেন কেউ। খারাপ গন্ধে কারুর বমি আসে। খারাপ স্বাদের খাবার খেয়ে কেউ সে খাবার বমি করে তুলে দেন। কারুর গাড়ীতে উঠলে বমি পায়, সে রোগের নাম মোশন সিকনেস। জাহাজে সমুদ্রের দোলায় বমি হলে—সি সিকনেস। বেশীর ভাগ বমি করেন পরিপাক তন্ত্রের সমস্যায়—পিত্তথলির ঘা, পিত্তথলিতে পাথর, লিভারে ঘা, খাদ্যনালীতে অবরোধ…। কিডনি, কিডনি থেকে মূত্রথলিতে যাওয়ার নালীতে পাথর বা ঘাও বমির কারণ হতে পারে। কিডনি শরীরের দূষিত পদার্থগুলোর অনেকগুলোকে রক্ত থেকে বার করে, কিডনি ঠিক মতো কাজ না করলে সে সব পদার্থ জমার জন্যও বমি হতে পারে। হৃৎযন্ত্রের সমস্যায় বুকে ব্যথার সঙ্গে বমি হতে পারে। জ্বর হলে অনেকের বমি পায়। গর্ভাবস্থার প্রথম মাসগুলোতে অনেক মহিলার বমি হয়—এ অবস্থার গালভরা নাম হাইপারএমেসিস গ্রাভিডেরাম। কিছু ওষুধে কারুর কারুর বমি হয়—এও আমাদের দেখা।
মাথার ভেতরকার কারণেও বমি হতে পারে। মেনিনজাইটিস বা এনকেফালাইটিসে বমি হতে পারে। উচ্চরক্তচাপ, মাথায় আঘাত, মাথার ভেতরে রক্তক্ষরণ, মাথার টিউমারেও বমি হতে পারে মাথার ভেতরে চাপ বেড়ে—এসব কারণে হওয়া বমির সঙ্গে মাথা ব্যথা থাকে। মাথা ব্যথা ও বমির অতোটা ভয়ঙ্কর নয় এমন এক কারণ হল—মাইগ্রেন বা আধকপালী।
বমি হতে পারে মানসিক কারণেও। নিজেকে রুগ্ন প্রতিপন্ন করতে অনেকে বমি করেন—এ রোগের নাম বুলিমিয়া। কমবয়সী মেয়েদের মধ্যে এমনটা বেশী দেখা যায়।
বমি নিজে কোন রোগ নয়
তাহলে বমি ব্যাপারটা কি? বমি কি একটা রোগ। না বমি নিজে কোন রোগ নয়, অনেক রোগের একটা সাধারণ উপসর্গ বমি। আবার অন্য ভাবে দেখলে বমি শরীরের পক্ষে ভালো। শরীরের প্রতিরক্ষাব্যবস্থারই একটা অঙ্গ বমি। খাদ্যনালীকে যখন কোনও বিপদের মোকাবিলা করতে হয় তখনই সাধারণত বমি হয়। বমি আমাদের মনে করিয়ে দেয় খাদ্যনালী বা শরীরের অন্য কোথাও কিছু গন্ডগোল হয়েছে, খুঁজে দেখ।
বমি কেমন করে হয়?
বিষয়টা জটিল, সহজ করে বোঝার চেষ্টা করা যাক। মস্তিষ্কের বমনকেন্দ্র বা vomitting centre বমি বিষয়টাকে নিয়ন্ত্রণ করে। শরীরের বিভিন্ন ইন্দ্রিয় থেকে ঈঙ্গিত বমনকেন্দ্রে আসে। বমনকেন্দ্রের কাছেই আছে রক্তের মধ্যেকার বিভিন্ন পদার্থ চেনার জন্য বিশেষ স্নায়ুকোষের গুচ্ছ। এই কোষগুলো রক্তে কোন রাসায়নিক কতটা আছে মেপে যদি দেখে তা শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর তাহলে বমনকেন্দ্রকে বমি করার নির্দেশ দেয়। বমনকেন্দ্রের কাছেই আরও আছে শ্বাস-প্রশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করার কেন্দ্র, পরিপাক তন্ত্রের পরিচালক ভেগাস স্নায়ুকোষকেন্দ্র এবং আরও কিছু স্নায়ুকোষকেন্দ্র যারা কোনও কোনও ভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস ও পরিপাকের সঙ্গে যুক্ত।
বমনকেন্দ্রের স্নায়ুকোষগুলো উত্তেজিত হলে অনেকগুলো ঘটনা একসঙ্গে হতে থাকে। ভেগাস স্নায়ু পাকস্থলী থেকে এসিড বেরোনো বাড়িয়ে দেয় এবং পাকস্থলী থেকে ক্ষুদ্রান্ত্রে যাওয়ার দরজা (পাইরোলাস) বন্ধ করে দেয়। পাকস্থলীতে তাই খাবার ও এসিড জমতে থাকে। এই সময় শ্বাস নেওয়া শুরু হয়, কিন্তু শ্বাসনালীর দরজা স্বরযন্ত্র বন্ধ থাকে। পাকস্থলীর ওপর দিকে গ্রাসনালীতে যাওয়ার দরজা এই সময় ঢিলে হয়ে যায়। এরপর পেটের সামনের দেওয়ালের মাংসপেশী সংকুচিত হয়, পেটের ভেতরের চাপ বেড়ে যায়, এই চাপে পাকস্থলীর ভেতরে জমে থাকা জিনিস জোরে গ্রাসনালী হয়ে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে। এই সময় স্বরযন্ত্র বন্ধ থাকে বলে বমি শ্বাসনালীতে ঢুকতে পারে না।
বাচ্চাদের বমিতে বিপদ
বমিতে কতগুলো ব্যাপার একসঙ্গে হয় দেখলাম। এর জন্য স্নায়ুগুলোর মধ্যে সমন্বয়-সাধন জরুরী। বাচ্চাদের স্নায়ু-সমন্বয় চালু হতে সময় লাগে। তাই বাচ্চারা বমি করলে অনেক সময় শ্বাসনালীতে বমি ঢুকে বিপদ ডেকে আনে। দুগ্ধপোষ্য বাচ্চাদের দুধ খাওয়ানোর পর বুকে ফেলে পিঠে চাপড় মেরে ঢেঁকুর তোলালে বমির সম্ভাবনা কমে। বাচ্চারা বেশী বমি করলে মাথার দিকটা নীচে করে দিতে হয় যাতে শ্বাসনালীতে বমি ঢুকে না যায়।
আরও জানার
অজ্ঞান রোগী বমি করলেও তাঁর মাথা নীচে করে দিতে হয়।
যাঁর স্নায়ুরোগ নেই বা যিনি অজ্ঞান নন তাঁর ক্ষেত্রে বমি করার সময় মাথা নীচু করার দরকার নেই, কেন না বমি করার সময় তাঁর স্বরযন্ত্র বন্ধ থাকে। তবে বমি করার সময় কথা বলা অনুচিত, কেন না কথা বলার সময় স্বরযন্ত্র ফাঁক হয়, তা দিয়ে বমি ঢুকে যেতে পারে।
বমির সাথে কফ ওঠা, পিত্তবমি, টক বমি…
পাকস্থলীর দেওয়ালকে এসিড থেকে বাঁচাতে মিউকাস অর্থাৎ কফের মতো দেখতে একটা পদার্থ দেওয়াল থেকে বেরোয়। খালি পেটে বমি করলে এই মিউকাস বমির সঙ্গে বেরোয়, অনেকে তখন ভুল করে ভাবেন বুকের কফ বমির সাথে উঠছে।
কখনও কখনও খালি পেটে ক্ষুদ্রান্ত্রের প্রথমাংশ ডিওডেনাম থেকে পিত্ত পাকস্থলীতে চলে আসে। সে সময় বমি হলে হলদে-সবুজ রং-এর তেতো পিত্ত বমির সাথে উঠে আসে।
অনেক সময় খালি পেটে বমি হলে পাকস্থলীর এসিড বমির সঙ্গে উঠে আসে। এসিডের স্বাদ টক। টম বমি হওয়া অস্বাভাবিক বা ভয়ংকর কিছু নয়।
কেন বমির চিকিৎসা দরকার?
বমির চিকিৎসা হওয়া উচিত তার কারণের চিকিৎসা। তবে সব সময় কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। আর কারণ খুঁজতে গিয়ে সময়ও নষ্ট করা যায় না অনেক সময়। কেন না বারবার বমি হলে জল ও লবণ শরীর থেকে বেরিয়ে লবণ-জলশূন্যতা হতে পারে, এতে রক্তচাপ কমে, বেশী রক্তচাপ কমলে কিডনির কাজকর্ম ব্যাহত হয়। বারবার বমি করতে থাকলে পাকস্থলীর দেওয়ালের রক্তনালী ছিঁড়ে রক্তবমি হতে পারে। বারবার বমিতে শরীরের অম্লভাব কমে গিয়ে খিঁচুনি হতে পারে। বমি শ্বাসনালীতে ঢুকলে ফুসফুসের প্রদাহে জীবনসংশয় হতে পারে। তাই বমির চিকিৎসা দরকার।
বমির ওষুধ
বমির ওষুধ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার করা উচিত, কেন না এদের অনেকগুলোরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম ডমপেরিডন ওষুধটার। খাওয়ার আধ ঘন্টা খানেক আগে ডমপেরিডন খেতে হয়। আপনার ওজন যদি ৩৫ কিলো বা তার বেশী হয় তাহলে ১০ মিলিগ্রামের একটা বড়ি ৬ ঘন্টা থেকে ৮ ঘন্টা ছাড়া খাওয়া যায়। ৩৫ কিলোর নীচে ওজন হলে ওজনের হিসেবে ওষুধের মাত্রা ঠিক করতে হয়। গর্ভাবস্থায় এ ওষুধ বর্জনীয়। যে মা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ান তাঁর, কিডনীর অসুখ, লিভারের অসুখ ও হার্টের কিছু অসুখে এ ওষুধ ব্যবহার করতে হয় সাবধানে।
এছাড়া বমির অন্য ওষুধগুলো হল প্রোক্লোপেরাজিন, ট্রাইফ্লুপেরাজিন, মেটোক্লোপ্রামাইড, প্রোমেথাজিন, ডাইমেনহাইড্রিনেট, ইত্যাদি। ক্যানসারের কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপির সময় যে বমি হয়, তা কমাতে ব্যবহার করা হয় ওনডানসেট্রন।
খুব বেশী বমি হয়ে শরীরে লবণ-জলশূন্যতা হলে শিরায় স্যালাইন চালাতে হয়—তাতে ঘাটতি পূরণ হয়, খাদ্যনালীও বিশ্রাম পায়।
বমির পর কি খাবেন?
ক্ষণস্থায়ী কারণে বমি হলে তা নিজে থেকে বন্ধ হয়ে যায়। তারপর অন্তত ২-৩ দিন খুব হাল্কা, সহজপাচ্য খাবার অল্প অল্প করে খাওয়া উচিত।
বমি আটকানোর জন্য
বাসী, পচা, অনেক সময় ধরে আ-ঢাকা খাবার, রাস্তার কাটা ফল ও ফাস্ট ফুড না খাওয়া উচিত।
যেসব ওষুধে বমি হয়, সে সব ওষুধ খালি পেটে না খেয়ে ভরপেটে খান।
সহপাঠী অধ্যাপক ডা সঞ্জয় চ্যাটার্জীর ‘অসুখ-বিসুখ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটা লেখার সাহায্য নিয়েছি এ রচনায়।
খুব শিক্ষা ও সচেতনতামূলক লেখা।ভালো থাকবেন।