নতুন বিয়ে করা সিস্টারদের নিয়ে বেশ সমস্যা। একটাই চিন্তা কতক্ষণে ডিউটি সেরে ঘরে ফিরবেন। তারপর তো ডিউটির সময় পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর ফোন আসে।
আমি তখন সরকারি চাকরি করি। সবে মাত্র একটি স্টেট জেনারেল হাসপাতালে যোগ দিয়েছি ফিজিশিয়ান হিসাবে। হাসপাতালে যত রোগী ভর্তি হয় তাঁর আশি শতাংশের এর মালিক আমি। রাউন্ড দিচ্ছিলাম মেয়েদের দু নম্বর ঘরে।
ডিউটি করছিলেন ইন্দ্রাণীদি। তাঁর গা থেকে এখনও বিয়ের গন্ধ মোছেনি। আমাকে রাউন্ডে ঢুকতে দেখে দিদি বললেন, ‘এখন এলেন? আমার যে ইনজেকশন দেওয়া শেষ হয়নি। আপনি অন্য একটা ওয়ার্ড রাউন্ড দিয়ে আসেন না।‘
আমি বললাম, ‘সব ওয়ার্ড রাউন্ড দেওয়া শেষ। আপনার ওয়ার্ডেই শেষ এসেছি। আপনি ইনজেকশন দিন, আমি আমার মতো রাউন্ড দিয়ে নিচ্ছি।‘
‘সে আবার হয় নাকি? চলুন, আগে রোগী দেখা যাক।‘
প্রথম রোগী দেখতে দেখতেই দিদির ফোন বেজে উঠল। উনি কেটে দিলেন। আবার পাঁচ মিনিট পর ফোন বাজল। আবার কাটলেন।
আমি বললাম, ‘একবার ধরে বলুন পরে ফোন করতে। না হলে আপনার বেচারা খানিকক্ষণ পর পর ফোন করে যাবেন আর দুশ্চিন্তা করবেন।‘
দিদির চোখ মুখ লাল হয়ে গেল। বললেন, ‘কতবার বলেছি ডিউটিতে থাকার সময় খুব জরুরী প্রয়োজন ছাড়া ফোন কোরো না। একদম কথা শোনে না। এক্কেবারে পাগল একটা।‘
আমি হাসলাম। ওয়ার্ডের চির চেনা গন্ধটাও কেমন বদলে গেছে। ইন্দ্রাণীদি আজ ডিউটিতে আসার সময়ে সেন্টের বোতল উজাড় করে এসেছেন। সদ্যবিবাহিতদের সাত খুন মাপ। তাঁরা একটু সাজগোজ করে এলে সিস্টার ইনচার্জ কিছুই বলেন না।
ইন্দ্রাণীদির আবার ফোন এলো। বললাম, ‘ধরুন। আমিও একটু আপনাদের আলাপ শুনি।‘
ইন্দ্রাণীদি আমাকে সে সুযোগ দিলেন না। ফোন ধরেই সরাসরি আক্রমণের রাস্তায় গেলেন, ‘তোমার কি একটুও আক্কেল নেই। তোমাকে কতবার বলেছি ডিউটির সময় ফোন কোরো না। আমি ডা. ভৌমিকের সাথে রাউন্ডে আছি। এখন রাখছি।‘
……
‘কী আশ্চর্য, ওনার বয়স আমি জানব কী করে? আর জানার চেষ্টাই বা করব কেন? তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে?’
আমি রোগী দেখায় মনোনিবেশ করলাম। সামনের বেডের পেশেন্ট সত্তর বছরের এক বুড়ি। দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। আত্মীয় স্বজনের কোনো পাত্তা নেই। তাঁরা বুড়িকে হাসপাতালে ভর্তি করে আর এমুখো হয়নি।
যখনই রাউন্ড দিতে আসি বুড়িকে বসে থাকতে দেখি। দুই হাঁটু বুকের কাছে নিয়ে মাথা গুঁজে ওয়ার্ডের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন। আজ প্রথম দেখলাম, বুড়ি শুয়ে আছেন। কিন্তু বুড়ির পা দুটো শোয়া অবস্থাতেও কেমন বেঁকে বুকের কাছাকাছি চলে এসেছে। আমি টেনে সোজা করার চেষ্টা করলাম। বুড়ি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘বাপরে আমার, লাগে। মইরা যাব, ছাইড়া দে।‘
আমি ইন্দ্রাণীদিকে বললাম, ‘দিদি, আপনি এই পেশেন্টকে একবার ফিজিওথেরাপি রেফার করে দেন। আমি চিত্তদার সাথে কথা বলে রাখব। দেখা যাক পা দুটো সোজা করা যায় কিনা?’
ইন্দ্রাণীদি বললেন, ‘ঠিক আছে স্যার।‘ দিদির গলার স্বর ভাঙা ভাঙা। তাকিয়ে বুঝলাম দুই চোখ জলে টইটুম্বুর। বিয়ের এখনও মাস পেরোলো না, এখন থেকেই ঝগড়া ঝাটি, কান্নাকাটির পালা শুরু হয়ে গেছে? তাহলে বাড়ি ফেরার জন্য এতো তাড়াহুড়োও বা কেন? ডিউটি শেষ হওয়ার জন্য অধীর অপেক্ষা কেন?
দিন চারেক বাদে ফিজিওথেরাপিস্ট চিত্তদার সাথে দেখা। চিত্তদা বললেন, ‘ফিমেল টুর ওই বুড়ির ঠ্যাং সোজা হবে না।‘
‘কেন? এর চেয়ে খারাপ পা ঠিক হয়ে যায়।‘
‘ওই বুড়ির কিছুতেই হবে না।‘ চিত্তদা তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় থাকলেন।
‘কেন হবেনা?’
‘বুড়ি সারাদিন পা বুকের কাছে জড়ো করে বসে থাকে। ওভাবে বসে থাকলে পা আর সোজা হয়?! সারাদিনে আধ ঘণ্টা ওই পা টানাটানি করে কোনো লাভ নেই। মিছিমিছি পণ্ডশ্রম।’
আমি সেদিন ফিমেল টু ‘তে রাউন্ড দিতে ঢুকে প্রথমেই ঐ বুড়ির দিকে তাকালাম। বুড়ি যথারীতি দুই হাঁটুর ফাঁকে মাথা গুঁজে বসে আছেন। সিস্টার ইনচার্জ চা খেতে ডাকছেন। গরম চায়ের কাপে আয়েস করে চুমুক দিয়ে বললাম, ‘দিদি, আপনার মেয়ে কেমন আছে।‘
সিস্টার ইনচার্জ ছায়াদি করুণ হাসলেন। বললেন, ‘ওই যেমন থাকে। ওর শুধু শরীরটাই বাড়ছে, মনের বয়স বাড়ছে না। আগে তাও ছোটোখাটো চেহারা ছিল, সামলানো সহজ ছিল। ইদানীং ওজন খুব বেড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া আমারও তো বয়স বাড়ছে। দু বছর পরেই রিটায়ার্মেন্ট। আমার কিছু হয়ে গেলে মেয়েটার যে কী হবে? ওর বাবা তো আগে আগে মরে বেঁচে গেছেন।‘
কী আর সান্ত্বনা দেব। আগেই শুনেছিলাম ছায়াদির একমাত্র কন্যা মানসিক প্রতিবন্ধী। কথা ঘোরানোর জন্য বললাম, ‘দিদি, আপনি অদ্ভুত সুন্দর চা বানান।‘
ছায়াদি হাসলেন। বললেন, ‘চায়ের ব্যাপারে আমার বেশ খুঁতখুঁতানি আছে। বাজারের পাঁচমিশালি চা আমি মুখে তুলতে পারি না। লালবাজারে আমার এক চেনা দোকান আছে। সেখান থেকে চা পাতা কিনি। আমার আর কোনো সখ আহ্লাদ অবশিষ্ট নেই। শুধু ওই চায়ের নেশাটুকুই রয়ে গেছে। যিনি নেশাটা ধরিয়েছিলেন, তিনি তো দিব্যি টাটা বাই বাই করে পালালেন। এখন বাড়িটা খাঁ খাঁ করে। হাসপাতালের ডিউটিতে এসে তবু দুটো মানুষের সাথে কথা বলে মনটা হালকা হয়।’
একটু চুপ থেকে তিনি বললেন, ‘তবে মজার ব্যাপার কী জানেন, যতই ওই খাঁ খাঁ বাড়িটা অসহ্য লাগুক, সারাক্ষণ আমার মন পড়ে থাকে সেখানেই। মনে হয় কখন ডিউটি শেষ হবে। কখন বাড়ি ফিরব। কখন শ্যামলীর দেখা পাব? শ্যামলী ঠিক ঠাক আছে তো? আয়া ওকে খাইয়েছে তো?’
চা শেষ করে বললাম, ‘ওই ঠাকুমার নাম কী? ওই যে দুই হাঁটুর মাঝে মাথা গুঁজে বসে আছে। ওনার টিকিটটা একবার দিন।‘
ছায়াদি বললেন, ‘ইন্দ্রাণী, মা, তুই আমাদের শান্তি দিদার টিকিটটা একবার বের করে দে।‘
ইন্দ্রাণীদি টিকিটটা আমার হাতে দিয়ে হেসে বললেন, ‘কী ব্যাপার ডা ভৌমিক, আপনি শেষমেশ একটা বুড়িকে নিয়ে পড়লেন কেন?’
ছায়াদি বললেন, ‘বেশ করেছেন, বুড়িকে নিয়ে পড়েছেন। তোর তাতে কী সমস্যা? তুই এখন তোর লোককে নিয়ে চিন্তা কর, তাহলেই হবে। যা পালা…।‘
টিকিট খুলে দেখলাম, দেড় বছর আগে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শান্তিলতা দত্ত ভর্তি হয়েছেন। তাঁর বয়স লেখা ৭৮ বছর। ভর্তির পর তাঁর পালমোনারি টিবি ধরা পড়েছিল। ছ মাস ওষুধ খেয়েছেন। এসময় যে ডাক্তারবাবুরা রাউন্ড দিতেন, তাঁরা বারবারই রোগীর বাড়ির লোককে খবর দেওয়ার জন্য লিখেছেন। উত্তর এসেছে রোগীর বাড়ির লোকের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ফোন নাম্বারটিও ভুল। তারপর যা হয়, ডাক্তারবাবুদের উৎসাহে ভাঁটা পড়েছে। রাউন্ডের সময় দিনের পর দিন লিখে গেছেন নর্মাল ডায়েট। ব্যাস আর কিছু না।
আমি বুড়ির বেডের সামনে গিয়ে বললাম, ‘এই যে দিদা, তুমি কানে শুনতে পাও?’
বুড়ি দাঁত বের করে হাসেন। বললাম, ‘তুমি এভাবে বসে থাকো কেন? এভাবে বসে থাকলে তোমার পা আরও বেঁকে যাবে। তুমি পা ঝুলিয়ে বস। আমি রেলকট লাগিয়ে দিতে বলছি। রেলিঙের ফাঁক দিয়ে পা ঝুলিয়ে বসবে। পড়ে যাওয়ার ভয় নেই। কোনো সমস্যা নেই।‘
‘আমার সমস্যা নিয়ে তোরে চিন্তা করতি হবে না ডাক্তার। তুই অন্য পেশেন্টদের দ্যাখ। আমারে ছাড়ান দে।‘
আমায় মাথায় রাগ চড়ে গেল। বললাম, ‘আমি কাকে নিয়ে চিন্তা করব সেটা আমার ব্যাপার। আমি যা বলব সেটাই তোমাকে শুনতে হবে। কারণ এটা হাসপাতাল। আর হাসপাতালে ডাক্তারের কথাই শেষ কথা।’ আমি জোর করে বুড়ির পা টেনে সোজা করতে চাইলাম।
বুড়িও ছেড়ে দেওয়ার লোক নন, তিনিও প্রায় মড়াকান্না শুরু করলেন। ‘মরে গেলুম রে, ডাক্তার আমাকে মাইরে ফেলল রে…’
ইন্দ্রাণীদি দৌড়ে এসে বললেন, ‘কী ছেলেমানুষী করছেন। চলুন, টেবিলে চলুন।’
আমি বললাম, ‘দিদি, এই বুড়ির পা আমি সোজা করেই ছাড়ব।’
টেবিলে মুখোমুখি বসে ইন্দ্রাণীদি বললেন, ‘আপনি শান্তি দিদার পা কোনোদিনই সোজা করতে পারবেন না। কারণ সেই চেষ্টা করলে শান্তিদিদা বেঁচেই থাকবে না।’
বললাম, ‘কেন বাঁচবে না কেন? আরও ভালো ভাবে বাঁচবে। নিজের পায়ে হাঁটাচলা করতে পারবে।’
ইন্দ্রাণীদি বললেন, ‘ও দু পায়ের মধ্যে মাথা গুঁজে একদৃষ্টে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রতি মূহুর্তে অপেক্ষা করে ওর সন্তানেরা ওকে নিতে আসবে। আর এই অপেক্ষা টুকুই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ওকে বেঁচে থাকার শক্তি দিচ্ছে।’
একটু থেমে দিদি বললেন, ‘ছায়াদিকে দেখুন, মানুষটার জীবনে আর একটুও আনন্দ নেই। কিন্তু ওনাকেও বাঁচিয়ে রেখেছে সেই অপেক্ষা। ওনার বাড়িতে অসহ্য লাগে, অথচ ওয়ার্ডে এসে সারাক্ষণ অপেক্ষা করেন, কখন ডিউটি শেষ হবে। মেয়ের কাছে ফিরবেন। উনিও মনে প্রাণে অপেক্ষা করেন এমন একটা দিনের, যেদিন মেয়ের একটা ব্যবস্থা করে যেতে পারবেন। আমাকে দেখুন, মাত্র একমাস আগে বিয়ে হয়েছে, অথচ এর মধ্যেই বুঝতে পারছি আমার স্বামী মানসিক ভাবে অসুস্থ। সারাদিন সে আমাকে নিয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত সন্দেহ করে। আর সেটা আমাকে সোচ্চারে বলেও। তবু আমি বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করি। অপেক্ষা করি সেই দিনের, যেদিন ও ভুল বুঝতে পারবে। আমাদের মতো সর্বহারাদের তো ওই অপেক্ষা টুকুই বাঁচিয়ে রেখেছে।’
আমি মাথা নিচু করে বললাম, ‘দুঃখিত দিদি।’
ইন্দ্রাণীদি হেসে বললেন, ‘দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। চলুন ছায়াদির তৈরি এক কাপ চা খাই। তাহলে সব দুঃখ কেটে যাবে।’
তারপর প্রায় দশ বছর কেটে গেছে। আস্তে আস্তে বুঝতে শিখেছি কথাগুলো কতো সত্যি। আমরা অতি সাধারণ মানুষেরা আজকের জন্য বাঁচি না। কালকে ভালো কিছু হবে এই অপেক্ষায় বেঁচে থাকি।