দ্বাদশ শতাব্দীর (১১৩৫ বা ১১৩৮-১২০৪ খ্রিষ্টাব্দ) বিখ্যাত ইহুদি দার্শনিক তথা নেতা তথা চিকিৎসক ছিলেন মাইমনিদেস (Maimoides বা Moses ben Maimon)। ইহুদিদের কাছে ইনি রামবাম বলে বেশি পরিচিত। তাঁর দার্শনিক এবং নৈতিক অবস্থানের জন্য মাইমনিদেস আন্তর্জাতিক জগতে বিখ্যাত। ইনি প্রকৃতপক্ষে মেষপালক পরিবারের ছিলেন। তাঁর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, যাদের স্বভাব এবং চরিত্রে ভারসাম্য রয়েছে তাদেরকে জ্ঞানী বা hakham বলা হয়। আবার যারা এ অবস্থাকেও অতিক্রম করে যায় তাদেরকে পবিত্র বা Hasid বলা হয়। এরপরে তিনি তাঁর অবস্থান ব্যাখ্যা করেন – “যাঁরা উদ্ধত মানসিকতা থেকে একেবারে ভিন্ন মেরুর মৃদু চরিত্রের অধিকারী তাঁরা প্রকৃতপক্ষে পবিত্র, এই হল ধর্মনিষ্ঠা বা সাধুচরিত্রের মাপকাঠি। যদি কেউ কেবলমাত্র বিনয়ী এবং মধ্য চরিত্রের হন তাঁদেরকে জ্ঞানী বলা হয়, এই হল জ্ঞানের মাপকাঠি।… পুরনো দিনে পবিত্র ব্যক্তিরা তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে মধ্য পথে পরিচালনা করতেন – কোন একটি চরম অবস্থান বেছে নিতেন না…”। (https://plato.stanford.edu/entries/maimonides/)
(সম্ভবত ১৮শ শতকে শিল্পীর কল্পনা-প্রসূত মাইমনিদেসের চিত্ররূপ)
বর্তমান সময়ে জঙ্গি গোষ্ঠী হামাসের রকেট আক্রমণের ‘প্রত্যুত্তরে’ ইজরায়েলের তরফে গাজার হাজার হাজার নিরীহ মানুষ, বৃদ্ধ, শিশু, গর্ভবতী নারী, অসুস্থ ক্যান্সার রোগীদের ( কে না নয়) ওপরে নির্বিচার বোমা এবং গুলির আক্রমণ ইহুদি দর্শনের অন্যতম মান্য প্রবক্তা মাইমনিদেসের ‘মধ্য পথে’র প্রসঙ্গ জরুরি হয়ে উঠেছে।
ইজরায়েলের হাইফা ইউনিভার্সিটির দার্শনের অধ্যাপক রাব্বি ডঃ সামুয়েল লেবেনস ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত Jews’ Chronicle জার্নালে এরকম একটি মধ্যপথের সন্ধান দিয়েছেন তাঁর “What the rabbis teach about the ethics of war – We should do our utmost to minimise harm to civilians in Gaza” প্রবন্ধে (২৭ অক্টোবর, ২০২৩)। তিনি বলেছেন – “The presence of Hamas in Gaza is intolerable. There can be no military solution to Israel’s conflict with the Palestinians, without some sort of political process. And yet, there can be no political process with people who want to butcher us.” নির্দ্বিধায় এ কথা জানানোর পরে লিখছেন – “If the way in which we fight undermines the values that set us apart from our enemies, we will have lost the war, even in winning it. What would a war look like if we fought it according to Jewish values? … It was wrong for Israel to cut electricity and water, indiscriminately, to the people of Gaza (who had no way of leaving the strip), even as leverage for the liberation of our hostages. Now is precisely the time to raise such concerns because part of what winning looks like is doing it ethically.” এ প্রবন্ধের শেষভাগে বলছেন – “May God forbid that we ever lose the human compassion that differentiates us from our enemies and makes our heart bleed for every innocent life lost in Gaza, as we fight a war that we cannot afford to lose.”
ইজরায়েলের শিক্ষিত চিন্তাশীল ব্যক্তিত্বদের মধ্য থেকেই এ প্রশ্ন ওঠা শুরু হয়েছে। আমেরিকায় গণতন্ত্রকামী ইজরায়েলি ছাত্রছাত্রীরা #NotInMyName নামে ওয়াশিংটনে প্রতিবাদে নেমেছে। ভারতেও ছড়িয়েছে এ প্রতিবাদ।
খোদ লন্ডনে ৩০০,০০০ লোকের সুবিশাল জমায়েত এবং মিছিল হয়েছে ইজরায়েলের গাজার ওপরে বর্বর সামরিক আক্রমণের বিরোধিতা করে। বিবিসি সংবাদের শিরোনাম “Three lakh people take part in pro-Palestine protest calling for ceasefire in Gaza” (১২ অক্টোবর, ২০২৩)। সিএনএন বা গার্ডিয়ান-এর মতো সংবাদসংস্থার কথা বাদই দিলাম, দ্য টাইমস অফ ইজরায়েল সংবাদপত্রে এ খবরটির শিরোনাম “300,000 march against Israel in London on Armistice Day, demand Gaza ceasefire” (১১ অক্টোবর, ২০২৩)।
UN এবং WHO – ইজরায়েলের অবস্থান
UN-এর চার্টারের শুরুর বাক্যটি হচ্ছে – “WE THE PEOPLES OF THE UNITED NATIONS DETERMINED to save succeeding generations from the scourge of war, which twice in our lifetime has brought untold sorrow to mankind, and to reaffirm faith in fundamental human rights, in the dignity and worth of the human person, in the equal rights of men and women and of nations large and small, and to establish conditions under which justice and respect for the obligations arising from treaties and other sources of international law can be maintained, and to promote social progress and better standards of life in larger freedom”।
অর্থাৎ UN-এর ঘোষণাপত্রটি তৈরি হয়েছে পৃথিবীর অধিবাসী সমস্ত মানুষের নামে – এখানে কোন দেশ, রাষ্ট্রনেতা বা সংগঠনের নাম নেই। এদের তরফে তৈরি হয়নি। তাত্ত্বিকভাবে এ কারণে ঘোষণাপত্রটি বিশিষ্ট। এর ভিত্তিতে রয়েছে সবার সমানাধিকার (equity), মানবাধিকার এবং দেশ-কাল-জাতিগত বা ধর্মীয় পরিচয়কে অতিক্রম করে সমস্ত মানুষের কথা বলার, মতামত জানানোর একইরকমের সুযোগ এবং অধিকার।
প্রায় হুবহু একই কথা প্রযোজ্য হু-র সংবিধানের ব্যাপারে – যদিও বাক্যবিন্যাস ভিন্ন এবং আলোচ্য বিষয় পৃথিবীর মানুষের স্বাস্থ্য এবং বিশ্বস্বাস্থ্য।
অতি উদ্বেগজনক ঘটনা হল গার্ডিয়ান সংবাদপত্রের সংবাদ (২৫ অক্টোবর, ২০২৩) অনুযায়ী “Israel to refuse visas to UN representatives over Guterres speech on Gaza war”। রাষ্ট্রসঙ্ঘে ইজরায়েলের Gilad Erdan খোলাখুলি জানিয়েছেন যে অক্টোবরের ২৪ তারিখে রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব গুতেরেসের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ইজরায়েল রাষ্ট্রসঙ্ঘকে “উপযুক্ত শিক্ষা” দেবার জন্য এই পদক্ষেপ নিয়েছে।
কি ছিল গুতেরেসের বক্তব্য? তিনি জানিয়েছিলেন গাজার মানুষের “epic suffering” বন্ধ করার জন্য ইজরায়েলের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে হবে। তাঁর কথাগুলো ছিল এরকম – “To ease epic suffering, make the delivery of aid easier and safer and facilitate the release of hostages. I reiterate my appeal for an immediate humanitarian ceasefire”। এর উপযুক্ত জবাব হিসেবে ইজরায়েল ভিসা দেওয়া বন্ধ করেছে। একটি যুদ্ধোন্মাদ দেশের এরকম বেপরোয়া নির্লজ্জ ঔধত্য বিশ্বের তথাকথিত মহা শক্তিধর গণতান্ত্রিক দেশগুলো নির্বিকার চিত্তে মেনে নিয়েছে। X (Twitter) হ্যান্ডেলে Gilad Erdan-এর পোস্ট ছিল এরকম। সহজ কথায়, UN “no longer holds even one ounce of legitimacy or relevance.”। “পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন”!
ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম সামরিক উপদেষ্টা মার্ক রেগেভ নির্লিপ্ত চিত্তে জানিয়েছেন, গাজায় যে সাধারণ মানুষ এবং শিশুদের অভাবিত মৃত্যু ঘটছে তা হল হামাসের আক্রমণের “payback”। বিচারের ভার পাঠকদের। কত শিশুর মৃত্যু হয়েছে ইজরায়েলি হানায়? নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর (১৩.১১.২০২৩) সংবাদ “This Photograph Demands an Answer” জানাচ্ছে ৪৫০০-এর শিশু মারা গেছে এর মধ্যেই। আরও কত শিশু মায়ের কোল খালি করবে সে হিসেব আমরা জানিনা। এই সংবাদে শিশুদের গণহারে মৃত্যুর একটি ছবি দেওয়া হয়েছিল “There is nothing quite so devastating as the image of a child whose life has been snuffed out by senseless violence” ক্যাপশন সহ।
“ইন্টারন্যাশনাল পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন” গাজার যুদ্ধ এবং শিশুমৃত্যু নিয়ে বিবৃতিতে জানিয়েছে – “IPA Statement on Safety and Health of Children Living in Israel and Palestine
We are witnessing a devastating conflict in Israel and Gaza with deep distress and concern. The conflict has seen acts of indiscriminate violence against civilians and an unfolding, yet urgent, humanitarian crisis with deprivation of basic human rights, essential supplies, and access to medical care. We condemn these acts in the strongest possible terms and call for immediate action to redress the needs and rights of civilians on both sides. As the IPA, we specifically call attention to the needs of those disproportionately impacted as victims of conflict, children.”
এরপরেও এ যুদ্ধ থামবেনা। আরও অনেক মৃত্যু হবে। প্যালেস্তাইনের জমি ইজরায়েল দখল করেই চলবে।। আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদতে ইজরায়েল সমস্ত রকমের সামরিক এবং অন্যান্য সাহায্য পাচ্ছে। আমেরিকা সিরিয়ায় বোমা ফেলে ৬ জনের মৃত্যু ঘটিয়েছে। চিন, রাশিয়া, ইরান সহ কয়েকটি দেশ বাদে পৃথিবীর শক্তিধর সমস্ত দেশ ইজরায়েলের নরহত্যার পাশে দাঁড়িয়েছে। তবুও মানুষ মিছিল করে, প্রতিবাদ করে, পুলিসের লাঠি খায়, জেলে যায় – এবং প্রতিবাদ জানায়, সংহতি জ্ঞাপন করে।
এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা
সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।
…
ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু
দেখেছি আমারি হাতে হয়তো নিহত
ভাই বোন বন্ধু পরিজন প’ড়ে আছে;
পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন;
মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।
এ বিশ্বাস রক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর কি পুঁজি আছে? উত্তর এখনও আমাদের কাছে অস্পষ্ট।
Tit for tat. What Hamas has done and now Gaza inhabitants are suffering for that sin.
Well highlighted. This is worrying trend for the future world.
সমস্ত বিশ্ব অর্থনীতি ও সমস্ত কর্পোরেট মিডিয়া যখন ইজরায়েলের জিওনিষ্টদের দ্বারা পরিচালিত তখন এমনটাই প্রত্যাশিত।
হত্যালীলায় যাদের নেশা তাদের খুন করাতেই আনন্দ। তারা একটা কারণ দেখায় বটে, তবে সেটার কোন মানে হয়। আর যারা অবচেতন মনে এই হত্যা সমর্থন করে ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক বা জাতিগত কারণে তারা যুক্তি সাজায় সমর্থনের জন্য।
এই খুনের নেশা বন্ধ করবে কে?
ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য তাঁর মহামূল্য মত ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু যারা পড়বেন তারা কি করতে পারবেন!