জৈষ্ঠ্যের কাঠফাটা রোদ্দুরে এককথায় ঘেমে নেয়ে একসা। তপসিয়া গ্রামীণ হাসপাতালের আউটডোর লোকে লোকারণ্য। তার মাঝে একা কুম্ভ আমি। একের পর এক রোগীর ভিড়ে এমারজেন্সি থেকে খবর এলো – কি এক কামড়ের রোগী এসেছে। সংজ্ঞাহীন। অন ডিউটি এমারজেন্সির সিস্টার দিদিমনি এমারজেন্সি ডেকে পাঠিয়েছেন। আউটডোরের ভিড় ঠেলে তড়িঘড়ি ইমারজেন্সির ঘরে পৌঁছালাম।
মধ্য তিরিশের মহিলা। প্রায় সংজ্ঞাহীন। হাত পা ঘামে চপচপে। ওষ্ঠাধর বেশ ফোলা। শ্বাস নিচ্ছেন বেশ কষ্ট করে। হাত পায়ে বেশ কিছু লাল লাল ফোলা ফোলা দাগ। পালস দ্রুতগামী কিন্তু অস্তিত্বের সংকটে ম্রিয়মাণ। ব্লাড প্রেসার বেশ কম। মুখ থেকে গ্যাঁজলার মত কিছু বেরোতে চায় যেন।
মহিলার স্বামীর বক্তব্য অনুযায়ী- সাইকেলে চেপে বাড়ি ফিরছিলেন। গ্রামের বিচ্চুছেলের দল বোলতার চাকে আগুন দিয়েছে। সংগ্রামী বোলতার ঝাঁক উড়ে এসে নিরীহ এঁদের দুজনের ওপরই নিজেদের সংগ্রাম উজাড় করে দিয়েছে। স্বামীর সেরকম কিছু না হলেও স্ত্রীর হঠাৎই এই অবস্থা।
এক্ষেত্রে আর বুঝতে বাকি থাকার কথা নয়। অ্যানাফাইল্যাক্টিক রিয়্যাকসন। বোলতার বিষ শরীরে ঢুকে রক্তসংবাহীকে ফাঁপিয়ে দেওয়ায় রক্তচাপ গেছে কমে। ব্রংকোস্প্যাজম হেতু শ্বাসকষ্ট। কম্পেন্সেটারি পথে ঊর্ধ্ গতির অথচ ম্রিয়মাণ পালস।
তৎক্ষণাৎ অ্যাড্রিনালিন প্রয়োগ করা হল। কর্টিকোস্টেরয়েড,অ্যান্টিহিস্টামিনিক (এইচ ওয়ান ব্লকার), প্যারাসিটামল, এইচ টু ব্লকার (র্যানিটিডিন) দেওয়ার পরই কাজও হলো ম্যাজিক গতিতে। পালসের গতি কমলো। শ্বাস হলো মোটামুটি স্বাভাবিক। ওষ্ঠাধরের বৈপরীত্যও মালুম হলো স্বল্প সময়েই। বোলতা কামড়ের ফোলাগুলোও যেন কমলো খানিক। মুখের গ্যাঁজলাও কমেছে। স্বাভাবিক ভাবেই চোখ মেলে তাকালেন অনতিবিলম্বেই।
আমাদের কর্মকান্ডে স্বামীর চক্ষু ছানাবড়া। এই এত্তটুকু সময়ে সব প্রায় স্বাভাবিক। ভগবৎ সমীহে হাতজোড় করে অশ্রুসিক্ত হলেন তিনি।
বাধ সাধলো ঘন্টা দুয়েক পরে উদয় হওয়া বাকি পরিজনেরা। আমাদের ভরতি করে রাখার পরামর্শ উপেক্ষা করে আপাত সুস্থ হয়ে ওঠা ভদ্রমহিলাকে বাড়ি নিয়ে যেতে উদ্যত হলেন তাঁরা। ইউরিন আউটপুট দেখা হয়নি বলায় ঠোঁট ফুলিয়ে ভবিতব্যের পথে রোগীকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন তাঁরা।
ফিরে এলেন দু দিন পরের দুপুরে। মুখ পা ফোলা। প্রস্রাব প্রায় বন্ধ দু দিন ধরেই।
হাসপাতাল থেকে সেদিন বের করে নিয়ে গেছিলেন গ্রামের কোয়াক চিকিৎসকের কাছে। দিনে দুবেলা করে ব্যথা কমানোর ওষুধ খেয়েছেন। অপ্রয়োজনীয় অ্যামিকাসিন ইঞ্জেকশন প্রয়োগের পরেই প্রস্রাব বন্ধ। তারপরেই ফুলেছে সারা শরীর। সারা শরীরে গ্যাস জমে ফুলেছে বলে নানাবিধ গ্যাসের চিকিৎসা করেছেন তিনি। অবশেষে উপয়ান্তর না দেখে পুনর্মূষিক ভবঃ। আবার হাসপাতালমুখী হয়েছেন তিনি।
ঘটনাচক্রে এদিনও আমিই ডিউটি রত। বুঝতে বাকি রইলো না কি হয়েছে। এন এস আ আই ডি (ব্যথার ওষুধ) ও অ্যামিকাসিনের প্রয়োগে অ্যাকিউট রেনাল ফেলিওর। ব্লাড রিপোর্ট করাতেই দেখলাম ক্রিয়েটিনিন ছয়ের মাত্রা ছুঁয়েছে। অর্থাৎ কিনা হিমোডায়ালিসিসই একমাত্র উপায়। পিজি হাসপাতালের বন্ধু চিকিৎসককে ঘটনার বিবরণ জানিয়ে আমাদের গ্রামীণ হাসপাতাল থেকে রেফার করা হলো পিজি হাসপাতালে ।
উনাদের বেরিয়ে যাবার পরেই চেপে ধরলো হাসপাতালের স্টাফেরা। বোলতা কামড়ালে কি করবো স্যার? পেঁয়াজের রস, তুলসীর রস না খড়িমাটি, কি লাগাবো? ওদের কথায় মাথা নেড়ে বললাম – তৎক্ষণাৎ বরফ চেপে ধরাই ভালো।তাতে ইনফ্ল্যামেশানের গতি কমবে। মৌমাছির ক্ষেত্রে ফুটে থাকা হুল তুলে ফেলা যায়। তবে অধিকাংশ কামড়ই ভদ্রমহিলার স্বামীর রোগভোগের মত স্বল্পক্ষতির গোত্রেই পড়ে। মামুলি অ্যান্টিহিস্টামিনিকই যথেষ্ট। কামড়ের জায়গায় ইনফেকশন হলে টপিকাল অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া যায়। কিছু ক্ষেত্রে স্টেরয়েড প্রয়োগেরও প্রয়োজন হয়। তবে জ্বালা যন্ত্রণার জন্য ক্যালামিন লোশনও প্রয়োগ করে কাজ হয়েছে কখনও সখনও । তবে সঠিক চিকিৎসার বদলে অনিয়ন্ত্রিত ব্যথার ওষুধ আর কিডনির ক্ষতিকর ওষুধের প্রয়োগে ভদ্রমহিলার সমস্যা বেড়েছে এক্ষেত্রে। সেদিনের ইউরিন আউটপুট দেখে চিকিৎসা সম্পূর্ণ করলে হয়তো এ সমস্যা হতো না।
মাসখানেক পর আমাদের আউটডোরে ফিরে এলেন ভদ্রমহিলা। শরীরের ওজন কমায় চেনাই দায়। কাষ্ঠল মুখে দাঁত বের করে বললেন “জোর বেঁচে গেছি ডাক্তারবাবু। বোলতা কামড়ে ১৮ খান ডায়ালিসিস করে প্রাণে বেঁচেছি। বোলতার কামড়ে ডায়ালিসিস। কস্মিনকালেও এমন টা শুনিনি।”
উনাকে আর কি বলি- চিকিৎসক জীবনে এমন ঘটনা ক’জনেরই বা জানা আছে?