বিয়ের রাতে কনেকে দেখে যেমন চেনা মুশকিল, তেমনি অনেক জায়গায় দুর্গাপুজোর আগের রাতে গেলে চেনা মুশকিল।
নিয়মিত কল্যাণী এক্সপ্রেস ওয়ে ধরে নাটাগড়ে রাজীবের চেম্বারে যাই। তবে সেটা সকাল বেলা। রাত্রে এইদিকে আসা হয়না। আজ রবিবার রুটিনে একটু পরিবর্তন হলো। সকালে আমাদের মাধ্যমিক ব্যাচ ৯৮ এবং নবযুবক সংঘের উদ্যোগে রক্তদান উৎসব ছিল বাঁশপুলে। তাই নাটাগড়ে সকালের বদলে রাতে গেলাম।
যখন চেম্বার থেকে ফিরছি রাত সাড়ে আটটা বাজে। কল্যাণী এক্সপ্রেস ওয়েতে উঠে অবাক হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছে যেন উৎসব চলছে। রাস্তার বাঁ দিকে বড়বড় আলো ঝলমলে বার কাম রেস্টূরেন্ট। সেগুলোর সামনে গাড়ি, মোটর সাইকেলের সারি। ঝিকমিকি আলো জ্বলছে। দুমদাম গান বাজছে। পিলে চমকে দিয়ে শাঁই শাঁই করে দেবা- দেবী মোটর সাইকেলে পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
বেশ অন্যরকম লাগল। এটাই কি সেই খানাখন্দ ভরা রাস্তা, যেটা দিয়ে আমি সকালে ঘুম ঘুম চোখে যাই? আমার জীবনে বৈচিত্র বড় কম। রোগীদের মধ্যেই যা কিছু একটু বৈচিত্র। তাও বেশিরভাগ রোগীই মুখ গোমড়া করে থাকেন। তাই নতুন কিছু দেখলে বড়ো ভালো লাগে। এমনকি বৃষ্টিতে রাস্তায় হাঁটু জল হয়ে গেলেও ভালো লাগে। একঘেঁয়েমি কাটে।
স্কুটার দাঁড় করালাম। তবে কোনো আলো ঝল মলে বারের সামনে নয়। রাস্তার বাঁ দিক আলোয় আলো। ডান দিকটা ততটাই অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা ঝুপরি দোকান। এই ২০২১ সালেও সেগুলোতে ফিলামেন্টের টিমটিমে হলুদ বাল্ব জ্বলছে। কেটলিতে চায়ের জল ফুটছে। মাঝারি মাপের একটা অ্যালুমুনিয়ামের ডেকচিতে ঘুগনি। ঢাকনার উপর খোসা সমেত কয়েকটা সেদ্ধ ডিম, পাউরুটি।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে রাস্তার অন্যদিকে দেখছিলাম। কাল মহাষষ্ঠী। সুন্দর হাওয়া বইছে। জোড়ায় জোড়ায় কমবয়সী ছেলেমেয়েরা ঘোরাঘুরি করছে। তাদের মুখ খুশিতে ঝকমক করছে। ভালো থাক, সকলে খুশি থাক। মারামারি কাটাকাটি না করে প্রেম করা অনেক ভালো। তবে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, এই সব জায়গায় খানা পিনা করা তো বেশ খরচ সাপেক্ষ। বেশিরভাগ ছেলে মেয়েদের বয়স কম- এখনও উপার্জনের বয়স হয়নি। এরা কোথা থেকে এতো অর্থ পায়? আমাদের আশে পাশে এতো বড়োলোক বাবা আছে?
যাকগে, মরুগগে…ওসব নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে লাভ নেই। আপাতত এই সময়টাতো উপভোগ করি। এই যে চারদিকে এতো খুশি, হোক না সেটা অন্যের- বেশ লাগছিল। মনে হচ্ছিল সকাল থেকে রাত অবধি বদ্ধ খুপরিতে জীবনটা নেহাত অপচয় করছি। পৃথিবীর কতো কিছু অজানা থেকে গেল। কতো আনন্দ উপভোগ করা হলো না।
সাঁই সাঁই করে দুটো মোটর সাইকেল চলে গেল। মনে হয় তাঁদের মধ্যে রেস চলছে। মনে মনে বললাম, আস্তে চালা বাপ। জীবনটাকে উপভোগ করার জন্য বেঁচে থাকাটাও জরুরী। পাশেই পানিহাটি হাসপাতালে থাকার সময় প্রতি নাইট ডিউওটিতেই তিন-চারটে বাইক এক্সিডেন্টের কেস পেতাম।
ছোটো ঝুপরি দোকানটায় একজন দুজন করে খদ্দের আসছে। বেশীরভাগই বিড়ি সিগারেটের খদ্দের। একটি মেয়ে খুব সেজেগুজে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে সকলেই তাকাচ্ছে। আমি আরেক কাপ চা নিলাম।
একজন মাঝবয়সী মহিলা একটি বড়সড় বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালেন। দোকানী ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে গেলেন। বাচ্চাটিকে নিজের কোলে নিলেন। তারপর সাবধানে দোকানের ভেতরেই একটা ছোটো টেবিলে বাচ্চাটিকে বসিয়ে দিলেন।
এক নজরে বাচ্চাটাকে দেখতেই গোলোযোগটা বুঝতে পারলাম। যদিও ছেলেটি উচ্চতায় সাড়ে তিনফুটের বেশি হবে না, তবু সে মোটেই বাচ্চা নয়। রীতিমতো গোঁফদাড়ি বেরিয়েছে। বাচ্চা বলে যাকে ভাবছিলাম সে আসলে বামন।
কিন্তু সাধারণ বামনও নয়। হাত পাগুলো বাঁকা বাঁকা, সরু সরু। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সেগুলো দেহের ভার বহন করতে অক্ষম। কৌতূহল হচ্ছে, কিন্তু দোকানীকে জিজ্ঞেস করা উচিৎ হবে কিনা বুঝতে পারছি না।
দোকানদার ততোক্ষণে খেয়াল করেছেন আমি একদৃষ্টিতে তাঁর ছেলেকে দেখছি। তিনি নিজেই ম্লান হেসে বললেন, ‘আমার ছেলে বাবু। প্রায় জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী।’
‘ডাক্তার দেখিয়েছেন?’
‘হ্যাঁ ছোটো বেলায় অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। ওর হাড়গোড় বড্ড পলকা। একটুতেই ভেঙে যায়। সেই ছোট্ট বেলা থেকে টানা পিজি হাসপাতালে দেখিয়েছি। উন্নতি হচ্ছিল না। তাই ওর যখন পাঁচ বছর বয়স, ভেলোর গেছলুম। ওখানে দেড় মাস ছিলুম। ডাক্তারবাবু সব দেখে শুনে বলেছিলেন, এই রোগ সারবে না। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাড় ভাঙা অনেক কমে যাবে। ছেলে অনেকটা সুস্থ হয়ে যাবে। কিন্তু কোথায় কী? ইদানীং তো মাঝে মাঝেই বুকে ব্যথা হয়। দমের কষ্ট হয়। গরীব মানুষ আমরা। যে টুকু টাকাপয়সা ছিল, ছেলের পেছনেই খরচ করেছি। আর ভেলোর যাওয়ার সম্ভব নয়। তাছাড়া লকডাউনে লকডাউনে ব্যবসার অবস্থা খারাপ। একজন বলেছিলেন এই রোগ নাকি হোমিওপ্যাথিতে সারে। তাই আপাতত হোমিওপ্যাথি ওষুধ খাওয়াচ্ছি।
সাজগোজ করা মেয়েটিও আড়চোখে মাঝে মাঝেই ছেলেটিকে দেখছে। তাঁর চোখেও কৌতূহল। ছেলেটির কী রোগ হয়েছে সেটা সম্ভবত আমি বুঝতে পেরেছি। রোগটির নাম অস্টিওজেনেসিস ইমপারফেক্টা। অত্যন্ত বিরল রোগ। এই রোগে হাড়ের কোলাজেন টিশু তৈরী হয়না বা হলেও সেই কোলাজেন টিশুতে খুঁত থাকে। যার ফলে সামান্য আঘাতেই বা অনেক সময় আঘাত ছাড়াও হাড় ভেঙে যায়।
আমার এই রোগাক্রান্ত একজন রোগিণী আছে। তার নাম শ্রীময়ী। শ্রীময়ীর বয়স ১৮ বছর। কিন্তু দেখে আট নয় বছরের বেশি মনে হয়না। তার বাবা মাও অনেক ঘুরে অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। তাছাড়া করোনার সময়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে ডাক্তার দেখানোও সম্ভব নয়। শ্রীময়ীর মাঝে মাঝেই ফুসফুসে সংক্রমণ হয়। ওর বাবা একটা ঠেলা হুইল চেয়ারে করে নিয়ে আসেন। বাড়ির চেম্বারের সামনে রাস্তায় হুইল চেয়ার দাঁড় করিয়ে আমাকে ডাক দেন।
শ্রীময়ীকে বেশি নাড়াচাড়া করাও বিপজ্জনক। আমি রাস্তাতে নেমেই ওকে দেখি। খুব সাবধানে স্টেথো বসাই। সাঁই সাঁই শব্দ শুনি। ওর বাবা বলেন, ‘পরশুও ভালো ছিল। হঠাৎ করে কী যে হলো?’
শ্রীময়ী কষ্টের মধ্যেও হাসে। বলে ‘সেরে যাবে তো ডাক্তারকাকু? পড়াশুনোয় বেশ ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।’
মেয়েটা পড়াশুনোয় ভালো। ওর জীবনের একমাত্র লক্ষ ছিল মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ভালো রেজাল্ট করা। মহামারীর দাপটে ওর সেই স্বপ্নে ইতি ঘটেছে। তবে হাল ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে নয়। এখন উচ্চমাধ্যমিকের জন্য লড়াই শুরু করেছে।
তবে ওকে দেখে আমার নিজেরই আজকাল হতাশ লাগে। মনে হয় এই যে এতটা উৎসাহ নিয়ে ও পড়াশুনো চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কী লাভ? এই পুরো প্রচেষ্টা কী একটা অদ্ভুত অপচয় নয়? যদি পরীক্ষা দিয়ে ভালো রেজাল্টও করে, তাতে কী লাভ হবে? ও কী কোনো কলেজে ভর্তি হতে পারবে? তাছাড়া ইদানীং এতো ঘন ঘন ওর ফুসফুসে সংক্রমণ হচ্ছে যে আমিই মাঝে মাঝে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছি। মাঝে মাঝেই শ্রীময়ীর বাবাকে বলি, ‘একটু বড়ো জায়গায় মেয়েকে দেখান না।’
ওর বাবা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেয়ের মাথায় হাত বোলান, ‘আর কোথায় যাব ডাক্তারবাবু?’
ওষুধ লেখার সময় নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে পারিনা। মনে হয় এই ওষুধ কাজ করবে তো? যদি না করে?
আঠারো বছরের তিনকোনা মুখের লিকপিকে মেয়েটি আবার জিজ্ঞেস করে, ‘শ্বাসকষ্টটা কমে যাবে তো ডাক্তারকাকু?’ পুরো পরিস্থিতি থেকে পালাতে ইচ্ছে করে। পালানোর উপায় নেই। খুপরিজীবী ডাক্তার হয়ে একেবারে ফেঁসে গেছি।
এই ছেলেটির বয়সও শ্রীময়ীর মতো। ছেলেটিকে দেখতে দেখতে এতক্ষণের ফুরফুরে মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। মনে হলো জীবনের কী দারুণ অপচয়। এর চেয়ে হয়তো ভালো ছিল ছেলেটির জন্ম না হওয়া।
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে অন্য জগতে চলে গেছিলাম। একটা অলৌকিক সুরেলা আওয়াজে হুঁশ ফিরে এলো। ছেলেটি যে কখন একটা বাঁশি হাতে তুলে নিয়েছে খেয়াল করিনি। আমাকে অবাক ভাবে তাকাতে দেখে দোকানী গর্বের সাথে বলল, ‘ও খুব ভালো বাঁশি বাজায়। অনেক অনুষ্ঠানেও ডাক পায়। তবে ইদানীং একটু দমের ঘাটতি হচ্ছে।’
আমি ঘাড় নাড়লাম। কিছু বললাম না। কারণ ততোক্ষণে ঐ অলৌকিক সুর আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। দোকানের সামনে যারা ছিলো সকলেই চুপ হয়ে গেছে। ছেলেটিকে দেখছে। সেই অতিরিক্ত সাজগোজ করা মেয়েটিও চেয়ে আছে। হলুদ ম্যাড়মেড়ে আলোও তার চোখের কোনের জল লুকিয়ে রাখতে পারছে না।
হঠাৎ বাঁশির সুর ছাপিয়ে ঢাকের আওয়াজ শোনা গেল। সাইকেল ভ্যানে এক্সপ্রেস ওয়ে দিয়ে সপরিবারে মা দুর্গা মণ্ডবে চলেছেন। ভ্যানের পেছন পেছন কটি বাচ্চা ছেলে মেয়ে হাঁটছে- লাফাচ্ছে। সবশেষে একজন ঢাক কাঁধে। তার পাশে একটি ছোটো ছেলে প্রাণপণে কাঁসর বাজাচ্ছে। ভিড়ের মধ্যে একটি ছেলেকে বড়ো চেনা চেনা মনে হচ্ছে। চোখে চশমা, কালো রঙ, এক মাথা ঝাঁকড়া চুল। সামান্য একটা কাঠের বাঁশির এতোটা ক্ষমতা- একধাক্কায় ত্রিশটা বছর জীবন থেকে কমিয়ে দিতে পারে? নাকি ওই তিন ফুটের রোগগ্রস্ত শরীরটার মধ্যেই যে জীবনটা রয়েছে সেই জীবনটাই একটা ম্যাজিক।
অপচয় বলে দেগে দেওয়ার আমরা কে?