প্রায় চার হাজার বছর আগে উত্তর পূর্ব আফ্রিকায় তরমুজের চাষ শুরু হয়। সুস্বাদু রসালো ফল তৃষ্ণা মেটায় এবং শরীরকে সতেজ রাখে। মানুষ সেকথা সহজেই বুঝতে পারে এবং ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে তরমুজের চাষ ছড়িয়ে পড়ে।
তরমুজ সবুজ রঙের রসালো ফল, তার ভিতরে লাল রঙ, রসে ভরা। এখন আমরা জানতে পেরেছি, এই তরমুজের রসের অনেক উপকারিতা আছে। এর মধ্যে নানা পুষ্টিকর উপাদান, ভিটামিন এবং এন্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা আমাদের শরীরকে নানা ভাবে রক্ষা করে। এই প্রতিবেদনে আমরা তরমুজের উপাদান এবং গুনাবলী নিয়ে আলোচনা করবো।
১। আমাদের তৃষ্ণা নিবারণ করে এবং দলের চাহিদা মেটায়।
তরমুজে জলের পরিমাণ ৯২ শতাংশ। তাই তরমুজ আমাদের শরীরকে যথেষ্ট জলের জোগান দেয়। এই জল আমাদের শরীরের বিভিন্ন কাজ করে। এর মধ্যে প্রধান
শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ -প্রত্যঙ্গের স্বাভাবিক কাজকর্ম বজায় রাখা, অন্ত্র থেকে শোষিত পুষ্টিকর পদার্থকে শরীরের কোষে কোষে পৌঁছে দেওয়া এবং জলের জোগানের মাধ্যমে শরীরকে সতেজ রাখা।
যেহেতু তরমুজে জল বেশি থাকে এবং জলে ক্যালোরি কম থাকে, তাই তরমুজ খেলে ক্যলোরি কম খাওয়া হয় এবং ওজন বাড়ার সম্ভাবনা কম থাকে। যাদের ওজন বেশি এবং ওজন কমাতে চান, তাদের পক্ষে তরমুজ খুব ভালো ফল। পেটও ভরবে আবার ক্যালোরি কম থাকায় ওজনও বাড়বে না।
২। পুষ্টি উপাদানে ভরপুর তরমুজ
তরমুজ পুষ্টি উপাদানে ভরপুর। এক কাপ তরমুজে (১৫২ গ্রাম)
কার্বোহাইড্রেট -১১.৫ গ্রাম, তার মধ্যে সুগার থেকে ৯.৪ গ্রাম।
ফাইবার -০.৬ গ্রাম
প্রোটিন- ০.৯ গ্রাম
ফ্যাট- ০.২ গ্রাম,
ভিটামিন-এ- দৈনিক চাহিদার ৫%,
ভিটামিন-সি দৈনিক চাহিদার ৪%,
পটাসিয়াম দৈনিক চাহিদার ৪%,
ম্যাগনেসিয়াম- দৈনিক চাহিদার ৪%,
সিট্রুলিন নামক এক ধরনের এমাইনোএসিড্- যা পরিশ্রমে সাহায্য করে।
এ ছাড়াও থাকে এন্টিওক্সিডেন্ট- যেমন ভিটামিন সি, লাইকোপেন, কুকুরবিটাসিব-ই।
আমাদের শরীরে বিপাকীয় ক্রিয়ার ফলে তৈরি হয় কিছু আয়ন, যা শরীরের কোষকে ধংশ করে। এর ফলে ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা ও ক্যান্সারের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এন্টিওক্সিডেন্ট এই ফ্রি রেডিক্যাল বা আয়নকে ধংশ করে ও শরীরকে রক্ষা করে।
৩। ক্যান্সার প্রতিরোধক ক্ষমতা
লাইকোপেন, কুকুরবিটাসিব-ই এর ক্যান্সার প্রতিরোধক ক্ষমতা আছে। গবেষনায় দেখা গেছে, লাইকোপেনের প্রষ্টেটের এবং কোলোরেকটাল ক্যান্সারের সম্ভাবনা কমিয়ে দেবার ক্ষমতা আছে। আমাদের কোষ বিভাজনে সাহায্য করে ইন্সুলিন-লাইক-গ্রোথ-ফ্যাক্টর (IGF )। লাইকোপেন রক্তে IGF এর মাত্রা কমিয়ে দেয়। আর কুকুরবিটাসিব-ই ক্যান্সার কোষকে ধংশ করতে সাহায্য করে এবং শরীর নিজেই ক্যান্সার কোষকে ধংশ করে।
৪। হার্টের সমস্যা কমায়
লাইকোপেন শরীরের কোলেষ্টেরল কমাতে সাহায্য করে। হার্টের সমস্যার প্রধান শত্রু কোলেষ্টেরল । লাইকোপেন রক্তচাপও কমাতে সাহায্য করে। এর ফলে দুই ভাবেই লাইকোপেন হার্টের সমস্যা কমিয়ে দেয়।
এ ছাড়া হার্টের জন্যে উপকারি মিনারেল ও ভিটামিন – যেমন ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম ও ভিটামিন-এ, বি৬ ও সি তরমুজে থাকে।
৫। শরীরের প্রদাহ এবং ক্রনিক রোগ কমায়
এন্টিওক্সিডেন্ট, লাইকোপেন, এবং ভিটামিন সি এর সম্মিলিত প্রভাবে, শরীরের প্রদাহ (inflammation ) এবং দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিক রোগের উপশম হয়।
এছাড়া, বয়স জনিত নার্ভের রোগ, Alzheimer’s disease ও তরমুজ কমায় বলে গবেষনায় দেখা গেছে।
৬। চোখের রোগ কমায়
বয়স জনিত চোখের রোগ, ম্যাকুলার ডিজেনারেশান (AMD- age related macular degeneration)তরমুজের ভিতরে থাকা লাইকোপেন কমিয়ে দেয়। এই ম্যাকুলার ডিজেনারেশান বয়স্কদের অন্ধত্বের অন্যতম কারণ।
৭। পেশিশক্তি বাড়ে
তরমুজে থাকা সিট্রুলিন পেশির ক্ষমতা বাড়ায়, পেশির ছিড়ে যাওয়া রোধ করে ও ব্যাথা কমায় । নিয়মিত সাত দিন খেলেই যারা ব্যায়াম করে তারা তাদের অবস্থার উন্নতি বুঝতে পারে।
এছাড়া সিট্রুলিন রক্তনালিকে প্রসারিত করে, হার্টের কাজ কমায়, শরীরে নাইট্রিক অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ায়।
পুরুষের যৌনশক্তি বাড়াতে সাহাজ্য করে ভায়াগ্রা, যা নাইট্রিক অক্সাইড বাড়ানোর মাধ্যমে কাজ করে। এই জন্যে অনেকের অভিমত, তরমুজ খেলে পুরুষের যৌনশক্তি বাড়ে। তরমুজকে বলা হয় ন্যাচারাল ভায়াগ্রা। তবে এই বিষয়ে কোনও নিশ্চিত তথ্য নেই। আরও গবেষণা প্রয়োজন।
৮। তরমুজ ত্বককে ভাল রাখে।
ভিটামিন এ ও সি ত্বকের পক্ষে উপকারি।
ভিটামিন সি- খেলে বা ত্বকে লাগালে ত্বকে কোলাজেন তৈরিতে সহায়তা করে। কোলাজেন ত্বককে দৃড় ও সতেজ রাখে, চুল ভাল রাখে। ত্বকে শুষ্ক ভাব আসে না এবং ভাঁজ বা রিঙ্কেল দূর করে।
ভিটামিন-এ ত্বকের কোষের ক্ষয় কমায়, কোষ নষ্ট হলে রিপেয়ারে সাহায্য করে। ভিটামিন এ কোথাও কেটে গেলে বা যে কোন অঘাতপ্রাপ্ত ত্বক তাড়াতাড়ি সারতে সাহাজ্য করে।
৯। হজমে সাহায্য করেঃ
তরমুজে অনেক জল ও কিছু ফাইবার থাকে। তরমুজের জল হজমে সাহায্য করে আর ফাইবার মল তৈরি এবং অন্ত্রের চলাচল ঠিক রাখে। সব মিলিয়ে তরমুজ একটি হজমে সাহায্যকারি ফল। যে সব খাদ্যে ফাইবার ও জল কম থেকে, সেই খাবার কোষ্ঠকাঠিন্য করে। কিন্তু তরমুজে প্রচুর জল থাকে, যা হজমে সাহায্য করে।
তরমুজের অপকারিতা
তরমুজ শুধু উপকার করে, তাই নয়- অতিরিক্ত তরমুজ খেলে স্বাস্থ্যের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এবার আমারা সেই সব বলব
তরমুজ বেশি খেলে যে সমস্যা দেখা দিতে পারে- যেমন
১। পেটের সমস্যা
যেহেতু তরমুজে যথেষ্ট ফাইবার থাকে, বেশি খেলে তাই ফাইবারের কারণে পেট ফাঁপা, পেটে গ্যাস হওয়া,ডায়রিয়া ইত্যাদি হতে পারে।
এছাড়া সরবিটাল নামক এক ধরণের সুগার এবং লাইকোপেন নামক রঞ্জক পদার্থ, যার কারণে তরমুজ লাল হয়, এই যৌগই পেটের সমস্যার জন্যে দায়ী।
২। সুগার বাড়তে পারে
তরমুজের গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স ৭২, যথেষ্ট বেশি। তাই যাদের ডায়াবেটিস আছে, তারা বেশি তরমুজ খেলে তাদের সুগার বাড়তে পারে। তাই তারা অবশ্যি চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পরিমান ঠিক করবেন।
১০০ গ্রাম তরমুজে সুগার থেকে ৬ গ্রাম, ক্যালোরি থাকে ৩০ কিলোক্যালোরি। স্বাভাবিক ব্যাক্তির সব খাবার মিলিয়ে দৈনিক ১০০-১৫০ গ্রাম সুগার খাওয়া উচিত। তরমুজ খাওয়ার সময় সে কথা মাথায় রাখতে হবে।
৩। লিভারের ক্ষতি করতে পারে
যারা নিয়মিত মদ্যপান করেন, তাদের পক্ষে তরমুজ ভাল নয়। তরমুজের লাইকোপেন মদের সাথে বিক্রিয়া করে এবং মদ ও লাইকোপেন লিভারের ক্ষতি করে।
৪। ওয়াটার ইন্টক্সিকেশান
তরমুজে ৯২% জল থাকে। যাদের কিডনির সমস্যা আছে, বা যাদের অসুখের জন্যে জল জমে যেতে পারে, তারা বেশি তরমুজ খেলে শরীরে জল জমে যেতে পারে। এই জল জমে যাওয়ার জন্যে পা ফোলা, পেটে জল জমা, ফুসফুসে জল জমা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি রগ দেখা দিতে পারে।
৫। হার্টের সমস্যাঃ
তরমুজে যথেষ্ট পরিমান পটাসিয়াম থেকে। পটাসিয়াম হার্টের পক্ষে উপকারি, কিন্তু অধিক মাত্রা হলে হার্টের নানা সমস্য দেখা দেয়, বিশেষ করে হার্ট-রেট অনিয়ন্ত্রিত হতে পারে। পালস দুর্বল হতে পারে। ব্লাড প্রেসার কমে যেতে পারে।
৬। অন্যান্য
তরমুজের বিভিন্ন উপাদানে যাদের এলার্জি আছে, তরমুজ খেলে তাদের এলার্জি হতে পারে।
গর্ভবতী মায়েদের তরমুজ কম বা না খাওয়া ভাল, কারণ ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা থাকে।
অধিক মাত্রায় তরমুজ খেলে যৌন অক্ষমতা আসতে পারে।
অধিক মাত্রায় তরমুজ খেলে ক্লান্তি আসতে পারে।
অন্য কিছু কথা
তরমুজ দিনের যে কোন সময়ে খাওয়া যায়।
স্বাভাবিক ব্যাক্তির একসাথে ১০০-১৫০ গ্রাম তরমুজের বেশি খাওয়া উচিত নয়।
কতটা তরমুজ খেলে আপনি মারা যাবেন? একসাথে ১০ কিলো তরমুজ আপনার মৃত্যু ঘটাতে পারে। এর মূল কারণ অত্যাধিক জল, যা শরীরের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
মিশরের ফারাওরা মনে করতেন, মৃত্যুর পরে তাদের অনেক দূরে যেতে হতে পারে, তাই তৃষ্ণা নিবারনের জন্যে তাদের সমাধিতে অনেক তরমুজ দিয়ে দেওয়া হত।
শেষ কথা
এই গরমে অবশ্যই তরমুজ খান, কিন্তু সাবধানে। অন্য রোগের কথা মাথায় রেখে পরিমাণ মত তরমুজ খান।