২৬শে আগস্ট মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (যিনি আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রীও বটেন) এস এস কে এম হাসপাতালে একটি মিটিংয়ের পরে কয়েকটি ঘোষণা করেছেন, যেগুলোর সাথে কোনোভাবেই ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম একমত হতে পারেনি।
ঘোষণাগুলি হলো-
১। প্রাইমারি হেলথ সেন্টারে কোয়াক (গ্রামীণ চিকিৎসক)-দের নিয়োগ করা হবে এবং তাঁরাই গ্রামীণ মানুষের প্রাথমিক চিকিৎসা করবেন।
২। সিস্টার ও ছেলে সিস্টারদের (??) মধ্যে যাঁরা ভালো কাজ করেছেন তাঁদের প্রাক্টিশনার নার্স পোস্ট তৈরি করে রোগী দেখার অনুমতি দেওয়া হবে।
৩। তাছাড়াও চিকিৎসক ও নার্সদের বিনামূল্যে জমি দেওয়া হবে।
গ্রামীণ চিকিৎসকদের হাতে গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্যের ভার ছেড়ে দেওয়া ‘স্বাস্থ্যে সকলের সমান অধিকার’ এই স্লোগানের পরিপন্থী।
একটি জনপ্রিয় গোয়েবলসীয় মিথ্যা অনেকেরই হৃদয়ে গেঁথে গেছে। সেটি হলো ‘গ্রামে পাশ করা চিকিৎসক যেতে চান না।’ বাস্তবটা হলো, গত এক বছরে সরকারি হাসপাতালে কোন চিকিৎসক নিয়োগ হননি। যদিও কথা ছিলো হেলথ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের মাধ্যমে বছরে দুবার করে চিকিৎসক নিয়োগ করা হবে।
বহু ডেন্টাল সার্জেন পাশ করে বছরের পর বছর একটি সরকারি চাকরির আশায় বসে আছেন। তাঁরা কিন্তু এক্ষেত্রে ভালো বিকল্প হতে পারতেন।
গ্রামীণ হাসপাতালগুলিতে নিরাপত্তার বড়ো অভাব। প্রায় প্রতিদিনই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তিক হাসপাতাল থেকে চিকিৎসক নিগ্রহের খবর আসে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে অনেকেই চাকরি ছাড়েন।
নিয়োগ ও বদলির ক্ষেত্রেও যথাযথ নিয়মের অভাব রয়েছে। হামেশাই মেদিনীপুরের ছেলে পোস্টিং পান আলিপুরদুয়ারে। অথচ তাঁর নিজের এলাকার প্রাইমারী হেলথ সেন্টারে কোনো চিকিৎসক নেই।
এছাড়াও চিকিৎসকদের মধ্যেও রাজনীতির অনুপ্রবেশ, এডমিনিস্ট্রেশনের দুর্ব্যবহার এরকম আরও বহু কারণে বহু চিকিৎসক চাকরি ছেড়ে দেন।
কোয়াকদের নিয়োগ করার সপক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। তিনি বলেছেন কোয়াকদের নিয়ে কাজ করার জন্য অভিজিৎ বাবু নোবেল পেয়েছেন। তবে আমরা যতটুকু জানি দারিদ্র্য দূরীকরণ নিয়ে কাজ করে তিনি নোবেল পেয়েছিলেন।
তবে অভিজিৎবাবু গ্রামীণ চিকিৎসকদের নিয়ে গবেষণার কাজ করেছেন এটাও সত্যি। তবে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, বরুণ কাঞ্জিলালের মতো পন্ডিতদের সুপারিশ ছিল গ্রামীণ চিকিৎসকদের বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ দিয়ে তালিকাভুক্ত করা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে তাঁদের স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রাথমিক স্তরে কাজে লাগানো। তাঁরা গ্রামের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ডাক্তারি করবেন এমনটা পন্ডিতদের সুপারিশ বলে আমাদের জানা নেই।
দেশের বর্তমান আইন অনুযায়ী এদেশে পাশ করা চিকিৎসক ছাড়া আর কেউ ওষুধ প্রেসক্রাইব করতে পারেন না–আধুনিক ওষুধ লিখতে গেলে অন্তত এমবিবিএস হওয়া চাই, আয়ুর্বেদিক ওষুধ লিখতে বিএএমএস, ইত্যাদি। যদিও কেউ না কেউ প্রতিমুহূর্তেই সেই নিয়ম ভাঙছেন। এবার সরকারি উদ্যোগে সেই নিয়ম ভাঙা হবে।
পৃথিবীর কোন কোন দেশে নার্স প্র্যাকটিশনাররা গৌরবের সঙ্গে কাজ করছেন। তাঁদের দায়িত্ব প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় ‘গেট কিপার’-এর মতো। তাঁরা বিশেষ কিছু অবস্থার চিকিৎসা করার অধিকারী এবং নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ তাঁরা প্রেসক্রাইব করতে পারেন। মুখ্যমন্ত্রী যদি রাজ্যে তেমনটা করতে চান তবে তাঁকে নার্সদের বিশেষ প্রশিক্ষণ ও আইন পরিবর্তনের ব্যবস্থা করতে হবে।
নার্স ও চিকিৎসকদের জমির টোপ না দিয়ে তাঁদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, সুস্থ পরিবেশের ব্যবস্থা করা বেশি জরুরি। আরও জরুরি করোনা- শহীদ চিকিৎসকদের পরিবারের প্রাপ্য অর্থ মিটিয়ে দেওয়া।
স্বাস্থ্য, শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। জনমোহিনী ঘোষণায় সেই অধিকারের কথা ভুলিয়ে দেওয়ার উদ্যোগের বিরোধিতা করছে ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম।
ভীষণ ভালো বক্তব্য।