(কেন যেন মনে পড়ে গেল আবার)
আমরা মেডিক্যাল কলেজের কিছু বন্ধু
উনচল্লিশ বছর আগে থেকে
একসঙ্গে আড্ডা মারি। চা খাই।
তখনকার উনিশশো বিরাশি থেকে
আজকের দুহাজার একুশের শেষ ভাগ পর্যন্ত সময় জুড়ে।
মাঝে পেরিয়ে গেছে এতগুলো বছর।
পেরিয়ে গেছে রামধনু রঙ আর
অশনিসংকেতের সংকটে মোড়া
বিভিন্ন সময়ের প্রবাহ।
হাজার ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে
এই ষাটের দোরগোড়ায় পৌঁছেও
এখনো আমরা একসাথে।
তখন ছাত্র ছিলাম।
আদর্শবাদের ছাত্র রাজনীতি ছিল।
স্বপ্নময় চোখে স্বপ্নের রোশনাই ছিল।
সমাজ বদলের তীব্র আবেগ ছিল।
আর ছিল বসন্ত কেবিন আর কুমার্স ক্যান্টিনের সস্তা চায়ের কাপ।
পয়সাহীন পকেট হাতড়ে
প্রতিদিন আমাদের
মানসিক জমায়েত হতো
আদর্শ পৃথিবী গড়ার গরিব আখড়ায়।
অপরিণত আমরা
আমাদের থেকে বয়স ও অভিজ্ঞতায়
পরিণত মানুষদের অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করে, তাদের ক্ষমা ও দয়ার পাত্র হয়ে
উদ্ধত সময় বাইতাম তখন।
পৃথিবীর সামন্ততন্ত্র,
পৃথিবীর সাম্রাজ্যবাদ,
পৃথিবীর শোষণ ও শোষিতের বিভাজন,
পৃথিবীতে বিপ্লবের সম্ভাবনার কথা চিন্তা করতে করতে কাটত আমাদের পূর্বপুরুষবিচ্যুত দিনরাত।
আমরা গরিব মানুষের অর্থহীন চা খেতে খেতে পৃথিবী দেখতাম রাজপথে দাঁড়িয়ে নয়, দোকানের ভিতর থেকে,
আর ভাবতাম,
আমরা বড় হতে হতে
আমাদের হাত ধরে
পৃথিবীও হয়ে যাবে
মহান, নির্বিষ, নির্ভার।
তারপর তার নাগরিকের জন্য মৌলিক অধিকারের সমবণ্টনের ভাগিদার আমরা
সেই স্বর্গপ্রায় পৃথিবীর কার্নিশে বসে
পা দোলাতে দোলাতে
জিরিয়ে নেবার চা খাব।
তার পর পরই
আমাদের আয়ত্বের বাইরে বেরিয়ে
সাবালক দিনকাল
পাল্টে যেতে শুরু করল নিজের মতো করে।
আমাদের পুরোনো বিশ্বাস ও তত্ত্বগুলোর দিকে পিছন ফিরে ফিকে দৃষ্টিতে তাকিয়ে
হাসতে হাসতে আমরাও
অসহায় ভাবে পাল্টে যেতে থাকলাম
দিনকালের দোহাই দিয়ে।
আমাদের সর্বহারা গালে দাড়ি গজালো।
পকেটে টাকা গজালো।
মনে বিদেশে থিতু হওয়ার স্বপ্ন গজালো।
বসন্ত কেবিন ও কুমার্স ক্যান্টিনের আবহের ব্যাকড্রপ পরিবর্তিত হতে হতে
কখনো হলো নিউটাউন কফি হাউস,
কখনো বিজনেস ক্লাব,
কখনো স্পেস টাউনের
সার্কেল ক্লাবের সমৃদ্ধি।
পাল্টে যাওয়া আমরা আর
সাম্রাজ্যবাদকে ততখানি দোষী না করে,
রুচিশীলতাকে বিসর্জন না দিয়ে
দার্জিলিং চায়ের ফার্স্ট ফ্লাশ, সেকেন্ড ফ্লাশ, ফিঙ্গার চিপস ও ফিশ ফিঙ্গারের স্বাদ
বুঝতে শুরু করলাম।
গত উনচল্লিশ বছর ধরে আমরা একসঙ্গে চা খাচ্ছি। আড্ডা মারছি।
আমাদের সংসার হয়েছে।
মনের গতি, শরীরের গতি শ্লথ হয়েছে।
ভাবনার পথ আটকে দাঁড়িয়েছে
দ্বিধার হুইল চেয়ার, ইনসুলিন আর ইনহেলার।
স্বপ্ন বোনার পুরোনো দৃষ্টিশক্তি
তবু ততখানি ক্ষীণ হয়নি এখনো।
যদিও সমৃদ্ধির স্যালাড খেতে খেতে,
পুরোনো স্বপ্নের স্মৃতিচারণ করতে করতে,
আর উত্তরপুরুষের দিকে তাকিয়ে
করুণা আর ক্ষমার হাসি হাসতে হাসতে
আমরা এগিয়ে চলেছি ভবিতব্যের দিকে।
আমরা পৃথিবী ও ভাবি মানুষের জন্য কোনকিছু পাল্টে দিতে পারিনি।
শুধু রুচিশীলতাকে বর্জন না করার সান্ত্বনা পুরস্কার হাতে নিয়েও
পাল্টে গেছি নিজেরা।
পৃথিবীও বদলে গেছে আগের থেকে।
যেমন সব নির্বিষেরাই একদিন নীলকন্ঠ হয়ে যায় পৃথিবীর মতো-
‘মানুষ নিমিত্ত মাত্র।’,
এই ক্লিশে অজুহাতকে সঙ্গী করে।
———————————————-
০১.১১.২০২১
(২৫.০৪.২০২৩)