যুদ্ধের ঘনঘটা: পশ্চিম এশিয়ায় হামাস্ কর্তৃক ইসরায়েল আক্রমণের পর প্যালেস্টাইনের গাজা স্ট্রিপ ইসরায়েল তছনছ করে দিয়েছে। গত তিনমাসে বহু হত্যা, ধ্বংস, দূষণ, গৃহহীনতার পরেও যুদ্ধ থামেনি বরং ছড়িয়ে পড়েছে পূবে প্যালেস্টাইনের অপর ভূখণ্ড জর্ডান নদীর পশ্চিম পাড়ে এবং উত্তরে লেবানন-ইসরায়েল সীমান্তে হিজবুল্লাহর সাথে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর ক্রমাগত সংঘর্ষে।
ইতিমধ্যে বিশ্ব নৌ পরিবহন এর অন্যতম পথ আরব সাগর-গালফ অফ এডেন-বাব এল মান্দেব-লোহিত সাগর- গালফ অফ সুয়েজ সংলগ্ন ইয়েমেনের পশ্চিম ও দক্ষিণ ভাগ নিয়ন্ত্রণকারী শিয়া সামরিক হুথি গোষ্ঠীর মার্কিন ও ইসরায়েল বান্ধব পশ্চিম দুনিয়ার বাণিজ্যিক জাহাজ গুলিতে একের পর এক আক্রমণ, ক্ষয় ক্ষতি ও অপহরণ এবং প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন ডেস্ট্রয়ার থেকে ইয়েমেনের হুথি এলাকায় মিসাইল হানা ও ভারত সহ পশ্চিমী দেশগুলির ও অস্ট্রেলিয়ার পাহারাদার নৌ বাহিনীর জাহাজ পাঠানো এই অঞ্চলে যুদ্ধের পূর্বাভাস ছড়াচ্ছে যা ভারতের সমুদ্র সীমা থেকে দূরে নয়। আর কাছেই জিবুতিতে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাইতেও বড় নৌ বাহিনীর অধিকারী চীনের নৌ ঘাঁটি।
এত অশান্তির মধ্যে ইরান অন্য তিনটি দেশের আকাশ সীমা লঙ্ঘন করে পরপর তিনটি ড্রোন আক্রমণ করল উত্তর ইরাকের কুর্দ অঞ্চলে ‘মোসাদের একটি ঘাঁটিতে’, সিরিয়ার একটি ‘মার্কিন ঘাঁটিতে’ এবং পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের দক্ষিণ পশ্চিমের একটি ‘ইরান বিরোধী জঙ্গী ঘাঁটিতে’। পাকিস্তান প্রত্যুত্তরে ইরানের শিস্তান – বেলুচিস্তানে পাল্টা ড্রোন হামলা চালালো ‘পাকিস্তান বিরোধী একটি জঙ্গী ঘাঁটিতে’।
ইসরায়েলের যেমন রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অচ্ছেদ্য জোট, সেরকম ইরানের রয়েছে রাশিয়া আর চীনের সাথে শক্তিশালী বাণিজ্যিক, সামরিক ও রণকৌশলগত সম্পর্ক। এর ফলে সরাসরি ইসরায়েল-ইরান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ইরান বিধ্বংসী যুদ্ধ লেগে যেতে পারে যা ভয়ানক রূপ পেতে পারে। সেক্ষেত্রে অন্য বড় শক্তিগুলির ও অনান্য দেশের যুক্ত হয়ে পড়া, পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার এবং তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ বেধে যাওয়া কোনটাই উড়িয়ে দেওয়া যায়না।
জল্পনা কল্পনা: পশ্চিমের কোন কোন বিশেষজ্ঞ মনে করছেন রাশিয়ার পুতিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সহযোগীদের আরও বেশি বেশি করে মধ্য এশিয়ার আঞ্চলিক যুদ্ধ গুলিতে জড়িয়ে ইউক্রেন দখলের পথকে সুগম করছেন। দেশের পরবর্তী নির্বাচনের আগে ও অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে সবদিক সামলাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কে হিমশিমও খেতে হচ্ছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের শি জিনপিং পুতিনকে মদত দিয়ে ঘোলা জলে মাছ ধরতে চাইছেন এবং তার পরবর্তী লক্ষ্য তাইওয়ান দখল যার থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ সরাতে চাইছেন। উভয়েই এবং উত্তর কোরিয়া ইরানকে মদত দিচ্ছে ও আধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করছে এবং ইরানের ও অন্যান্য মাধ্যমে হামাস, হিজবুল্লাহ, হুথি প্রমুখ সামরিক গোষ্ঠীগুলিকেও।
আবার মার্কিন বিরোধী বিশেষজ্ঞরা কেউ কেউ মনে করছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে এবং মধ্য এশিয়ার খনিজ তেল ভান্ডারের নিয়ন্ত্রণ রাখতে এই বেনামী (proxy war) এবং পরিস্থিতি বিশেষে সরাসরি সামরিক আক্রমণ গুলি (onslaughts) জারি রাখছে। শক্তিশালী ও ‘অবাধ্য’ ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহুদিনের নিশানা। সি আই এ ইরানের মধ্যে সম্প্রতি একটি বড় অন্তর্ঘাত (বিস্ফোরণ) ঘটিয়ে ইরানকে প্ররোচিত করেছে। এবার সুন্নি পাকিস্তান ও শিয়া ইরান কে লড়িয়ে দিয়ে কিংবা পাকিস্তান-ইরান-আফগানিস্তানে অবস্থিত বৃহৎ বেলুচিস্তান বিচ্ছিন্নতা (বা স্বাধীনতা) আন্দোলনকে চাগিয়ে দিয়ে আঞ্চলিক অশান্তি সৃষ্টি করে ফায়দা লুটতে চাইছে।
ভারতের হতে পারে সসেমিরা অবস্থা। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গত করতে বাধ্য থাকা, অন্যদিকে পুরনো মিত্র ইরান কে সাহায্য করা ও পাকিস্তানের বিরোধিতা করার চিরাচরিত অবস্থান। তাছাড়া তেল, বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের এবং সেই সংক্রান্ত অর্থনীতির কারণে ভারত প্রচন্ডভাবে ঐ অঞ্চলের উপর নির্ভরশীল। ওখানে যুদ্ধ শুরু হলে ভারতের উপর প্রবল প্রভাব ফেলবে।
ভয়ঙ্কর পরিণতি: কারণ যাই হোক না কেন এই অঞ্চলে আবার নতুন করে যুদ্ধ শুরু হলে সামগ্রিকভাবেই ভয়ঙ্কর পরিণতি হবে। ধ্বংস, হত্যা আর দূষণের বন্যা বয়ে যাবে। বিশ্ব জুড়ে ব্যবসা, অর্থনীতি, কাজকর্ম, যাতায়াত, ভ্রমণ সব কিছুর প্রবল ক্ষতি হবে।
হামাসের ইসরায়েল আক্রমণ দেখে আমাদের কিছু বঙ্গজ বিপ্লবী ও বিদ্দ্বজ্জন উল্লাসে ভেসে গিয়েছিলেন। আমরা কিন্তু বলেছিলাম এটি মারাত্মক ভুল হল। ইহুদীদের পবিত্র উৎসবের দিনে নিরীহ ইসরায়েলের নাগরিকদের, মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সহ, হত্যা অত্যাচার ও পণবন্দী করার প্রতিশোধে প্রবল সামরিক শক্তিধর ও ফিলিস্তিন বিরোধী ইসরায়েল গাজাকে আস্ত রাখবে না।
মনে রাখতে হবে, দীর্ঘ প্যালেস্টাইন স্বাধীনতা আন্দোলনে সশস্ত্র থেকে আলোচনার পথে এসেই আরাফাতের নেতৃত্বে পি এল এ স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গড়তে সক্ষম হন। সেই রাষ্ট্র ও তার অধিবাসীদের উপর অত্যাচার চললেও এই পর্যায়টি ছিল তুলনামূলক হিংসামুক্ত সময় যখন ইসরায়েল-সৌদি আরব-মিশর-জর্ডান-প্যালেস্টাইন (ওয়েস্ট ব্যাংক এর ক্ষমতাসীন ফাতা অংশ) একটি জোট তৈরি করতে চলেছিল।
বঙ্গজ বিপ্লবী ও বিদ্বজ্জনরা এখন নির্বিঘ্নে রাম মন্দিরের উদ্বোধন দেখছেন এবং তৃণমূল-বিজেপির সমস্ত পরিসর দখল উপভোগ করছেন। কিন্তু গাজার মানুষকে সর্বস্ব দিয়ে হামাসের আক্রমণের ফল ভোগ করতে হচ্ছে। যেরকম দুই বৃহৎ শক্তির সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য না রেখে সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিবিরে যোগদানের জেলেনেস্কির অবিমৃষ্যকারি সিদ্ধান্ত সমৃদ্ধশালী ইউক্রেন ও ইউক্রেন বাসীদের জীবনে বিপর্যয় নিয়ে এসেছে।
এর আগে আফগানিস্তান, ইরাক এবং সিরিয়া, লিবিয়া ও ইয়েমেনের অংশ বিশেষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছিল। সেই সাংঘাতিক অভিজ্ঞতাও ভুলবার নয়। ভুলবার নয় ইরান – ইরাক যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির কথা। ইরান, লেবানন (মিশ্র ধর্মীয়), ইয়েমেন বাদবাকি পশ্চিম এশিয়ার ইসলামি দেশগুলির শাসক ও মানুষদের বুঝতে হবে বর্তমান পরিস্থিতিতে হিংসা দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত তুলনামূলক অনেক বড় সামরিক শক্তির সাথে লড়তে যাওয়া কিংবা অন্য কোন বৃহৎ শক্তির প্ররোচনায় পা দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে যাওয়া বিরাট ভুল হবে। হিংসা বা যুদ্ধ নয় শান্তি পূর্ণ আলোচনা চালিয়ে, দেশের মধ্যে ও অন্যত্র শক্তিশালী গণ আন্দোলন গড়ে তুলে এবং সমমনস্ক দেশগুলি মিলে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক স্তরে কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়ে সমস্যাগুলি সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। যুদ্ধ জিগির, ধর্মীয় উন্মাদনা, মৌলবাদী অন্ধতা, প্রতিশোধস্পৃহা ইত্যাদি রিপুকে দমিত করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিকাঠামো উন্নয়ন, সার্বিক জীবন যাপনের মানের উন্নয়ন, নারী মুক্তি, অর্থনৈতিক বিকাশ, সবুজায়ন ও পরিবেশের উন্নতি, প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক, আঞ্চলিক শান্তি ও সুস্থিতি প্রভৃতির উপর জোর ও মনোযোগ দিতে হবে। তাতেই তাদের ও সকলের মঙ্গল।
১৯.০১.২০২৪